অস্বাস্থ্যকর গরুর মাংস ঢুকছে দেশে

অনলাইনে বিক্রি হচ্ছে হিমায়িত মহিষের মাংস। দাম ২৫০-৩০০ টাকা। ফেসবুকে এ রকম মাংস বিক্রির চটকদার বিজ্ঞাপন শোভা পাচ্ছে। তথ্য অনুসন্ধান করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে বেশ কয়েকটি ফেসবুক পেজ। এ রকমই একটি পেজ ‘আমজাদ বাজার অনলাইন শপ’। হিমায়িত মাংসের একটি ভিডিও দিয়ে তারা লিখেছে, ‘সিদ্ধ করা ফ্রোজেন মহিষের মাংস ঢাকা সিটিতে হোম ডেলিভারি এবং সারা বাংলাদেশে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠানো হয়।’ তাদের দেওয়া মোবাইল নম্বরে পরিচয় গোপন করে কথা বলে জানা যায়, আগে ভারত থেকে কাঁচা মহিষের মাংস আসত, কিন্তু সেই সুযোগ না থাকায় মাংসে লবণ ও হলুদ মিশিয়ে সিদ্ধ করে ছোট টুকরো করে আনা হচ্ছে। এগুলো দেশে এনে কোল্ড স্টোরে রেখে বিভিন্ন হোটেলে বিক্রি করছে প্রতিষ্ঠানটি। 

রাজধানীর বিভিন্ন হোটেল-রেস্তোরাঁয় বিক্রি হচ্ছে এমন মহিষের সিদ্ধ মাংস। দাম কম থাকার কারণে মালিকরা উৎসাহিত হচ্ছে এই মাংস কিনতে। অন্যদিকে, কাঁচা মাংস আমদানি করতে না পেরে একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিদ্ধ মাংস আমদানির এ কৌশল নিয়েছে। শুধু সিদ্ধ মাংস আমদানি করেই বসে নেই ব্যবসায়ীরা, এবার হিমায়িত মহিষের মাংস আমদানির অনুমতির জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছে ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (আইবিসিসিআই)। ভারত থেকে আগামী তিন মাসে ৫০ লাখ টন মহিষের মাংস আমদানির অনুমতি চেয়েছে তারা।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রক্রিয়াজাত মাংসে বেশি পরিমাণে লবণ এবং কিছু রাসায়নিক দ্রব্য মেশানো হয়। এসব কারণে শরীরে নানা রোগব্যাধি হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হিমায়িত মাংস আমদানিতে বাজারে খুব বেশি প্রভাব পড়বে না। বরং গত প্রায় অর্ধযুগ ধরে দেশে প্রাণিসম্পদ খাতে যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন হয়েছে তাতে ‘নেতিবাচক প্রভাব পড়বে’। মাংস আমদানি করে দাম কমানোতে স্থায়ী সমাধান আসবে না বলে মনে করেন প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্টরা। গরুর মাংস আমদানি হলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন প্রান্তিক খামারিরা। এতে গ্রামীণ অর্থনীতিতে ধস নামার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্য হুমকিতে পড়বে। এজন্য যৌক্তিক দর নির্ধারণের দাবি জানিয়েছেন তারা। বাংলাদেশ ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ইমরান হোসেন মনে করেন, আমদানি ছাড়াও দেশীয় গবাদিপশু দিয়েও ন্যায্যমূল্যে গরুর মাংস খাওয়ানো সম্ভব।

বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিষদের মহাপরিচালক ডা. হাসান শাহরিয়ার কবীর বলেন, ‘সঠিকভাবে প্রক্রিয়াজাত না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে মাংসের পুষ্টিগুণ নষ্ট হচ্ছে। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের সতর্ক থাকতে হবে। প্রক্রিয়াজাত মাংসে বেশি পরিমাণ লবণ এবং রাসায়নিক দ্রব্য মেশানোর কারণে এসব খেলে নানা রোগ হওয়ার ঝুঁকি থাকে।’

একটি সূত্র জানিয়েছে, গরুর মাংস ‘উদ্বৃত্ত’ থাকার পরও দেশে হিমায়িত মহিষের মাংস টনে টনে বৈধ-অবৈধ পথে আসছিল। স্বাস্থ্যঝুঁকি ও প্রান্তিক খামারিদের কথা চিন্তা করে সরকার গত বছর থেকে হিমায়িত মাংস আমদানিতে কঠোর হয়। এখন প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের অনুমতি ছাড়া মহিষের মাংস আমদানি করা যাচ্ছে না। আর অধিদপ্তর গত দেড় বছর কাউকে অনুমতিও দেয়নি। তবে সেদ্ধ মাংস আমদানি করা ছাড়াও একটি চক্র আমদানির অনুমতি নিতে নিয়মিত দৌড়ঝাঁপ করছে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তার সহায়তা ও পরামর্শ নিয়ে মাংস আমদানির অনুমতির জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোতে তদবির চলছে। ইতোমধ্যে তারা মাংস ব্যবসায়ী সমিতি ও রেস্তোরাঁ মালিক সমিতিকে দিয়ে মাংস আমদানির পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করিয়েছে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের একাধিক কর্মকর্তা বিগত কয়েক বছর ধরে হিমায়িত এই মাংস আমদানিতে নানাভাবে সহযোগিতা করছেন। বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ গত ২৫ আগস্ট এক অনুষ্ঠানে বিদেশ থেকে গরুর মাংস আমদানির পক্ষে বক্তব্য দিয়েছেন। এরপরই নড়েচড়ে বসেছে আমদানিকারকরা। বিভিন্ন জায়গায় দেনদরবার করছেন আমদানির অনুমতি পেতে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, দেশে চাহিদার চেয়ে মাংস উৎপাদন প্রায় ১১ লাখ মেট্রিক টন বেশি রয়েছে। প্রতিজনের দৈনিক ১২০ গ্রাম গোশতের চাহিদা থাকলেও বর্তমানে ১৩৭ দশমিক ৩৮ গ্রাম খাচ্ছে মানুষ। দেশের জনসংখ্যা ১৭ কোটি ৩৭ লাখ ধরে এই হিসাব দিয়েছে সরকারি এই সংস্থাটি। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর বলছে, প্রতিজনের চাহিদা ১২০ গ্রাম ধরে দেশে এই মুহূর্তে গোশতের চাহিদা (গরুসহ অন্যান্য গবাদিপশু) ৭৬ লাখ আট হাজার মেট্রিক টন। উৎপাদন হচ্ছে ৮৭ লাখ ১০ হাজার টন।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পরিচালক (উৎপাদন) ডা. এ বি এম খালেদুজ্জামান জানান, অনেক উন্নত দেশে দৈনিক জনপ্রতি ২০০ গ্রাম মাংস খায়। আমরা এখন ১২০ গ্রাম ধরছি। ২০৩০ সালে হয়তো ১৫০ গ্রাম ধরব। ২০৪১ সালে হয়তো আরও বাড়বে। ন্যূনতম ১২০ গ্রাম চাহিদা ধরে বার্ষিক উৎপাদন বেশি আছে। আমরা মাংস উৎপাদনে এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। হিমায়িত মাংস আমদানি নিরুৎসাহিত করি আমরা।

খামারিরা বলছেন, প্রসেস ফিডের ইনগ্রেডিয়েন্ট বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। আমদানিনির্ভরতা থেকে বেরিয়ে স্থানীয়ভাবে উন্নতজাতের ঘাস চাষ ও সাইলেজ তৈরির মাধ্যমে বিকল্প খাদ্যের ব্যবস্থা করতে পারলে দাম কমিয়ে আনা সম্ভব।

গ্লোবাল প্রোডাক্ট প্রাইজ নামের একটি ওয়েবসাইটের বরাত দিয়ে ডেইরি ফারমার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিডিএফএ) সভাপতি মোহাম্মদ ইমরান হোসেন বলেন, ‘দাম বৃদ্ধির দিক থেকে ৭৯টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৪তম। দেশের বাজারে গরুর গোশতের সঙ্কট নেই। তবে গত এক বছরে পশুখাদ্যের দাম বেড়েছে ৪৫ শতাংশ। এছাড়া সার্বিক উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি ও বেশি মাংস উৎপাদনকারী উন্নত প্রজাতির গরু না থাকায় বাজারে গরুর মাংসের দাম কমছে না।’ তবে খামারিরা গত জুলাই থেকে বাজারের চেয়ে ৫০ টাকা কমে মাংস বিক্রি করছেন বলেও জানান। তিনি আরও বলেন, ‘খামারিদের সঙ্গে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যে বৈঠক হয়েছিল তারপর থেকে খামারিরা বাজারের চেয়ে ৫০ টাকা কমে মাংস বিক্রি করছে। বিডিএফএ-এর পক্ষ থেকে আমরা ঢাকার বড় মাংস বিক্রেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছি, তারাও ৭০০ টাকায় মাংস বিক্রি করতে চান। সেজন্য তারা সরকারকে মূল্য নির্ধারণ করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন। আমি মূল্য নির্ধারণের দাবি জানিয়ে সংশ্লিষ্ট সব মন্ত্রণালয় ও দপ্তরে গিয়েছি। কেউ গরুর মাংসের মূল্য নির্ধারণের বিষয়ে এখনো উদ্যোগ নেয়নি।’

বাংলাদেশে এর আগে কখনোই কোনো ব্যবসায়ী দাম কমিয়ে মূল্য নির্ধারণের দাবি জানায়নি। তিনি বলেন, ‘চাহিদা কম থাকায় খামার পর্যায়ে গরুর দাম এখন অনেক কম।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //