বিশ্ববাজারে গমের দাম কমলেও দেশে কেন নয়

কোভিড-১৯ অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে গমের দামে রেকর্ড গড়েছিল। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় শস্যচুক্তির কল্যাণে বছরখানেকের মধ্যেই বিশ্ববাজারে গমের দাম নেমেছে অর্ধেকে। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে গত কয়েক মাসে দাম আরও কমলেও বাংলাদেশে তার কোনো প্রভাব দেখা যায়নি। বরং ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে আটা ও রুটির দাম। এক বছর আগেও এক কেজি আটা ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় বিক্রি হলেও এখন তা ৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। 

ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের গবেষণা প্রবন্ধে বলা হয়েছে, দুই দশকে বাংলাদেশে গমের চাহিদা প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। বর্তমানে বার্ষিক গমের চাহিদা ৭৫ লাখ টন। এর বিপরীতে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ১১ লাখ টন। তাই অভ্যন্তরীণ চাহিদার প্রায় ৮৫ শতাংশ গম আমদানির ওপর নির্ভরশীল। কানাডা, অস্ট্রেলিয়া কিংবা আর্জেন্টিনা থেকে বর্তমানে গম আমদানি হলেও এক সময় প্রধান বাজার ছিল রাশিয়া-ইউক্রেনসহ পূর্ব ইউরোপের বিভিন্ন দেশ। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর ওই অঞ্চল থেকে সস্তায় বা কম মূল্যের গম আমদানি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কমে যায়। কয়েক দফায় বর্ধিত করার পর সর্বশেষ জুলাইয়ে রাশিয়া কৃষ্ণসাগর শস্যচুক্তি থেকে সরে এলে ফের অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে বাংলাদেশের গম আমদানি। বাড়তে শুরু করে আটা-ময়দার দাম। বিকল্প হিসেবে ভারত থেকে আমদানি বাড়ানো হয়। তবে সম্প্রতি ভারতসহ কয়েকটি দেশ গম রপ্তানিতে নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় বিশ্ববাজারে দাম বৃদ্ধির প্রভাব পড়ে বাংলাদেশের বাজারেও।

এখন গমের বৈশ্বিক বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে আসছে। গেল আগস্টের হিসাবে গমের বৈশ্বিক দাম নেমে এসেছে ২০২১ সালের সমপর্যায়ে। বিশ্বব্যাংকের মাসভিত্তিক খাদ্যশস্য প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০২১ সালে গমের টনপ্রতি গড় দাম ছিল ৩১৫ ডলার ২০ সেন্ট। ২০২২ সালের এপ্রিল-জুনে তা ৪৯২ ডলার ৪০ সেন্টে উঠে যায়। যদিও চলতি বছরের আগস্টে একই মানের অর্থাৎ ইউএস (এইচআরডব্লিউ) গমের বুকিং দর নেমে এসেছে ৩১৫ ডলার ৮০ সেন্টে। অপরদিকে ইউএস (এসআরডব্লিউ) গমের বুকিং দর কমে ২৩০ ডলার ৮০ সেন্টে নেমেছে, যা কিনা ২০২১ সালের চেয়েও কম। 

বিশ্ববাজারে দাম কমলেও বাংলাদেশে গম, আটা ও ময়দার দাম কমেনি। গম থেকে তৈরি খাদ্যপণ্য কিংবা পশুখাদ্যের দামও ঊর্ধ্বমুখী অবস্থায় রয়েছে। দেশে ভোগ্যপণ্যের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজার খাতুনগঞ্জে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী সত্ত্বেও সম্প্রতি দাম বেড়েছে গমের। সেপ্টেম্বরের শুরুতে গমের দাম মণপ্রতি (৩৭ দশমিক ৩২ কেজি) অন্তত ৫০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। যদিও চলতি সপ্তাহে দাম ২০ থেকে ৩০ টাকা কমে লেনদেন হচ্ছে। বিশ্ববাজারে নিম্নমুখী দাম, দেশে ডলার সংকটসহ ব্যাংকিং খাতের অস্থিরতায় পণ্যবাজারে লেনদেন কমে গেছে বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তাই বিক্রি কমলেও বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে গমের দাম আশানুরূপ কমছে না। এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা বলছেন, দেশে সরকারিভাবে আমদানি ছাড়াও সীমিতসংখ্যক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে গম আমদানি হওয়ায় দাম সমন্বয়ে ধীরগতি। 

জানতে চাইলে বিএসএম গ্রুপের চেয়ারম্যান আবুল বশর চৌধুরী বলেন, ‘বিশ্ববাজারে খাদ্যশস্যের দাম কমেছে এটা ঠিক। বুকিং কমলে দেশের বাজারেও এর প্রভাব পড়ে। কিন্তু ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া, ডলার সংকটের কারণে পর্যাপ্ত আমদানি সম্ভব হচ্ছে না। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকটের কারণে এ অঞ্চল থেকে গমসহ বিভিন্ন খাদ্যশস্য আমদানিতে সময় বেড়ে গেছে। যার কারণে আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়া, ডলারের মূল্য বৃদ্ধিজনিত কারণে কয়েক বছর আগের অবস্থানে গমের দাম ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়।’ তবে ধীরে হলেও দেশে দাম সহনীয় পর্যায়ে নেমে আসবে বলে আশা করছেন তিনি। 

বিশ্ববাজারে কমলেও দেশে না কমানোর বিষয়টা দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন কনজ্যুমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহ-সভাপতি এসএম নাজের হোসাইন। তিনি বলেন, ‘এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে না, যাতে ভোক্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।’ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে দেশে গম আমদানি হয়েছে ৫৮ দশমিক ৮১ লাখ টন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৫৬ দশমিক ২৯ লাখ টন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৪ দশমিক ৩৪ লাখ টন, ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে ৫৪ দশমিক ৪৩ লাখ টন। তবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর দেশে গমের আমদানি নেমে আসে ৪৫ লাখ টনে। তবে রাশিয়া-ইউক্রেনসহ ত্রিপক্ষীয় শস্যচুক্তি ও ভারত থেকে আমদানি বাড়ানোয় দেশে গমের চালান কিছুটা বেড়ে ৫১ লাখ টনে উন্নীত হয়েছিল। সম্প্রতি শস্যচুক্তি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পাশাপাশি কৃষ্ণসাগর দিয়ে চলাচলকারী শস্যবাহী জাহাজে রাশিয়ার গুলিবর্ষণের ঘটনায় পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো থেকে গমের আমদানি স্বাভাবিক হচ্ছে না। ফলে বাংলাদেশের গমের সংকট শিগগির কাটছে না বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।

খাতুনগঞ্জের মেসার্স ইলিয়াস এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবদুর রাজ্জাক গমের বাজার সম্পর্কে বলেন, ‘গম আমদানির সঙ্গে মূলত দেশের শীর্ষস্থানীয় শিল্প গ্রুপগুলো যুক্ত। এ কারণে বাজারের নিয়ন্ত্রণ সাধারণ ব্যবসায়ীদের হাতে নেই। সরকারিভাবেও গমের বাজার নিয়ে তদারকি না থাকায় আমদানিকারকদের নির্ধারিত দামেই গম বিক্রি হয়। সরকারের উচিত বিশ্ববাজারের সঙ্গে সমন্বয় করে দাম নির্ধারণ কিংবা বাজার তদারকির মাধ্যমে নিত্যপণ্যটির দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা।’ 

মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার তসলিম শাহরিয়ার বলেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্ববাজারে সরবরাহ বিঘ্নিত হওয়ায় এবং রপ্তানি নিষেধাজ্ঞার কারণে জুলাই-নভেম্বরে গম আমদানিতে অনেক সমস্যা হয়েছে। এলসি সমস্যাও আমদানিতে প্রভাব ফেলেছে। তবে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে গম আমদানি বেড়েছে। তাই আটার দাম কিছুটা কমেছে। সব কোম্পানি ঠিকভাবে আমদানি করতে পারলে দাম ১০-১৫ শতাংশ কমে যাবে।’

সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান বলেন, ‘দেশের বাজার ব্যবস্থা এতই দুর্বল যে সুযোগ পেলেই ব্যবসায়ীরা বাড়তি লাভ করতে চায়। এ কারণে অস্থিতিশীলতার একটা শঙ্কা তৈরি হচ্ছে। আমরা এমন উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে রয়েছি যে, সবাই চাচ্ছি কীভাবে মূল্যস্ফীতি কমানো যায়। কিন্তু এখন উল্টো মূল্যস্ফীতি বাড়ার একটি শঙ্কা তৈরি হয়েছে।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //