ব্যবসা-বাণিজ্যে ও শিল্পে পুঁজির জোগান ক্রমশ ব্যয়বহুল হচ্ছে। দেশের ব্যাংকগুলোতে সুদের হার ধীরে ধীরে বাড়তে শুরু করেছে। অন্যদিকে ডলারের দাম ক্রমশ বাড়ছে। এতে বিদেশ থেকে কাঁচামাল ও শিল্পের যন্ত্রপাতি আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, একই সঙ্গে ঋণের সুদহার বৃদ্ধি ও ডলারের বিনিময় মূল্যবৃদ্ধির কারণে উৎপাদন, বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এর ফলে উচ্চ মূল্যস্ফীতি হচ্ছে। জিনিসপত্রের বাড়তি ব্যয় মেটাতে মানুষের কষ্ট হচ্ছে। সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি অর্থনীতিকে বিপদে ফেলছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা সংক্রান্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডলার সংকটের এ সময়ে রেমিট্যান্স কমে যাচ্ছে। আগস্ট মাসে দেশে রেমিট্যান্স কম এসেছে, আগের জুলাই মাসের তুলনায় প্রায় ১৯ শতাংশ। যেমন আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে প্রায় ১৫৯ কোটি ৯৪ লাখ ৫০ হাজার মার্কিন ডলার। আর আগের মাস জুলাইয়ে এসেছিল ১৯৭ কোটি ৩১ লাখ ৫০ হাজার ডলার। পরিমাণের দিক থেকে এক মাসের ব্যবধানে দেশে রেমিট্যান্স কম এসেছে ৩৭ কোটি ৩৭ লাখ ডলার।
বাংলাদেশ দীর্ঘ সময় ধরে ডলার সংকটে ভুগছে। রপ্তানি আয়ের পাশাপাশি ডলার আয়ের অন্যতম উৎস হচ্ছে রেমিট্যান্স। প্রকট ডলার সংকটের সময় রেমিট্যান্স কমে যাওয়া অর্থনীতির জন্য বড় ধাক্কা। ফলে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভের ওপর চাপও অব্যাহত থেকে যাচ্ছে। যেমন সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে রিজার্ভ আছে ২ হাজার ৯২০ কোটি ডলার। আর আইএমএফের হিসাবপদ্ধতি বিপিএম৬ অনুযায়ী প্রকৃত রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৩০৬ কোটি ডলার। আবার চলতি সপ্তাহেই এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধ করতে সুদসহ ১১০-১২০ কোটি ডলার। ফলে আকু বিল পরিশোধের পর রিজার্ভ কমে ২ হাজার ২০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে যাবে।
ডলারের জোগান কমে যাওয়ায় দাম হুহু করে বাড়ছে। ডলারের দর কৃত্রিমভাবে অনেক দিন ৮৪ থেকে ৮৬ টাকার মধ্যে ধরে রেখেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তবে দুই বছর আগে সংকট শুরুর পর দর বেড়ে যাওয়ার চাপ তৈরি হয়। এর পরও বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে হস্তক্ষেপ করে দর কমিয়ে রাখার চেষ্টা অব্যাহত রাখে। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়। আবার বাজারে প্রচুর ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত দুই বছরে ২ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এরপরও সংকট থামানো যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন ব্যাংকগুলোর কাছে ১১০ টাকা দরে ডলার বিক্রি করছে। গত বছরের এ সময়ে বিক্রি করছিল ৯৫ টাকা দরে। খোলা বাজারে প্রতি ডলার ১১৮ থেকে ১১৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ডলার সংকটের কারণে মূলধনি যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি কমেছে। এতে করে শিল্প-বাণিজ্যে সমস্যা হচ্ছে এবং কর্মসংস্থান কমছে। ডলার বাজারে অস্থিরতার কারণে পণ্যের উৎপাদন খরচ বেড়ে মূল্যস্ফীতিতে প্রভাব ফেলছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বিদেশ থেকে ঋণ নেওয়ার খরচ বেড়েছে। এখান থেকে উত্তরণের একমাত্র উপায় ডলারের সরবরাহ বাড়াতে হবে। আর এজন্য বিনিয়োগের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে রেমিট্যান্স কমছে হুন্ডি চাহিদা বেড়ে যাওয়ার কারণে। প্রবাসীরা হুন্ডিতে পাঠালে বেশি দর পান। আবার ব্যাংকের চেয়ে দ্রুত সুবিধাভোগীর কাছে টাকা পৌঁছে দেয়। যেখানে কাজ করে সেখান থেকে অনেক দূরে গিয়ে অর্থ পাঠাতে হয়। এসব সমস্যার সমাধান করতে হবে।
এদিকে ডলারের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ প্রাপ্তির সুদহারও বাড়তে শুরু করেছে। জুলাই ও আগস্টে নতুন ঋণের ক্ষেত্রে সিক্স মান্থস মুভিং অ্যাভারেজ রেট অব ট্রেজারি বিল (স্মার্ট) সুদহার ছিল ৭ দশমিক ১০ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে এসে স্মার্ট সুদহার কিছুটা বেড়ে ৭ দশমিক ১৪ শতাংশে নির্ধারণ করা হয়েছে। এতে সেপ্টেম্বরে ব্যাংকঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১০ দশমিক ১৪ শতাংশ। কারণ ‘স্মার্ট’ রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক।
আইএমএফের পরামর্শে ব্যাংকঋণে সুদহারের ৯ শতাংশের সীমা তুলে দিয়ে জুলাইয়ে এই ‘স্মার্ট’ রেট চালু করে বাংলাদেশ ব্যাংক। জুলাইয়ের ঋণের ক্ষেত্রেও স্মার্ট সুদহার ৭ দশমিক ১০ শতাংশ ছিল। আগস্টেও ছিল অপরিবর্তিত। নিয়ম অনুযায়ী, প্রতি মাসের ১ তারিখে আগের মাসের ‘স্মার্ট’ রেট জানিয়ে দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেই নিয়ম মেনেই ৩ সেপ্টেম্বর স্মার্ট রেট জানানো হয়।
নিয়মানুযায়ী, ‘স্মার্ট’ রেটের সঙ্গে সর্বোচ্চ ৩ শতাংশ হারে মার্জিন বা সুদ যোগ করে ঋণ দিতে পারবে ব্যাংক। অন্যদিকে ৫ শতাংশ হারে মার্জিন যোগ করতে পারবে ব্যাংকবাহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান (এনবিএফআই)। এক্ষেত্রে সেপ্টেম্বরে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের সর্বোচ্চ সুদহার হবে ১২ দশমিক ১৪ শতাংশ। তবে কৃষি ঋণে স্মার্টের সঙ্গে যোগ করা যাবে ২ শতাংশ। এতে করে কৃষি ঋণে সেপ্টেম্বরে সর্বোচ্চ সুদহার হবে ৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। আর সিএমএসএমই, ব্যক্তিগত ও গাড়ি কেনার ঋণে অতিরিক্ত ১ শতাংশ তদারকি বা সুপারভিশন চার্জ নেওয়া যাবে। এর মানে এসব ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সুদ দাঁড়াবে ১১ দশমিক ১৪ শতাংশ।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2023 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh