গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত, বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চলছে না

ঢাকার সাভারে পোশাক শিল্পের তিনটি কারখানাতে প্রতিটির জন্য অনুমোদিত গ্যাসের চাপ ১৫ পিএসআই (প্রতি বর্গইঞ্চিতে গ্যাসের চাপের ইউনিট)। অথচ জুন মাসজুড়ে এগুলো শূন্য  দশমিক ৬ পিএসআই চাপে গ্যাস পেয়েছে। একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জে অবস্থিত একটি স্পিনিং এবং আরেকটি টেক্সটাইল মিলের। এ দুটি কারখানার জন্য ১৫ পিএসআই চাপের গ্যাস বরাদ্দ থাকলেও, গত মাসে সর্বোচ্চ ৪ পিএসআই চাপে গ্যাস পেয়েছে। কখনো কখনো কোনো গ্যাসই ছিল না। এ কারখানাগুলোর মতো গ্যাস সংকটে ভুগছে দেশের প্রায় সব শিল্প কারখানা। চাহিদা অনুযায়ী, গ্যাস না পেয়ে উৎপাদন কমেছে কারখানাগুলোতে। দেখা গেছে, প্রতিদিন বিকাল ৫টার মধ্যে গ্যাসের চাপ শূন্যে নেমে যাচ্ছে।

উদ্যোক্তা-ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্রায় ২৫ শতাংশ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে টেক্সটাইল মিলসগুলোতে। স্পিনিং, নিটিং, গার্মেন্টস, স্টিলসহ বিভিন্ন শিল্পে ৫ থেকে ২০ শতাংশ উৎপাদন কমেছে। 

এ দিকে সপ্তাহের ব্যবধানে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাস সরবরাহ কমেছে প্রায় ১৮ শতাংশ। এতে ৩ জুলাই গ্যাসচালিত এক হাজার ৬২৯ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রাখতে হয়েছে। এক সপ্তাহ আগেও তা ছিল মাত্র ৫৮৮ মেগাওয়াট। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দামও চড়া। এতে দিনে ১১০ কোটি টাকার বেশি লোকসান গুনছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। তাই তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রও পুরোদমে চালানো যাচ্ছে না। এতে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ রেখে লোডশেডিং দিতে বাধ্য হচ্ছে কর্তৃপক্ষ।

সংশ্লিষ্ট একাধিক দপ্তরের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেছেন, বিশ্ববাজারে দাম ঊর্ধ্বমুখী থাকায়  খোলাবাজার (স্পট মার্কেট) থেকে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) কিনছে না সরকার। ফলে কমে গেছে দেশে গ্যাস সরবরাহ। এতে আবাসিকের পাশাপাশি শিল্প খাতও ভুগছে গ্যাস সংকটে। এর মধ্যে বিদ্যুৎ খাতেও কমিয়ে দেওয়া হয়েছে গ্যাস সরবরাহ, যার প্রভাবে হঠাৎ করে নেমেছে বিপর্যয়। শুরু হয়েছে দেশব্যাপী লোডশেডিং। যদিও দ্রুতই এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জানা গেছে, সম্প্রতি সাভার, ভালুকা, রূপগঞ্জসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে টেক্সটাইল মিলগুলোকে গ্যাস সংকটের কারণে বয়লার বন্ধ রাখতে হয়েছে। ফলে বন্ধ রাখতে হয়েছে উৎপাদনও। এর মধ্যে সাভারের বাইপাইলের একটি বড় গ্রুপের কারখানায় গ্যাসের চাপ না থাকায়, গত ৪ জুলাই সকাল সাড়ে ৮টায় বয়লার বন্ধ করা হয়। দিনের শুরুতেই  দেখা  দেওয়া এ সংকট রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত কাটেনি। ফলে সারা দিনই বয়লার সচল করা যায়নি।

একইভাবে ময়মনসিংহের ভালুকার সিরামিক পণ্যের কারখানা এক্সিলেন্টও গ্যাস সংকটে পড়েছে। কারখানা কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সারা বছর প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টাই সচল থাকে এটি; কিন্তু গত বেশ কিছু দিন বিকালের দিকে গ্যাসের চাপ ১৭ থেকে ১০-এ এবং একপর্যায়ে শূন্যে নেমে যায়। এতে মারাত্মকভাবে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এ রকম চলতে থাকায় কারখানাটি বন্ধ করে দেওয়ার শঙ্কা তৈরি হয়েছে।

এ বিষয়ে এক্সিলেন্ট টাইলস ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ হাকিম বলেন, আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি। গ্যাস থাকে না বললেই চলে। কারখানা প্রায় বন্ধ হওয়ার অবস্থায়। এ রকম পরিস্থিতি চলতে থাকলে আমরা একসময় দেউলিয়া হয়ে যাব।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, গত তিন মাস বা তারও বেশি সময় ধরে আমাদের কারখানাগুলো নির্ধারিত চাপে গ্যাস পাচ্ছে না। তিতাস গ্যাস কোম্পানি গ্যাস না দিয়ে পাইপলাইনে শুধু বাতাস সরবরাহ করে আমাদের কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা বিল নিচ্ছে। ১ হাজার ২০০টি ইলেকট্রনিক ভলিউম ক্যারেক্টার (ইভিসি মিটার) আমদানি করা হলেও, অল্পসংখ্যক মিলে তা স্থাপন করা হয়েছে। ইভিসি মিটার বসালে তিতাসের সিস্টেম লস কত শতাংশ, সেটি বোঝা যাবে। তাই হয়তো তারা ইভিসি মিটার স্থাপনে আগ্রহী নয়। অপর এক ব্যবসায়ী বলেন, নির্ধারিত চাপে ও মাপে গ্যাস না দিয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার মাধ্যমে তিতাসের এক শ্রেণির কর্মকর্তারা প্রতারণা করছেন।

বিটিএমএর দাবি, এ সমস্যার কারণে রপ্তানিমুখী টেক্সটাইল মিলগুলোর অন্তত আড়াই হাজার  কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে। উৎপাদন বন্ধ থাকার কারণে রপ্তানিমুখী তৈরি পোশাক খাতে সুতা ও ফ্যাব্রিক্স সময়মতো সরবরাহ করা যায়নি। উৎপাদনে দেরি হওয়ায় ক্রেতার কাছে পণ্য পৌঁছে দিতে আকাশপথ ব্যবহার করতে হয়েছে। যার কারণে বেড়েছে খরচ। আবার অনেক রপ্তানি আদেশ বাতিল হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও সৃষ্টি হয়েছে।

গ্যাস সংকটের বিষয়ে তিতাসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. হারুনুর রশীদ মোল্লাহ বলেন, এলএনজি সরবরাহ কমে গেলে জাতীয় গ্রিডে গ্যাসের ওপর তার প্রভাব পড়ে। গত কয়েক দিনে এলএনজি সরবরাহ ৬৫০ এমএমসিএফডিতে নেমে এসেছে। ফলে তিতাসের আওতাভুক্ত গ্রাহকরা গ্যাস কম পাচ্ছেন। চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ না পেলে সংকট হবেই।

তিতাসের সূত্র অনুযায়ী, সংস্থাটির সব গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী গ্যাস সরবরাহ করতে হলে  দৈনিক ২১০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন। সেখানে তিতাসকে দেওয়া হচ্ছে ১৮০ কোটি ঘনফুট। যদি এলএনজি সরবরাহ কমে যায় তখন চাহিদা ও সরবরাহের পার্থক্য বাড়তে থাকে।

পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান নাজমুল আহসান বলেন, গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ঘাটতি কমিয়ে আনার জন্য সব ধরনের চেষ্টা করছে সরকার। তবে বর্তমান পরিস্থিতিতে সারা বিশ্বই সাশ্রয়ী হচ্ছে। এলএনজির দাম কমলে স্পট থেকে আমদানি করা হবে। এখন দেশীয় উৎস  থেকে উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া দেশে গ্যাসের যতটুকু প্রমাণিত মজুদ আছে, তার যথাযথ ও ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবহার করতে চায় সরকার। তাই যত দিন নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত না হবে এবং প্রমাণিত মজুদ না বাড়বে, তত দিন বর্তমানে দেশীয় গ্যাসক্ষেত্র থেকে যতটুকু গ্যাস উত্তোলন করা হচ্ছে তার বেশি উৎপাদন করা যাবে না। স্থলভাগ এবং সমুদ্রভাগে গ্যাসের নতুন উৎসের সন্ধান জোরদার করা হয়েছে। 

এ দিকে হঠাৎ দেশব্যাপী লোডশেডিং শুরু হওয়ায় সম্প্রতি রাতে নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এক পোস্টে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, ‘গ্যাস স্বল্পতার কারণে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। গ্যাস সরবরাহ স্বাভাবিক হলে বিদ্যুৎ উৎপাদন পুনরায় স্বাভাবিক হবে।’ কারণ ব্যাখ্যা করে তিনি আরও বলেন, ‘যুদ্ধের প্রভাবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির উচ্চমূল্য ও সরবরাহ অন্যান্য সব দেশের মতো আমাদেরও সমস্যায় ফেলেছে। এ পরিস্থিতিতে আপনাদের সাময়িক অসুবিধার জন্য আন্তরিক দুঃখ প্রকাশ করছি।’

গ্যাসের সরবরাহ কমে যাওয়ায় চলতি সপ্তাহ জুড়ে লোডশেডিং হয় রাজধানীসহ সারা দেশে। এর মধ্যে রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় দিনে চার থেকে পাঁচবার লোডশেডিং হচ্ছে। কোথাও কয়েক ঘণ্টা ধরে বিদ্যুৎ পাচ্ছেন না গ্রাহকরা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //