বাড়বে চীন-ভারতের সাথে দেশের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা

দেশের শিল্প ও অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর জন্য বাংলাদেশকে খাদ্যশস্য, প্রস্তুত পণ্য ও শিল্প কাঁচামাল আমদানি করতে হয়। আর এসব জিনিস আমদানির জন্য দেশের সবচেয়ে বড় বাণিজ্য অংশীদার চীন ও ভারত। উভয় দেশই নিজ নিজ বাজারে বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে। কিন্তু সেই বাজার প্রবেশাধিকার সুবিধা কাজে লাগিয়ে দেশ দুটিতে উল্লেখেযোগ্যভাবে রপ্তানির হার বাড়াতে পারছে না বাংলাদেশ। এতে করে চীন-ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা সহসা কমার কোনো সম্ভাবনা দেখছেন না বাণিজ্যসংশ্লিষ্টরা। 

মূলত চীন ও ভারতে যে ধরনের পণ্য আমদানির চাহিদা রয়েছে, তার অধিকাংশই বাংলাদেশে উৎপাদন হয় না। কিছু পণ্য উৎপাদন হলেও সেগুলোর দাম বিবেচনায় বাংলাদেশ প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারে না। এ পরিস্থিতিতে চীন-ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা কেবল বাড়বেই বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।

ভারত ২০১১ সালে বাংলাদেশকে অস্ত্র ও মাদক বাদে সব পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা দেয়। যদিও সেই সুবিধা কাজে লাগিয়ে শুধু পোশাক রপ্তানি বাড়াতে পেরেছে বাংলাদেশ। এছাড়া রপ্তানি কিছুটা বেড়েছে কৃষি প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্যে। বর্তমানে চীনের বাজারে ৯৮ শতাংশ বা সাড়ে আট হাজারেরও বেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা রয়েছে বাংলাদেশের।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০২০-২১ অর্থবছরে চীন থেকে বছরে ১ হাজার ২৯২ কোটি ডলারেরও বেশি অর্থমূল্যের পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ। দেশের মোট আমদানির ২৫ শতাংশ এটি। আবার রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে ওই অর্থবছরে চীনে রপ্তানি হয় ৬৮ কোটি ৩৪ লাখ ডলারের পণ্য। এটি দেশের মোট রপ্তানির মাত্র এক দশমিক ৩১ শতাংশ। চীনের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ এক হাজার ২২৪ কোটি ডলারেরও বেশি।

এদিকে ভারত থেকে বাংলাদেশ ২০২০-২১ অর্থবছরে পণ্য আমদানি করে ৮৫৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি অর্থমূল্যের, যা দেশের মোট আমদানির প্রায় ১৭ শতাংশ। অন্যদিকে একই অর্থবছর দেশটিতে বাংলাদেশের পণ্য রপ্তানি হয় ১৯৯ কোটি ডলারের কিছু বেশি মূল্যের। এটি দেশের মোট রপ্তানির ৩ দশমিক ৮ শতাংশ। এ হিসেবে ভারতের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্য ঘাটতির পরিমাণ ৬৬০ কোটি ডলার।

সংশ্লিষ্টদের মতে, চীন-ভারতের সাথে বাণিজ্যের এ ভারসাম্যহীনতা কমবে না। বরং পর্যায়ক্রমে বাড়তে পারে। এর অন্যতম কারণ গুটিকয়েক পণ্যে বাংলাদেশের রপ্তানি খাতের কেন্দ্রীভবন। রপ্তানিমুখী শিল্পোদ্যোক্তারা বিনিয়োগ বাড়ালেও তা গুটিকয়েক পণ্যকে ঘিরেই আবর্তিত। ফলে মোট রপ্তানির ৯০ শতাংশের বেশি আসে পাঁচ-সাতটি পণ্যের হাত ধরে।

নীতিনির্ধারকরা বলছেন, সার্বিকভাবে মূল সমস্যা হলো বাংলাদেশের রপ্তানিতে পর্যাপ্ত পণ্য নেই। বাংলাদেশ যে ধরনের পণ্য উৎপাদন করে, সেগুলো চীনেও তৈরি হয়। ফলে সেসব পণ্য চীন অন্য কোনো দেশ থেকে নিতে আগ্রহী হয় না। এজন্য চীনের বাজারে চাহিদা রয়েছে এমন বেশকিছু পণ্য বাংলাদেশ উৎপাদন করলেও সেগুলো রপ্তানি হয় না। প্রতিযোগিতামূলক মূল্যে পণ্য উৎপাদন করতে না পারার কারণেও সংকট রয়েছে। অনেক পণ্য এখন দেশের বাজারে উৎপাদন হচ্ছে, কিন্তু সেগুলো বহির্বিশ্বে নেওয়া যাচ্ছে না। এ ধরনের পণ্যের মধ্যে আছে টিভি, ফ্রিজ, সেলফোনের মতো ইলেকট্রনিকস পণ্য থেকে শুরু করে এখন বাংলাদেশে গাড়িও তৈরি হচ্ছে। যদিও বিশ্ববাজারে রপ্তানির ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক দাম নিশ্চিত করা যাচ্ছে না এমন অনেক পণ্যের ক্ষেত্রে।

নীতিনির্ধারকদের মধ্যে কেউ কেউ জানিয়েছেন, বাংলাদেশে পণ্য উৎপাদন হলেও তা চীনের বাজারের চাহিদার সাথে সংগতিপূর্ণ নয়। চীনের চেয়ে ভারতে বাংলাদেশের বাজারের তুলনামূলক বৈচিত্র্য বেশি। দেশটিতে শুকনো খাবার থেকে শুরু করে কৃষিজাত খাদ্যপণ্য রপ্তানি হয়। এখন পোশাকও বেশ ভালো পরিমাণে রপ্তানি হচ্ছে। তবে সামগ্রিকভাবে ভারতের বিপুল জনগোষ্ঠী বিবেচনায় দেশটিতে বাংলাদেশের রপ্তানি উল্লেখযোগ্য নয়। অন্যদিকে চীনে পোশাক রপ্তানি তেমন হয় না বললেই চলে। আবার পাটও রপ্তানি হয় না। চীন নিজেই পোশাকের বড় উৎপাদক। ফলে চীনে সংকটটা বেশি। তবে মোটাদাগে উৎপাদিত পণ্যের বৈচিত্র্য ঘাটতি বড় সমস্যা, যা চীন-ভারতের পাশাপাশি অন্য দেশগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ  বলেন, এ সমস্যা থেকে উত্তরণ রাতারাতি হবে না। এখন এ বিষয়ে কিছু কাজ হচ্ছে। কিন্তু অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়ে গিয়েছে। কিছু পণ্যে যেগুলোয় বাংলাদেশ কম্পিটেটিভ নয়, এ ধরনের পণ্যে গার্মেন্টের মতো সুযোগ দিতে হবে, যেমন বিনা শুল্কে কাঁচামাল আমদানির সুবিধা, বন্ডেড ওয়্যারহাউজ সুবিধা। আবার রপ্তানিতে দিতে হবে প্রণদোনা সুবিধা। এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডে পণ্যের ব্যাপ্তি বাড়াতে হবে। কারণ এখান থেকে স্বল্প সুদে পণ্য আমদানি করা যায়। অর্থাৎ অর্থায়ন সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া পণ্যের মান সনদ দেয়ার বিষয়গুলোও নিশ্চিত হতে হবে। এ বিষয়টাতে সময় লাগবে। শিল্পোদ্যোক্তারা যেদিকে লাভ দেখেন সেদিকেই মনোনিবেশ করেন। আমাদের বেশির ভাগ বিনিয়োগ রপ্তানির ক্ষেত্র হচ্ছে পোশাক শিল্পসংশ্লিষ্ট। আর দেশের অভ্যন্তরে হলে সেটা দেখা যাচ্ছে খাদ্যপণ্য-সংশ্লিষ্ট। বিনিয়োগেও বৈচিত্র্য আনতে হবে। সর্বোপরি আমাদের পণ্য বৈচিত্র্য বাড়াতে হবে। কম্পিটেটিভ মূল্যে পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। মান অনুযায়ী পণ্য উৎপাদের পাশাপাশি দক্ষতাও বাড়াতে হবে।

একই মত আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য-সংশ্লিষ্টদেরও। তারা বলছেন, চীন সারা বিশ্ব থেকে যে ধরনের পণ্য আমদানি করে, তার কোনোটিই বাংলাদেশ তৈরি করে না। বাংলাদেশের যে পণ্যগুলো বেশি মাত্রায় উৎপাদন হয়, তার কোনোটিরই প্রয়োজন চীনের নেই। বাংলাদেশের প্রধান রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক, বিশ্বের যার সর্ববৃহৎ উৎপাদনকারী দেশ চীন।

বাংলাদেশ-চায়না চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (বিসিসিসিআই) যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্র আল মামুন মৃধা  বলেন, চীনের বাজারে আট হাজারেরও বেশি পণ্য শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পেয়েছে। আমরা চীনে রপ্তানি করার সক্ষমতা রাখি সাকল্যে ১০০ পণ্য। অর্থাৎ চীনের বাজার উপযোগী উৎপাদন সক্ষমতা আমাদের নেই। বাংলাদেশের চিংড়ি রপ্তানি সক্ষমতা ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৬০০ টন। আর চীনের শুধু একটি প্রদেশেই চিংড়ির চাহিদা এর ১০ গুণ। আবার বাংলাদেশের চিংড়ির দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চাহিদার অন্তত ৪০ শতাংশ বেশি। কারণ উৎপাদন খরচ বেশি। চিংড়ি যত ভালো মানেরই হোক না কেন, তা মূল্য বিবেচনায় প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছে না। আমাদের উৎপাদন সক্ষমতা যতটুকুই আছে সেটার প্রচারণা নেই। এ সমস্যা কাটাতে হবে। এজন্য চীন থেকে যেসব বিনিয়োগ সরে আসছে, সেগুলো ধরতে হবে।

ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) সভাপতি আবদুল মাতলুব আহমদ  বলেন, সুবিধাপ্রাপ্তি নিশ্চিত হওয়ার সময় থেকে চীন-ভারতের ক্ষেত্রে শুল্ক সমস্যা কেটে গিয়েছে। অশুল্ক বাধার ক্ষেত্রে বাজার নিয়মনীতি একটা চ্যালেঞ্জ। পশ্চিমা বাজারের নিয়মকানুন আমাদের জানা রয়েছে। কিন্তু আঞ্চলিক বাজার বিশেষত চীন-ভারতের বাজার সম্পর্কে ধারণা অপ্রতুল। অর্থাৎ পশ্চিমা বাজারকেন্দ্রিক মনোযোগ আমাদের এখনো রয়ে গিয়েছে। আঞ্চলিক বাজারের প্রতি গুরুত্ব নিশ্চিত হলে চীন-বাজারে বাজার সুবিধা কাজে লাগানো অনেক সহজ হবে। দুটি দেশই আমাদের চেয়ে সস্তায় পণ্য উৎপাদন করতে পারে। অন্যদিকে আমাদের রপ্তানির ঝুড়িতেও তেমন পণ্যসম্ভার নেই বললেই চলে। পণ্য বাড়াতে গেলে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতে হবে।

কূটনীতিকরা বলছেন, উৎপাদিত পণ্য না থাকলে পণ্য রপ্তানি বৃদ্ধির সুযোগ কম। এ নিয়ে আলোচনাও হচ্ছে। উৎপাদিত পণ্যের ঘাটতির বিষয়টি একমাত্র না হলে বড় বিষয় অবশ্যই। যখন কোনো দেশ আমাদের সুবিধা দেয়, সেগুলো ব্যবহার করা নিয়ে নানামুখী সমস্যা মোকাবেলা করতে হয়। আমরা যে পণ্যগুলো আমদানি করি, সেগুলো আমাদের প্রয়োজনেই। তারাও নিজস্ব প্রয়োজন হলেই শুধু বাংলাদেশ থেকে পণ্য কিনবে বা আমদানি করবে।

সাবেক রাষ্ট্রদূত মুনশি ফয়েজ আহমেদ  বলেন, ক্রেতা দেশের প্রয়োজন অনুযায়ী বাংলাদেশের পণ্য বিক্রি করতে হবে। সেগুলো আমরা না করলে পরিস্থিতি বদলাবে না। এদিকে আমাদের মনোযোগ কম। ব্যবসায়ীদের এক্ষেত্রে আরো এগিয়ে আসতে হবে। সরকারকেও এ বিষয়ে উদ্যোগী হতে হবে। নতুন পণ্য উৎপাদন করে নতুন বাজারে সেগুলো রপ্তানির জন্য মানসম্পন্ন বাজার সমীক্ষারও প্রয়োজন আছে। সেক্ষেত্রে পণ্যের গুণগত মান ও দাম দুটিই প্রতিযোগিতামূলক হবে। ভালো পণ্য কম দামে অন্য উৎস থেকে পেলে বাংলাদেশ থেকে কিনবে কেন? শুল্ক ও অশুল্ক বাধাও সমস্যা, সেগুলো দূর করতে হবে।

এখনো প্রচলিত পণ্যের ওপরই দেশের রপ্তানিকারকদের নির্ভরতা বেশি বলে মনে করেন রপ্তানিকারকদের সংগঠন এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদি। তিনি  বলেন, আমাদের পণ্য বাড়াতে হবে। বৈচিত্র্য আনতে হবে। পাশাপাশি প্রচলিত পণ্যের নকশায়ও বৈচিত্র্য আনতে হবে। উদ্ভাবনী পণ্য উৎপাদনে মনোযোগী হলে পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতির উন্নয়ন হবে। মানুষ সবসময়ই নতুনকে স্বাগত জানায়। চীন-ভারতে রপ্তানি বাড়াতে হলে বাংলাদেশের সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগাতে হবে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //