চিনির বাজারে নৈরাজ্যের কালো ছায়া

মিলমালিক ও আমদানিকারকরা দফায় দফায় চিনির দাম বাড়িয়েই চলেছেন। এই ভোগ্যপণ্যের দাম যেন কমার দিকে যাবেই না। গত পাঁচ মাসে চার দফায় চিনির দাম বেড়েছে ২৩ টাকা। চলতি সময়ে নিজেরা দাম বাড়ানোর পর মিলমালিক-আমদানিকারকরা নিজেরাই তা মানেননি- এমন ঘটনাও ঘটেছে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়েও বেশি দামে মিল থেকেই চিনি বিক্রি করছেন ব্যবসায়ীরা। এ কারণে পাইকারি ও খুচরা বাজারেও দাম না কমে আরও বেড়েই চলেছে। বাজারে যে যার মতো পারছেন দাম হাঁকিয়ে বিক্রি করছেন চিনি। আবার চিনির সরবরাহ কমিয়ে কৃত্রিম সংকট তৈরি করে রাখা হয়েছে। এ যেন এক নৈরাজ্য চলছে চিনির বাজারে। বাজার বিশ্লেষক ও সাধারণ ক্রেতারা এমনটাই বলছেন।

সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি চিনির দাম বাড়িয়ে নতুন মূল্য নির্ধারণ করে দেয় মিলমালিকরা। এদিন খুচরা বাজারে খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয় ১০৭ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনির দাম ঠিক করা হয় ১১২ টাকা। 

এর আগে দাম বাড়িয়ে নভেম্বর মাসে খোলা চিনির দাম ১০২ টাকা কেজি এবং প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১০৭ টাকা নির্ধারণ করা হয়। তার আগের মাসে অর্থাৎ অক্টোবর মাসে মিলমালিকরা প্রতি কেজি খোলা চিনির দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৯০ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৯৫ টাকা। 

আর সেপ্টেম্বর মাসে মিলমালিকরা খোলা চিনির দাম ঠিক করেছিল ৮৪ টাকা আর প্যাকেটজাত চিনির কেজি ৮৯ টাকা। অর্থাৎ গত পাঁচ মাসে চার দফায় খুচরা বাজারে খোলা চিনি ও প্যাকেটজাত চিনির দাম কেজিতে বেড়েছে ২৩ টাকা। কিন্তু মিলমালিকরা এই চার দফা নিজেরা দাম বাড়িয়ে একবারও সে দাম তারা নিজেরাই মানেননি। 

প্রতিবারই দেখা গেছে, মিলমালিকরা খুচরা পর্যায়ে যে দাম নির্ধারণ করে দিয়েছেন মিল থেকেই তারা সে দামে চিনি বিক্রি করেছেন। আর এ কারণেই চিনির বাজারে স্থিতিশীলতা আসছে না।

সর্বশেষ গত ২৬ জানুয়ারি প্রতি কেজি খোলা চিনি ১০৭ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও এখন দেশের কোথাও এ দামে চিনি মিলছে না। রাজধানী ঢাকার মুদি দোকান বা বাজারে খোলা চিনি তো মিলছেই না। কোনো দোকানে মিললেও এক কেজির দাম চাওয়া হচ্ছে ১২০ টাকা। অর্থাৎ মিলমালিকদের বেঁধে দেওয়া দামের চেয়েও ১৩ টাকা বেশি দামে বিক্রি করা হচ্ছে খোলা চিনি। আর প্যাকেটজাত চিনি ১১২ টাকায় বিক্রি করার কথা থাকলেও কোনো দোকানদার বিক্রি করছেন ১২৫ টাকায়, কেউ আবার বিক্রি করছেন ১৩০ টাকায়।

নির্ধারিত দামে কেন চিনি বিক্রি করছেন না- জানতে চাওয়া হলে রাজধানীর কারওয়ান বাজারের এক পাইকার দোকানি বলেন, আমাদের কিছুই করার নেই, চিনি নিয়ে খেলছেন মূলত মিলমালিকরা।

বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব গোলাম রহমান এ বিষয়ে বলেন, বিশ্ববাজারে চিনির দাম এখনও অনেক চড়া। তাছাড়া ডলার সংকটে এলসি খুলতেও সমস্যা হচ্ছে। এ জন্য পর্যাপ্ত চিনি আমদানি করা যাচ্ছে। ফলে বাজারে চিনির সরবরাহ বাড়ানো যাচ্ছে না।

মূলত দেশে চিনির বাজারে আছে মাত্র পাঁচটি প্রতিষ্ঠান। যেমন সিটি, মেঘনা, এস আলম, দেশবন্ধু ও আবদুল মোনেম লিমিটেড। এসব প্রতিষ্ঠান অপরিশোধিত চিনি আমদানি করে কারখানায় পরিশোধনের পর বাজারজাত করে। সরাসরি পরিশোধিত চিনি আমদানি করে খাদ্যপণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বছরে কমবেশি ২১ লাখ টন চিনি আমদানি হয়। দেশে উৎপাদিত হয় ২৫-৩০ হাজার টন। অর্থাৎ চিনির বাজার পুরোপুরি আমদানির ওপর নির্ভরশীল।

উদ্যোক্তা ও বাজারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চার কারণে চিনির বাজারে অস্থিরতা কাটছে না। প্রথমত- ঋণপত্র খুলতে না পারায় চিনি আমদানি হচ্ছে কম। আবার ঋণপত্রের জটিলতায় বন্দরে আসা চিনির চালান খালাসে বিলম্ব হচ্ছে। তাতে চাহিদার তুলনায় সরবরাহ কমে গেছে। বিশ^বাজারেও চিনির দাম বাড়তি। ডলারের বিনিময়হার বাড়ায় গাণিতিক হারে শুল্ককরও বেড়েছে। গ্যাস-বিদ্যুৎ সংকট কিছুটা কাটিয়ে উঠলেও নতুন করে দাম বাড়ানোর কারণে উৎপাদন ব্যয়ও বেড়েছে।

দেশে এখন প্রতি মাসে গড়ে পৌনে দুই লাখ টনের কমবেশি চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে চলতি অর্থবছর থেকে ঋণপত্র সংকটে চিনি আমদানি কমে গেছে। যেমন গত অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই থেকে ২৫ জানুয়ারি) চিনি আমদানি হয়েছে ১১ লাখ ৬৩ হাজার টন। এবার একই সময়ে আমদানি ৮ লাখ ৭৩ হাজার টন। আমদানি করা চিনির মধ্যে দেড় লাখ টনের বেশি এখনও বন্দরে ভাসছে। ঋণপত্রের জটিলতায় খালাসে বিলম্ব হচ্ছে।

তবে বাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, চিনির বাজারে কিছুটা সংকট থাকলেও দাম যে হারে বাড়ানো হয়েছে, সংকটের কারণে সে হারে বাড়ার কথা না। এ বিষয়ে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, চিনির বাজার এত বেসামাল হওয়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভই প্রধানত দায়ী। ডলার সংকটের কথা বলে তারা বাজার অস্থিতিশীল করে তুলেছে। অথচ প্রতি মাসেই কিন্তু ব্যবসায়ীরা প্রচুর চিনি আমদানি করছেন।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //