অস্থির রাজনীতি, শঙ্কায় অর্থনীতি

একেকটা জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। এই অস্থিরতা সংঘাত ও সহিংসতায় রূপ নিলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের আঘাত পড়বে। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের সার্বিক রপ্তানি বাণিজ্য, রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি। নির্বাচন কেন্দ্রিক এই অস্থিরতায় ২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর দেশের অর্থনীতি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ফলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা দেশের অর্থনীতি নিয়ে এক ধরনের শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। রাজনৈতিক অস্থিরতা রপ্তানি খাতে বড় ধরনের সঙ্কটের সৃষ্টি করবে। বিদেশি ক্রেতাদের আস্থাহীনতার সৃষ্টি হলে অর্ডার ও ক্রেতা হারাবে দেশের প্রধান রপ্তানি খাত তৈরি পোশাক। আসবে না বিদেশি বিনিয়োগকারীরা। ক্ষতিগ্রস্ত হবে দেশের অর্থনীতি ও উন্নয়ন কার্যক্রম। ইতোমধ্যে রেমিট্যান্স প্রবাহ কমছে। 

নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সম্প্রতি আবারও রাজনীতির মাঠ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। এতে পোশাক শিল্পে আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশকে আবারও নেতিবাচক পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হতে পারে বলে আশঙ্কা সবার। রাজনৈতিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হলে অন্যতম ক্ষতির মুখে পড়ে দেশের শ্রমজীবী মানুষও। তাদের কাছে রাজনীতি অনেক সময় আতঙ্কের নাম হয়ে ওঠে।

সর্বশেষ তথ্য বলছে, বিভিন্ন সুবিধা ও নানান পদক্ষেপের পরও প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স প্রবাহ আশানুরূপ হারে বাড়ছে না। চলতি আগস্টের প্রথম ১৮ দিনে প্রবাসী বাংলাদেশিরা বৈধ বা ব্যাংকিং চ্যানেলে ১০৪ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার পাঠিয়েছেন। দেশীয় মুদ্রায় যার পরিমাণ দাঁড়ায় (প্রতি ডলার ১০৯ টাকা ধরে) ১১ হাজার ৩৯৪ কোটি টাকা। চলমান ধারা অব্যাহত থাকলে আগস্ট মাস শেষে (৩১ দিনে) প্রবাসী আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৭৯ কোটি ডলার বা সাড়ে ১৯ হাজার কোটি টাকা। এই অঙ্ক আগের মাস ও আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে কম। চলতি বছরের জুলাইয়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আর আগের বছরের আগস্টে প্রবাসী আয় এসেছিল ২০৩ কোটি ডলার।

এদিকে বিভিন্ন গবেষণার তথ্য থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশের আর্থিক হিসাবে ঘাটতির সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যে বছরে বাংলাদেশে আর্থিক হিসাবে ঘাটতি ছিল, ওই সব বছরে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অনিশ্চয়তা বিদ্যমান ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও আন্দোলনের পর ১৯৯৬ সালে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই অর্থবছর বিনিয়োগের প্রবৃদ্ধি হয়েছিল প্রায় সাড়ে ১৮ শতাংশ। যা ঠিক আগের অর্থবছরে ছিল প্রায় ২২ শতাংশ। আর ২০০১ সালে নির্বাচনী বছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি অনেকটা একই রকমের। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে নির্বাচন ও তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তৎকালীন ক্ষমতাসীন দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) সঙ্গে প্রধান বিরোধী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। ওই অর্থবছর বিনিয়োগ খাতে মন্দার প্রভাবে দেশের আর্থিক হিসাবেও ১৪ কোটি ১০ লাখ ডলারের ঘাটতি হয়। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এই সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটেও ঘাটতি ছিল। আর ২০০৭-০৮ ও ২০০৮-০৯ অর্থবছরেও সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ক্ষমতা গ্রহণ, দুই নেত্রীকে কারাবন্দিকরণ ও জাতীয় নির্বাচন এসব ইস্যুতে একধরনের অনিশ্চিত পরিস্থিতির মধ্যে ছিল দেশ। এ সময় আর্থিক হিসাবে ৪৫ কোটি ৭০ লাখ ডলারের ঘাটতি হয়েছিল। অন্যান্য বিনিয়োগের মধ্যে এ সময় মধ্যম ও দীর্ঘমেয়াদি পরিশোধ, অন্যান্য নিট দীর্ঘমেয়াদি ও স্বল্পমেয়াদি ঋণ, অন্যান্য সম্পদ এবং ট্রেড ক্রেডিটেও ঘাটতি ছিল। 

আর ২০০৯-১০ অর্থবছরে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি ছিল ৫ শতাংশ, যা এর আগের অর্থবছরে ছিল সাড়ে ৭ শতাংশের ওপরে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে আওয়ামী লীগের ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই বিডিআর বিদ্রোহ এবং দেশের শেয়ারবাজারে ধসের মতো বিষয়গুলো সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতি ও বিনিয়োগ পরিস্থিতির ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতা পরিবহন খাতে যে বিনাশী-দশা সৃষ্টি করেছিল, তার তিক্ত অভিজ্ঞতার স্মৃতি এখনো সাধারণ মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায়। অসংখ্য বাস, মিনিবাস, লেগুনা, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যানসহ সব রকম যানবাহনে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ দেশের অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতি এনেছিল। 

এক গবেষণার তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক সহিংসতায় কেবল পরিবহন সেক্টরেই আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ১২ হাজার কোটি টাকার বেশি ছিল। সে সময় ১০ হাজারের বেশি যাত্রীবাহী বাস ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর মধ্যে জ্বালিয়ে দেওয়া হয় ৫ হাজার বাস, ভাঙচুর হয়েছে ৫ হাজারের মতো যাত্রীবাহী গাড়ি। ওই সময়ে দুই দফায় ৫০ দিনের বেশি সময় ধরে পরিবহন সেক্টরে চলা অরাজকতায় যানবাহন ব্যবহারকারী সাধারণ মানুষের আর্থিক ও শারীরিক ক্ষতির অর্থমূল্য নির্ধারণ করা কোনো গাণিতিক হিসেবেই সম্ভব নয়। জ্বালাও-পোড়াওয়ের বলি হওয়া অনেক ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ নিঃস্ব হয়ে পরে আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি। ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগেও পরিবহন খাতসহ অর্থনীতির অন্য খাতগুলোও গভীর শঙ্কায় পড়েছিল। চলতি ২০২৩ সালের নির্ধারিত আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে দেশের প্রধান দুই দল আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে মতবিরোধ আবারও চরম পর্যায়ে উঠেছে। রাজধানীসহ সারা দেশে শোডাউন, সংঘর্ষ, প্রাণহানির ঘটনা শুরু হয়েছে। পাল্টাপাল্টি হুমকি-ধমকিতে সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক-উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। সবার মনেই একধরনের ভীতি সঞ্চারিত হচ্ছে। আর এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও নির্বাচনী ইস্যুতে বিদেশি কূটনীতিকদের অপতৎপরতা। গ্যাস-বিদ্যুৎ-জ্বালানি ও খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি-মূল্যস্ফীতি ও টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে নতুন যোগ হওয়া ইস্যুগুলো সঙ্গত কারণেই সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। সবচেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন করছে সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষকে, যারা ‘দিন এনে দিনে খায়’ পরিস্থিতি নিয়ে দিনাতিপাত করছেন।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, অর্থনীতিবিদ ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলামের মতে, রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব অর্থনীতিতে পড়বে এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। কমে যাবে রাজনৈতিক অস্থিরতায় প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হবে। তিনি বলেন, এই অস্থিরতা রপ্তানি ও শিল্পের উৎপাদনকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। দেশের ব্যবসার ক্ষেত্রে বিনিয়োগ কমে যেতে পারে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা, বিশেষত পোশাক শিল্পের অর্ডার অন্যত্র চলে যেতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //