ওষুধ অত্যাবশ্যকীয় পণ্য হলেও স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে এ শিল্পটি ছিল গভীর সংকটে। ওষুধ উৎপাদন ছিল গুটিকয়েক বহুজাতিক কোম্পানির হাতে জিম্মি। চাহিদার ৯০ শতাংশ ওষুধই আমদানি করতে হতো। সেখানে এ শিল্পে আজ জাদুময় পরিবর্তন। যেখানে সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, ফিলিপাইন ও ভিয়েতনামের মতো দেশগুলো ৬০ থেকে ৮০ শতাংশ ওষুধ আমদানি করে, সেখানে বাংলাদেশে চাহিদার ৯৮ শতাংশ ওষুধ নিজেরাই উৎপাদন করছে।
শুধু তাই নয়, ওষুধ রপ্তানি এখন বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাতে পরিণত হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়াসহ বিশ্বের ১৫০টিরও বেশি দেশে এখন বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। বাংলাদেশে এখন দুই শতাধিক স্থানীয় প্রতিষ্ঠান ওষুধ উৎপাদন করছে। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো ট্যাবলেট, ক্যাপসুল, লিকুইড প্রিপারেশন, ড্রাই সাসপেনশন, ইনজেকশন, ন্যাজাল স্প্রে ও স্যাশের মাধ্যমে গ্র্যানিউলসহ প্রায় সব ধরনের ডোসেজ উৎপাদনে সক্ষম। জাতিসংঘের শিক্ষা ও বিজ্ঞানবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকো ইতোমধ্যে তাদের বিজ্ঞান প্রতিবেদনে বলেছে, বিশ্বের স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বড় ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ।
খুবই উন্নত প্রযুক্তির ওষুধ ছাড়া প্রয়োজনীয় প্রায় সকল প্রকার ওষুধ বর্তমানে বাংলাদেশেই উৎপাদিত হচ্ছে। বর্তমান বাংলাদেশে ৫ হাজার ব্রান্ডের ৮ হাজারেরও বেশি ওষুধ উৎপাদন হচ্ছে বলে জানা গেছে। আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে ওষুধ তৈরির কাঁচামাল স্থানীয়ভাবে উৎপাদন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখা, সরকার আরও নীতি ও আর্থিক সহায়তা দিলে- ওষুধ শিল্প অনেক দূর যাবে বলে মনে করছেন মালিকরা।
স্বাধীনতার পরপর ওষুধের বাজার প্রায় পুরোটাই বহুজাতিক কোম্পানির নিয়ন্ত্রণে ছিল। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচ ও প্রথমার যৌথ উদ্যোগে প্রকাশিতব্য স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর : স্বাস্থ্য খাতে অর্জন গ্রন্থে বলা হয়েছে, ১৯৭২ সালে ওষুধের বাজার ছিল ১০০ কোটি টাকার কম। এর মধ্যে ৯০ শতাংশ ছিল আমদানি করা ওষুধ।
স্বাধীনতার আগে দেশে দেশি ওষুধ কোম্পানি ছিল দুটি। আর দেশে এখন নিবন্ধন করা ওষুধ কোম্পানি আছে ২৭৪টি। ১৯৮১ সালে আটটি বিদেশি কোম্পানিসহ ১৬৬ কোম্পানি দেশে ওষুধ বানাত। এর মধ্যে আটটি বিদেশি কোম্পানি বানাত ৭০ শতাংশ। ১৫৮টি দেশি কোম্পানির মধ্যে মধ্যম সারির ২৫টি কোম্পানি বানাত ১৫ শতাংশ এবং বাকি ১৫ শতাংশ তৈরি করত ১৩৩টি ছোট কোম্পানি। ওই সময় সব কোম্পানি সিরাপ, ভিটামিন, মিক্সচার, টনিকসহ অপ্রয়োজনীয় ওষুধ বানাত।
এ নীতিমালা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে সফল ভূমিকার কৃতিত্ব অনেকটাই গণস্বাস্থ্যের প্রতিষ্ঠাতা ও মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর। এই নীতির কারণে দেশে সহজ প্রযুক্তির ওষুধ আসা শুরু হয়। তালিকা করে দেড় হাজারের বেশি ওষুধ দেশে নিষিদ্ধ করা হয়। বলা হয়েছিল, যেসব ওষুধ দেশি কোম্পানিগুলো তৈরি করতে পারে সেসব ওষুধ আমদানি করা যাবে না। এগুলো ছিল ওষুধশিল্প পর্যায়ক্রমে স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার পেছনের কারণ। ওষুধনীতি হওয়ার পর ট্যাবলেট, ইনেজকট্যাবল, ক্যাপসুল, অ্যান্টিবায়োটিকের মূল্য নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে ওষুধ থেকে অধিক বা অনৈতিক মুনাফা করার পথ অনেকটা বন্ধ হয়ে যায়।
১৯৮২ সালের ওষুধনীতিতে ১৫০টি ওষুধকে অত্যাবশ্যকীয় হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়। কোম্পানিগুলোর মোট উৎপাদনের ৬০ শতাংশ অত্যাবশ্যকীয় ওষুধ উৎপাদনকে বাধ্যতামূলক করা হয়। এরপর ২০০৫ এবং সর্বশেষ ২০১৬ সালে সংস্কার করে নতুন ওষুধনীতি করা হয়। ওষুধনীতির আগে সরকার ১৯৭৪ সালে ঔষধ প্রশাসন পরিদপ্তর গঠন করে। তারও আগে ১৯৭৩ সালে প্রয়োজনীয় ওষুধ আমদানি করার জন্য ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের অধীনে একটি সেল গঠন করা হয়েছিল।
রপ্তানি আয়ের তৃতীয় বৃহত্তম খাত এখন ওষুধশিল্প। স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো পৃথিবীর ১৫৭টি দেশে ওষুধ রপ্তানি করে থাকে। গত ৭ বছরে এ খাতে রপ্তানি আয় প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে। ২০১৪ সালে ওষুধ রপ্তানি করে বাংলাদেশের আয় ছিল ৬৯ দশমিক ২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ছয় বছর পর আয় বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়। ২০২০ সালে ওষুধ রপ্তানি করে আয় ছিল ১৩৫ দশমিক ৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। বাংলাদেশে উৎপাদিত ওষুধের ৮০ শতাংশ জেনেরিক এবং ২০ শতাংশ পেটেন্টেড।
ওষুধের বাজারও এখন অনেক বড়। ১৯৮১ সালে তৈরি ওষুধের স্থানীয় বাজার ছিল ১৭৩ কোটি টাকা। ২০০২ সালে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৪১০ কোটি টাকা, ২০১২ সালে ৯ হাজার ৩৯০ কোটি, ২০১৭ সালে ১৮ হাজার ৭৫৫ কোটি, ২০১৮ সালে ২১ হাজার ২২৬ কোটি, ২০১৯ সালে ২৩ হাজার ১৮৪ কোটি এবং ২০২০ সালে ২৬ হাজার ১৩৮ কোটি টাকা।
মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, আফগানিস্তান, কেনিয়া, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, নেপাল, নাইজেরিয়া, ডেনমার্ক, সোমালিয়া, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, মিয়ানমার, জার্মানি, ব্রাজিল, পানামা, ডেনমার্ক, ব্রিটেন, নেদারল্যান্ডস, কেনিয়া, ইউক্রেন, স্পেন, কানাডা, জাপান, ইতালি, ইন্দোনেশিয়া, ভিয়েতনাম, পাকিস্তান, ইয়েমেন, সিঙ্গাপুর, ফ্রান্স ও দক্ষিণ আফ্রিকা এবং দক্ষিণ কোরিয়া , মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ, মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের ওষুধ রপ্তানি হচ্ছে। রপ্তানির তালিকায় প্রতিবছরই নতুন নতুন দেশ অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে।
রাজধানীর পাশে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলায় অ্যাক্টিভ ফার্মাসিউটিক্যাল ইনগ্রেডিয়েন্টস (এপিআই) ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক করা হয়েছে। পার্কে কারখানা স্থাপন করা প্রতিষ্ঠানগুলো আমলাতান্ত্রিক জটিলতা ও গ্যাস সংযোগের অভাবে উৎপাদন শুরু করতে পারছে না। বাংলাদেশ ২০২৬ সালের মধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হতে যাচ্ছে, তাই আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী পেটেন্টকৃত ওষুধ উৎপাদনে ছাড় সুবিধা হারাবে বাংলাদেশ। ছাড়ের সুবিধা হারালে ওষুধ রপ্তানিতে ঘাটতি বাড়তে পারে। ওষুধ শিল্প উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থাসহ অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে জোর লবিং করতে হবে, যাতে ২০৩৩ সালের পরও মেধাস্বত্ব ছাড়ের সুবিধা অন্তত আরও ১০ বছর বহাল থাকে।
জাতীয় পর্যায়ে ওষুধের কাঁচামাল তৈরির গবেষণা প্রতিষ্ঠান এখনো নেই, যা ভারত ও অন্যান্য দেশে কয়েক দশক আগেই প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এ ধরনের প্রতিষ্ঠান তৈরি হলে রিভার্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে জেনেরিক ড্রাগগুলোর কাঁচামাল তৈরির প্রযুক্তি ও পদ্ধতি সহজেই ডেভেলপ করতে পারত এবং স্থানীয় কোম্পানিগুলোকে প্রযুক্তিগত সহায়তা দিতে পারত। পাশাপাশি গ্যাস-পানি ও বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের চ্যালেঞ্জ রয়েছে। বর্তমানে প্রায় হাজার কোটি টাকার ওষুধের চোরাচালান হয়, তা বন্ধ করতে হবে। আমদানি-রপ্তানি প্রক্রিয়া সহজ করতে হবে। ওষুধ খাতের জন্য দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে বলেও জানিয়েছেন ওষুধ শিল্প মালিকরা।
বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহ-সভাপতি আবদুল মুক্তাদির বলেন, চীন ও ভারতের যথাক্রমে ২২০ বিলিয়ন ও ৪০ বিলিয়ন ডলারের বড় বাজার রয়েছে এবং তা আরও বাড়ছে। সুতরাং অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পর ভারত এবং চীনের পক্ষে এত বিশাল চাহিদা মেটানোর যথেষ্ট সক্ষমতা নাও থাকতে পারে। সবাই ভারতের পর দ্বিতীয় বিকল্প খুঁজছে, যেখানে বাংলাদেশের দারুণ সুযোগ রয়েছে।’
ডাবলিন ভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ অ্যান্ড মার্কেটসের গবেষণার বরাত দিয়ে একজন উদ্যোক্তা জানান, ২০২৫ সালের মধ্যে রপ্তানির পরিমাণ বেড়ে ৪৫ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
ভারত ও চীন চুক্তিবদ্ধ উৎপাদনের মাধ্যমে বিশাল অঙ্কের ওষুধ রপ্তানি করলেও অভ্যন্তরীণ চাহিদা বৃদ্ধির কারণে তাদের রপ্তানির সুযোগ সীমিত হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এ সুযোগ লুফে নিতে পারে।
এছাড়া জীবন রক্ষাকারী ওষুধ ভেজাল রোধে সরকারকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের অব্যাহত তদারকি থাকতে হবে বলেও জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা। মুন্সীগঞ্জের এপিআই ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্কে উৎপাদন শুরু করতে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর ও গ্যাস সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন এ শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh