জ্বালানিতে অযৌক্তিক চার্জ বৃদ্ধি

প্রাকৃতিক গ্যাসের সঞ্চালন ও বিতরণ চার্জ বাড়িয়েছে সরকার। সঞ্চালন চার্জ প্রায় ১১৭ শতাংশ ও বিতরণ চার্জ ৫৭ থেকে ৬৩ শতাংশ পর্যন্ত বাড়িয়েছে সরকার।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোম্পানিগুলো যতই লাভ করুক, পরিচালন ব্যয় যখন বাড়বে তখন তারা সে দায় উৎপাদিত পণ্যের দরের ওপর ফেলবে। যার দায় প্রকৃতপক্ষে সাধারণ মানুসের ঘাড়েই বর্তাবে। নির্বাহী আদেশে যেভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, এর কোনোই যৌক্তিকতা ছিল না। এর ভয়াবহ ফল ভোগ করতে হবে। গত জানুয়ারিতে গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও ছয় মাসের ব্যবধানে অর্থাৎ জুলাই মাস থেকে সঞ্চালন ও বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য বাড়তি এই চার্জ নির্ধারণ করা হলো। নির্বাহী আদেশে গত ২০ জুলাই জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের উপসচিব শেখ মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেনের স্বাক্ষর করা এ সংক্রান্ত প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ বলছে, এতে করে গ্রাহক পর্যায়ে গ্যাসের দামে কোনো প্রভাব পড়বে না। 

ভোক্তা পর্যায়ে গ্যাসের মূল্য থেকেই এই চার্জ কাটা হয়। আগে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) ভোক্তা পর্যায়ে দামের পাশাপাশি কোম্পানিগুলোর মাসুলও নির্ধারণ করে দিত। কিন্তু গত ১৮ জানুয়ারি সরকার নতুন আইনে নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বাড়ায়, যা ফেব্রুয়ারিতে কার্যকর হয়। ২০ জুলাইয়ের ওই আদেশে বলা হয়, গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির সঞ্চালন চার্জ প্রতি ঘনমিটার ৪৭ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১.০২ টাকা করা হয়েছে। বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি (বিজিএফসিএল) এবং সিলেট গ্যাস ফিল্ড কোম্পানির নতুন মার্জিন হবে প্রতি ঘনমিটারে ১ টাকা। বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেডের (বাপেক্স) মার্জিন হবে ৪ টাকা। এদিকে গ্যাস সঞ্চালন কোম্পানির (জিটিসিএল) মার্জিন হবে ১ দশমিক শূন্য ২ টাকা।

এছাড়া ছয়টি গ্যাস বিতরণ কোম্পানির বিতরণ মার্জিন বাড়ানো হয়েছে। তিতাস গ্যাস বিতরণ কোম্পানির ঘনমিটারপ্রতি বিতরণ চার্জ ১৩ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ পয়সা, বাখরাবাদে ১৯ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩০ পয়সা, কর্ণফুলীর ২৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ৩৭ পয়সা, পশ্চিমাঞ্চল গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে ১৬ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৬ পয়সা, সুন্দরবন গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে ১৫ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ২৪ পয়সা এবং জালালাবাদ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিতে ১১ পয়সা থেকে বাড়িয়ে ১৮ পয়সা করা হয়েছে। এর আগে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ নির্বাহী আদেশে গ্যাসের দাম বাড়ায়। আর গত বছরের জুনে গণশুনানির মধ্য দিয়ে গ্যাসের দাম বাড়িয়েছিল বিইআরসি।

এদিকে দেশে গ্যাসের দামের বিষয়ে সর্বশেষ গণশুনানি হয় গত ২০২২ সালের মার্চে। কোম্পানিগুলো গ্যাসের দামের পাশাপাশি বিতরণ চার্জ বাড়িয়ে দেওয়ার আবেদন করেছিল। ওই শুনানিতে বিইআরসি টেকনিক্যাল কমিটির রিপোর্টে বলা হয়েছিল সবগুলো কোম্পানিই মুনাফায় রয়েছে। লোকসান হচ্ছে এমন দাবিতে গ্যাস কোম্পানিগুলো দীর্ঘ দিন ধরে মাসুল বৃদ্ধির দাবি করছিল। কোম্পানিগুলো মুনাফা করছে এমন যুক্তিতে বিইআরসি তাদের দাবি নাকচ করে দেয়। ফলে কোম্পানিগুলো জ্বালানি বিভাগে চার্জ বৃদ্ধির আবেদন করে। এর পরই নির্বাহী আদেশে মাসুল বাড়ানো হলো।

শুনানিতে দেখা যায়, কোম্পানিগুলোর পরিচালন বহির্ভূত আয় এত বেশি যে, তাদের বিতরণ চার্জ আদায় না করলেও মুনাফায় থাকে। অর্থাৎ কয়েক হাজার কোটি টাকার ব্যাংক আমানত, নানারকম মাসুল দিয়েই মুনাফায় থাকে কোম্পানিগুলো। আর এই কারণে শুধু চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিতরণ কোম্পানির কর্ণফুলী গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির মাসুল কিছুটা দেওয়ার মতামত দেয় টেকনিক্যাল বা কারিগরি কমিটি। পরে কর্ণফুলীর তৎকালীন বিদ্যমান দর ঘনমিটার ২৫ পয়সা থেকে কমিয়ে ৯ পয়সা করার সুপারিশ দেওয়া হয়। আর অন্যান্য বিতরণ কোম্পানির বিতরণ চার্জ বিলুপ্ত করার সুপারিশ আসে হিসাব থেকে।

এদিকে গ্যাস সঞ্চালনের একমাত্র সংস্থা গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানি লিমিটেড (জিটিসিএল) প্রতি ইউনিট গ্যাস সঞ্চালন করে আয় করত ৪৭ পয়সা। জুলাই থেকে তারা পাবে এক টাকা ২ পয়সা। আর বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন (পেট্রোবাংলা) প্রতি ইউনিট থেকে আয় করবে শূন্য দশমিক শূন্য ৬৮৩ টাকা। এলএনজি আমদানির দায়িত্বে থাকা রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল) প্রতি ইউনিটে পাবে শূন্য দশমিক ১০৪৩ টাকা। কোম্পানিগুলোকে আরও আয় বৃদ্ধির সুযোগ করে দেওয়া হলো।

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এম. শামসুল আলম বলেন, সরকারি কোম্পানিগুলো এমনিতেই লাভ করছে। তাই কমিশন তাদের দাবি আমলে নেয়নি। তাদের রাজস্ব চাহিদা বুঝেই চার্জ নির্ধারণ করেছিল। নির্বাহী আদেশে চার্জ বাড়িয়ে তাদের বাড়তি মুনাফার পথ সৃষ্টি করা হলো। নির্বাহী আদেশে যেভাবে গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হচ্ছে, এর কোনোই যৌক্তিকতা ছিল না। এর ভয়াবহ ফল ভোগ করতে হবে। বিইআরসি কিছুটা হলেও দুর্নীতি-অনিয়ম রোধে ভূমিকা রাখত। এখন সেই জায়গাটি থাকল না। এতে করে বেপরোয়া হয়ে উঠবে কোম্পানির লোকজন। গণশুনানিতে অনেক অস্বস্তিকর প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো। সে ভয়ে তারা অনেক অনিয়ম কমিয়ে দিতে বাধ্য হন। এখন সেই জায়গাটিও বন্ধ করে ফেলা হলো। এতে দুর্নীতি ও স্বেচ্ছাচারিতা বেড়ে যাবে।

নির্বাহী আদেশে বিতরণ কোম্পানিগুলো থেকে শুরু করে সঞ্চালন কোম্পানির বিতরণ মার্জিন বাড়ানোর কোনো যৌক্তিকতা দেখছেন না জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের ভাষ্য, লাভে থাকা রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিগুলোর বিতরণ মার্জিন বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা কোথায়? বিতরণ কোম্পানিগুলোর গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে। লোকসানে না থাকলে তাদের বিতরণ মার্জিন বাড়ানোর যৌক্তিকতা কোথায়? লাভে থাকলে কেন তাদের মার্জিন বাড়িয়ে বাড়তি টাকা নিতে হবে সেটি পরিষ্কার হওয়া দরকার। গণশুনানিতে তারা সেটির কারণ দেখাতে পারেনি। যদি যৌক্তিক কোনো কারণ থাকে, তাহলে সেটি জনসাধারণের জানার সুযোগ দিতে হবে। এভাবে মার্জিন বাড়িয়ে কোম্পানিগুলোকে মুনাফা করার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //