লোডশেডিংয়ে ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্পে উৎপাদন ব্যাহত

গত জুলাই মাস থেকে শুরু হওয়া লোডশেডিংয়ের কারণে দেশের শিল্পকারখানার উৎপাদন ও ব্যবসা- বাণিজ্য ব্যাহত হচ্ছে। এর মধ্যে গত সোমবার ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের প্রভাবে বিদ্যুতের খুঁটি ও তার ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে এক কোটির বেশি গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন।

সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন এসব অঞ্চলের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তারা। সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের নিজস্ব জেনারেটর ব্যবস্থা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে তাঁদের উৎপাদন। 

শিল্পাঞ্চলগুলো লোডশেডিংয়ের আওতার বাইরে রাখার দাবি জানানো হলেও কার্যত তা হয়নি। যথারীতি লোডশেডিং হচ্ছে দেশের বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে। ফলে উৎপাদন প্রক্রিয়া চরমভাবে ব্যাহত হওয়ায় ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে শিল্পকারখানাগুলো। বিশেষ করে রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্পের কারখানাগুলো লোডশেডিংয়ের কারণে সঠিক সময়ে উৎপাদন শেষ করে শিপমেন্টে ব্যর্থ হচ্ছে। এমনিতেই বৈশ্বিক মন্দা ও অন্যান্য সংকটের কারণে আমাদের রপ্তানিমুখী পোশাকশিল্প মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছে। আবার এই বিদ্যুৎ সংকটের কারণে মহাবিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে।

এদিকে জ্বালানি সাশ্রয়ে এলাকাভিত্তিক লোডশেডিংসহ বেশ কিছু উদ্যোগ চলমান। তবে কিছু জেলাশহর ও গ্রামাঞ্চলে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। এতে বিপাকে পড়েছেন এসব অঞ্চলের অতিক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি শিল্পের (সিএমএসএমই) উদ্যোক্তারা। দেশের বৃহৎ শিল্পকারখানাগুলোতে গ্যাসচালিত ক্যাপটিভ জেনারেটরভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং তেলচালিত জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকায় লোডশেডিংয়ে পণ্য উৎপাদনে তেমন প্রভাব পড়ছে না। যদিও উৎপাদনখরচ কিছুটা বাড়ছে। তবে সিএমএসএমই উদ্যোক্তাদের নিজস্ব জেনারেটর ব্যবস্থা না থাকায় ব্যাহত হচ্ছে তাঁদের উৎপাদন। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে এই তথ্য পাওয়া গেছে। 

যশোর নকশিকাঁথা অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মরিয়ম নার্গিস বলেন, ‘আমাদের বেশির ভাগ কাজ বৈদ্যুতিক স্বয়ংক্রিয় মেশিনে করতে হয়। দিনে পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় ব্যাপকভাবে ব্যাঘাত ঘটছে। প্রথমে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল অফিস টাইম আট ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকবে না; কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এই সময়ের মধ্যে তিন থেকে চার ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকছে না।’ তিনি বলেন, ‘অফিস সময়ে লোডশেডিং না দিয়ে রাতে দেওয়া হলে আমরা ক্ষতির কবল থেকে রক্ষা পাব।’ 

বাংলাদেশের নারী উদ্যোক্তা সমিতির রাজশাহী বিভাগের সভাপতি ও লিনা ফ্যাশন হাউসের উদ্যোক্তা আঞ্জুমান আরা পারভিন বলেন, ‘রাজশাহীতে আমার এলাকায় দিনের বেলায় পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা পর্যন্ত বিদ্যুৎ থাকছে না। ঠিকমতো কারখানা চালাতে না পারায় কর্মীদের বেতন ও ব্যাংকঋণ পরিশোধে সমস্যায় পড়ছি।’ 

বাল্ব, সুইচ, ক্যাবলসহ বিভিন্ন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম উৎপাদনে কাজ করছেন মুন্সীগঞ্জের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা নাজমুল ইসলাম। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম এসকেআরপি। তিনি বলেন, ‘আমার কারখানা খোলা থাকে সকাল ৯টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত। এই ৯ ঘণ্টার মধ্যে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টাই বিদ্যুৎ থাকছে না। কারখানায় উৎপাদন ঠিক রাখতে জেনারেটর চালাতে হচ্ছে। এতে আমাদের উৎপাদন ব্যয় অনেক বেড়ে যাচ্ছে। এর প্রভাব সরাসরি ভোক্তার ওপর পড়বে। কারণ পণ্য উৎপাদনে খরচ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বেই।’

অর্থনীতিবিদ এবি মির্জ্জা মো. আজিজুল ইসলাম বলেন, ‘ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ে নিঃসন্দেহে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে। যত দ্রুত সম্ভব এখান থেকে সরকারকে বেরিয়ে আসার পথ বের করতে হবে। পাশাপাশি ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যাতে তাঁদের কারখানা চালু রাখতে পারে, সে জন্য বিনাসুদে বা স্বল্পসুদে জেনারেটরের ব্যবস্থা করে দেওয়া।’ 

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ অবশ্য বলেছেন, শিগগিরই লোডশেডিংয়ের বিষয়ে নতুন পরিকল্পনা নেওয়া হবে। 

ক্ষতির মুখে পোলট্রি খামারিরা 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিদ্যুৎ না থাকায় গরমে খামারেই মারা যাচ্ছে মুরগি। এতে ক্ষতির মুখে পোলট্রি খামারিরা। কিশোরগঞ্জের পোলট্রি খামারের মালিক শহিদুল ইসলাম বলেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা লোডশেডিংয়ের কারণে গত কয়েকদিনে তার প্রায় অর্ধ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। অত্যধিক গরমে ব্রয়লার ও ডিম পাড়া কয়েক হাজার মুরগি মারা গেছে। 

গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলা পোলট্রি মালিক সমিতির সভাপতি এমএ মতিন বলেন, ‘এক ঘণ্টা পর পর লোডশেডিংয়ে অত্যধিক গরমে ব্রয়লার ও ডিম পাড়া মুরগি মারা যাচ্ছে। আমার খামারে ১০ হাজার ডিম পাড়া মুরগি রয়েছে, তার মধ্যে গত সাত দিনে ৭০০ মুরগি মারা গেছে। এলাকার প্রতিটি খামারেই গরমে মুরগি মারা যাচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘খামারিদের লোডশেডিংয়ের বাইরে রাখা প্রয়োজন। সেটা সম্ভব না হলে খামারগুলোতে সর্বোচ্চ দুই ঘণ্টার বেশি লোডশেডিং না দেওয়া।’ 

বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিদ্যুৎ বিতরণ সংস্থাগুলোর দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, প্রাথমিকভাবে সিত্রাংয়ের কারণে বিদ্যুৎ খাতে প্রায় ২২ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতির হিসাব পাওয়া গেছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশি ক্ষতি পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি)। সব গ্রাহকের কাছে বিদ্যুৎ ফিরিয়ে দিতে দেশের সবচেয়ে বড় এ বিতরণ সংস্থার ৩ হাজার ৩২৬টি দল মাঠে কাজ করছে। আরইবি সূত্র বলছে, ১ হাজার ৪টি খুঁটি (বিদ্যুৎ সরবরাহের পোল) ভেঙে গেছে। নতুন খুঁটি বসানো হচ্ছে। ৯ হাজার ২১২টি স্পটে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে গেছে। ৭ হাজার ১২৭টি মিটার ভেঙেছে। সব মিলে তাদের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ১২ কোটি টাকা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //