পর্যটনে ভর করছে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার

করোনা মহামারির কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত খাতগুলোর একটি ছিল পর্যটন। সেই ধকল কাটিয়ে খাতটি আবার গতি ফিরে পেয়েছে। ফলে বৈশ্বিক ভ্রমণ ও পর্যটনশিল্পের বাণিজ্যিক পরিস্থিতি আগের অবস্থায় ফিরে আসতে শুরু করেছে। ওয়ার্ল্ড ট্রাভেল অ্যান্ড ট্যুরিজম কাউন্সিলের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে বৈশ্বিক পর্যটনের আকার ছিল ৯.২৫ ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার (প্রতি ট্রিলিয়নে এক লাখ কোটি)। করোনা বিপর্যস্ত এ খাতে ২০২০ সালে তা প্রায় অর্ধেকে নেমে আসে। বিশ্বজুড়ে জিডিপিতে এই খাতের অবদান ওই বছরে ৪৯.১ শতাংশ কমে ৪.৭ ট্রিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে ২০২২ সাল থেকেই পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করে। চলতি বছরে উল্লেখযোগ্য ঊর্ধ্বগতি লক্ষ করা গেছে। অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে পর্যটনেই ভর করছে কয়েকটি দেশ।

আগামী দিনে এ খাতে আরও অগ্রসর হওয়ার সুযোগ রয়েছে। বিশ্ব ভ্রমণ ও পর্যটন কাউন্সিল (ডব্লিউটিটিসি) আগামী ১০ বছরের পর্যটন পরিস্থিতি নিয়ে পূর্বাভাস দিয়েছে। জিডিপিতে অবদানের ভিত্তিতে মহামারির আগে বিশ্বের প্রধান পাঁচ পর্যটন অর্থনীতি ছিল যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জার্মানি, যুক্তরাজ্য ও জাপান। বর্তমান উপাত্তে জাপান টপকে গেছে যুক্তরাজ্যকে। সেরা দশের তালিকায় রয়েছে ফ্রান্স, মেক্সিকো, ইতালি, ভারত ও স্পেনের নামও।

পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩৩ সালের মধ্যে বৈশ্বিক পর্যটন অর্থনীতি ১৫.৫ ট্রিলিয়ন ডলারে দাঁড়াবে। বৈশ্বিক অর্থনীতিতে খাতটির অংশীদারত্ব বেড়ে দাঁড়াবে ১১.৫ শতাংশ। এ সময়ের মধ্যে খাতটি ২০১৯ সালের তুলনায় ৫০ শতাংশ সম্প্রসারিত হবে। পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, পর্যটন খাতে ২০৩৩ সালে ৪৩ কোটি মানুষের কর্মসংস্থান হবে। অর্থাৎ বৈশ্বিক কর্মসংস্থানের প্রতি নয়জনের একজনই জড়িত থাকবে পর্যটনের সঙ্গে। বৈশ্বিক পর্যটনের আকারই কেবল বিস্তৃত হচ্ছে না, দ্রুতগতিতে সম্প্রসারণ করছে অর্থনীতি। ডব্লিউটিটিসির প্রেসিডেন্ট জুলিয়া সিম্পসন দাবি করেছেন, বৈশ্বিক জিডিপি বার্ষিক ২.৩ শতাংশ হারে বাড়ছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদরা। কিন্তু পর্যটন খাতের ক্ষেত্রে বৃদ্ধির হার ৫.১ শতাংশ।

বর্তমানে পর্যটন অর্থনীতিতে শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্র। পর্যটন খাতের আকার পরিমাপ করার সময় দুইটি বিষয় বিবেচনায় রাখা হয়। কোনো দেশের নাগরিকরা অন্যান্য দেশে ভ্রমণ করার সময় কি পরিমাণ খরচ করছে এবং সে দেশে এসে কি পরিমাণ খরচ করছে। যুক্তরাষ্ট্রের জন্য খাতটি বার্ষিক ২ ট্রিলিয়ন ডলারের জায়গা নিয়ে আছে। কিন্তু ১০ বছরের মধ্যেই দেশটি মসনদ হারাবে চীনের কাছে। ২০৩৩ সালে চীনের পর্যটন খাত ৪ ট্রিলিয়ন ডলারে উত্তীর্ণ হবে। চীনের অর্থনীতিতে অংশীদারত্ব বেড়ে দাঁড়াবে ১৪.১ শতাংশে। বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্রের পর্যটন শিল্প ৩ ট্রিলিয়ন ডলারে উত্তীর্ণ হবে। দেশটির সার্বিক অর্থনীতিতে অংশীদারত্ব হবে ১০.১ শতাংশ। মহামারির আগে বৈশ্বিক পর্যটন খাতে চীনা নাগরিকদের অংশগ্রহণ ছিল ১৪.৩ শতাংশ। চলতি বছরের জানুয়ারিতে ভ্রমণসংশ্লিষ্ট সব ধরনের বিধিনিষেধ সরিয়ে নেওয়া হয়। 

ডব্লিউটিটিসির দাবি অনুসারে, চলতি বছরের শেষ দিকেই বৈশ্বিক পর্যটন খাত মহামারিপূর্ব পরিস্থিতিকে ছাড়িয়ে যাবে। চীনা পর্যটকদের মধ্যে পুরোদমে ভ্রমণ প্রবণতা চালু হতে পারে ২০২৪ সালের শুরুর দিকেই, যা বৈশ্বিক সূচকে উল্লেখযোগ্য উল্লম্ফন ঘটাবে। ২০৩৩ সালে বৈশ্বিক পর্যটনে চীনা নাগরিকদের অংশগ্রহণ ২২.৩ শতাংশে দাঁড়াবে বলে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে। উত্তর আমেরিকা, লাতিন আমেরিকা, ইউরোপেও পর্যটন খাতের পুনরুদ্ধার গতি ছিল শক্তিশালী। 

পর্যটন নিয়ে কাজ করা সংস্থা ভার্চুয়োসোর জরিপ অনুসারে, চলতি বছরের প্রথমার্ধে ৬ হাজার ৩৬০ কোটি ডলার লেনদেন হয়েছে পর্যটন খাতে। ২০১৯ সালের তুলনায় ৬৯ শতাংশ পুনরুদ্ধার হয়েছে খাতটিতে। ২০২৪ ও ২০২৫ সালের জন্য টিকিট ক্রয় ও হোটেল ভাড়ার প্রবণতা এর মধ্যেই খাতটি শক্তিশালী থাকার প্রমাণ মিলেছে। সাধারণত প্রাকৃতিক স্থানগুলোর দিকে যেতেই মনোযোগী হয়ে উঠছেন পর্যটকরা।

চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে পর্যটন-সম্পর্কিত ব্যবসা সম্প্রসারণ হওয়ায় ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে থাইল্যান্ডের অর্থনীতিতে। বেড়েছে বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়, ট্রাভেল এজেন্সি, ট্যুর গাইড, রেস্তোরাঁ, হোটেল, রিসোর্ট ও কনডো কোম্পানিগুলোয় বেড়েছে কার্যক্রম। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সর্বশেষ তথ্যানুসারে, পর্যটন-সম্পর্কিত নতুন ব্যবসার অনুপাত মোট ব্যবসার ৮ দশমিক ১০ শতাংশ। গত বছরের এ সময়ের তুলনায় বেড়েছে ৯৬ দশমিক ৬ শতাংশ। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যবসাগুলো ৩৮৯ শতাংশ বেড়েছে। আর ট্রাভেল এজেন্সিগুলোর ব্যবসা বেড়েছে ২৮১ শতাংশ, ট্যুর গাইড সংস্থাগুলো বেড়েছে ২২৫ শতাংশ ও রেস্তোরাঁ ব্যবসা বেড়েছে ৬৭ দশমিক ২ শতাংশ। একই সময়ে হোটেল, রিসোর্ট ও কনডো ব্যবসার পরিধি বেড়েছে ৪৯ দশমিক ১ শতাংশ। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক থোসাপোন ডানসুপুত্র বলেছেন, ‘এ প্রবৃদ্ধি আমাদের ক্রমবর্ধমান ভোক্তা আস্থা সূচকের বহিঃপ্রকাশ। ক্রমাগত বিদেশি পর্যটকদের সংখ্যা বৃদ্ধি ও থাই অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের ফলে এটি সম্ভব হয়েছে। অধিদপ্তর আশা করছে, ২০২৩ সালের প্রথমার্ধে নিবন্ধিত নতুন ব্যবসার সংখ্যা ৪২-৪৫ হাজার ও বছর শেষে ৭৫-৭৮ হাজারে পৌঁছবে।’ চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩৯ হাজার ৬৬০। বছরওয়ারি ১৭ দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে ব্যবসা, যা এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সময়ে নিবন্ধিত মূলধনের পরিমাণ ছিল থাইল্যান্ডের মুদ্রায় ৩৮ হাজার ৯০০ কোটি বাথ, যা বছরওয়ারি ৫০ শতাংশ বেশি। অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ সময়ের মধ্যে নতুন শীর্ষ তিন ব্যবসা ছিল নির্মাণ খাত, রিয়েল এস্টেট ও রেস্তোরাঁ, যার পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৭ দশমিক ৫৭, ৭ দশমিক ৩৩ ও ৪ দশমিক ৬৯ শতাংশ। মে মাসে নতুন ব্যবসা নিবন্ধনের পরিমাণ ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে পৌঁছেছে, যার সংখ্যা বছরে ২৬ শতাংশ বেড়ে ৭ হাজার ৪৩৭-এ পৌঁছেছে। এ মাসে সম্মিলিত নিবন্ধিত মূলধনের পরিমাণ ছিল ২ হাজার ৮৪০ কোটি বাথ, যা গত বছরের মে মাসের তুলনায় ৯৭ দশমিক ৯ শতাংশ বেশি। সমুদ্রসৈকত, জাতীয় উদ্যান ও বৌদ্ধ মন্দিরের জন্য বিখ্যাত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের পর্যটক বাড়ছে। চলমান বৈশ্বিক সংকট পার করতে পর্যটন খাতের ওপর নির্ভর করছে দেশটি।

মহামারি-পরবর্তী অর্থনীতির পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়ায় পর্যটন খাতকে প্রাধান্য দিচ্ছে ভুটান সরকার। সেদিকে লক্ষ রেখেই সম্প্রতি পর্যটকদের জন্য প্রাত্যহিক করের পরিমাণ অর্ধেকে নামানো হয়েছে। ডলার ব্যবহারকারী পর্যটকরা এখন থেকে টেকসই উন্নয়ন ফি (এসডিএফ) হিসেবে প্রতি রাতের জন্য ১০০ ডলার করে দেবেন, আগে যা ছিল ২০০ ডলার। এছাড়া ৬-১২ বছর বয়সী শিশুদের জন্য আরও ৫০ শতাংশ ছাড়ের ব্যবস্থা রাখা হবে। ছাড় কার্যকর থাকবে ২০২৭ সালের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত। ভুটান চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত প্রায় ৫৬ হাজার পর্যটকের গন্তব্য ছিল। ২০১৯ সালের মহামারি-পরবর্তী সময়ে পর্যটন শিল্প থেকে আয় হয়েছে ৮ কোটি ডলার। কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৫০ হাজার মানুষের। ভুটানের পর্যটন মন্ত্রণালয়ের ব্যবস্থাপনা প্রধান দোরজি ধ্রাধুল দাবি করেছেন, পূর্বাভাসের তুলনায় পর্যটকদের আগমন আনুপাতিকভাবে ভালো ছিল। তার পরও সার্বিক অর্থনীতিতে পর্যটন খাতের প্রভাবও বেশ কম। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন সিদ্ধান্তের মাধ্যমে আরও বেশি মানুষ ভুটান সফরে উৎসাহিত হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //