কৃষিতে সঙ্কুচিত হচ্ছে কাজের সুযোগ

তিন মাসে কমেছে ৮ লাখ শ্রমিক

দেশের অর্থনীতিতে প্রধান খাত কৃষি। চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশে কৃষি খাতে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত শ্রমিক ছিল ৩ কোটি ১৯ লাখ ৪০ হাজার। কিন্তু মাত্র তিন মাসের ব্যবধানে দ্বিতীয় প্রান্তিকে (এপ্রিল-জুন) এ খাতের শ্রমিক কমে দাঁড়িয়েছে ৩ কোটি ১১ লাখ ৫০ হাজার। সে হিসাবে তিন মাসের ব্যবধানে এ খাত থেকে কাজ হারিয়েছেন ৭ লাখ ৯০ হাজার বা প্রায় ৮ লাখ কৃষিশ্রমিক। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো প্রকাশিত ত্রৈমাসিক শ্রমশক্তি জরিপে (এপ্রিল-জুন) এ তথ্য উঠে এসেছে। তবে এ শ্রমিকরা জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা। কেউ কেউ আবার শ্রমিক হিসেবে অভিবাসী হয়েছেন মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোয়। 

দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করে আসছে শিল্প খাত। এ খাতেও বিভিন্ন সংকটের কারণে কাজ হারানো মানুষের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনক হারে। সর্বশেষ এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত সময়ে শিল্প খাতে বিভিন্ন কাজে নিয়োজিত শ্রমিকের সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ২১ লাখ ২০ হাজার। অথচ তিন মাস আগেও এসব খাতে একই পেশায় নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ২২ লাখ ৫০ হাজার। তিন মাসের ব্যবধানে শিল্প খাত থেকে শ্রমিক কমেছে ১ লাখ ৩০ হাজার। গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকট, ডলার সংকটের কারণে ঋণপত্র খুলতে না পারার কারণেই শিল্প খাতের শ্রমজীবীদের ওপর প্রভাব পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। 

শুধু সরকারি হিসাবেই দেখা যাচ্ছে, গত তিন মাসের ব্যবধানে দেশের বিভিন্ন খাতে নিয়োজিত জনগোষ্ঠীর সংখ্যা কমেছে ৩ লাখ ৯০ হাজার বা প্রায় চার লাখ। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, শিল্প খাতে গ্যাসের প্রেশার কম থাকা ও বিদ্যুৎ না থাকাসহ বিভিন্ন কারণে অনেক শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। অন্যদিকে তীব্র গরম ও আমদানি নির্ভরশীলতার কারণে কৃষি খাতের শ্রমিকরা কাজ হারিয়েছে।

এর কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের  কৃষি ব্যবসা ও বিপণন বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, ‘কৃষি শ্রমিক ধারাবাহিকভাবে সবসময়ই কমছে। করোনার পর অনেকে চাকরি হারিয়ে কৃষিতে এসেছিলেন। আবার এখন তারা কৃষি ছেড়ে বিদেশে বা বিভিন্ন পেশায় যুক্ত হচ্ছেন। যান্ত্রিকীকরণের কারণেও কৃষি শ্রমিক কমতে পারে।’

যান্ত্রিকীকরণের কারণে কৃষিতে শ্রমিক কমছে বলে মনে করছেন এসিআই এগ্রোলিংক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ড. ফা হ আনসারীও। তিনি বলেন, ‘তিন-চার বছর আগে সব ধান কাটত শ্রমিকরা। আর এখন ১২ শতাংশ জমিতে ধান কাটা হয় যন্ত্রের মাধ্যমে। আগে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ হতো মাত্র ৩০ শতাংশ জমি। এখন তা ৪০ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। যান্ত্রিকীকরণের কারণে কৃষিতে শ্রমঘনত্ব কমছে।’ 

বেকারত্বের হিসাবটি আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সংজ্ঞা অনুযায়ী করে বিবিএস। আইএলওর সংজ্ঞা অনুযায়ী, গত ৩০ দিন ধরে কাজপ্রত্যাশী একজন মানুষ যদি সর্বশেষ সাত দিনে মজুরির বিনিময়ে এক ঘণ্টাও কাজ করার সুযোগ না পান, তাহলে তাকে বেকার হিসেবে ধরা হবে। এ জরিপের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের প্রথম প্রান্তিকের তুলনায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে বেকার কমেছে ৯০ হাজার। বর্তমানে দেশে বেকার জনগোষ্ঠী ২৫ লাখ। আগের প্রান্তিকে এ সংখ্যা ছিল ২৫ লাখ ৯০ হাজার। এপ্রিল-জুন মাসে আগের প্রান্তিকের চেয়ে বেকারের হার কিছুটা কমে হয়েছে ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ। এর আগের প্রান্তিকে এ হার ছিল ৩ দশমিক ৫১ শতাংশ। বিবিএস বলছে, এখন বেকারদের মধ্যে ১৬ লাখ ৭০ হাজার পুরুষ ও নারী মাত্র ৮ লাখ ৩০ হাজার।

মাঠপর্যায়ে পরিচালিত জরিপের ভিত্তিতে প্রতি প্রান্তিকে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করছে বিবিএস। চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিক চলাকালে জেলা পর্যায়ের ৩০ হাজার ৮১৬টি খানা থেকে প্রশ্নপত্র ব্যবহার করে এ জরিপের তথ্য সংগ্রহ করা হয় বলে জানান বিবিএসের ইন্ডাস্ট্রি অ্যান্ড লেবার উইংয়ের উপপরিচালক আজিজা রহমান। প্রতিবেদনে কর্মসংস্থান হ্রাসের পরিসংখ্যান পাওয়া গেলেও এর পেছনের কারণগুলো অবশ্য উঠে আসেনি। এ বিষয়ে সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বক্তব্য হলো, বিবিএস শুধু পরিসংখ্যানের মাধ্যমে মাঠের চিত্র তুলে ধরে। এর পেছনের কারণ ব্যাখ্যা করতে পারবেন শুধু গবেষকরা। 

তিন মাসের ব্যবধানে শ্রমবাজারে প্রায় চার লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ার কারণ জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদদের ভাষ্য, বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি ও ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ চাপে থাকায় দ্বিতীয় প্রান্তিকে কর্মসংস্থান হ্রাস পেয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘শিল্প খাতে শ্রমিক কমে যাওয়া চিন্তার বিষয়। আমদানি ও বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় উৎপাদন কমে এসেছে। আর বর্তমান পরিস্থিতিতে অর্থনীতি চলছে তুলনামূলক কম সক্ষমতা নিয়ে। এছাড়া কৃষি খাতে শ্রমিক কমে যাওয়ার পেছনে ফসলের মৌসুম সংক্রান্ত বিষয়গুলোরও প্রভাব থাকতে পারে।’ 

জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় স্বল্প আয়ের শ্রমজীবীদের জন্য নগরাঞ্চলে টিকে থাকা মুশকিল হয়ে পড়েছে। তাদের অনেকে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। এমনই একজন নেত্রকোনার মাসুদ হোসেন। রাজধানীর একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন তিনি। জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ায় সম্প্রতি চাকরি ছেড়ে নিজ গ্রামে ফিরে গেছেন। জানতে চাইলে মাসুদ বলেন, ‘সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আয়ের চেয়ে ব্যয় বেশি হলে এ শহরে কীভাবে টিকে থাকব? আমার তো আর বেতন বাড়েনি। কিন্তু খরচ কয়েক গুণ বেড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে গ্রামে চলে এসেছি।’ অনেককে আবার জেলা শহর থেকেও গ্রামমুখী হতে দেখা যাচ্ছে। 

শ্রমিক নেতাদের দাবি, মূল্যস্ফীতির চাপ শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। শহরে থেকে যদি তারা তাদের জীবন ধারণের ব্যয় নির্বাহ না করতে পারেন তাহলে কেন তারা শহরে থাকবেন? বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ক্রেতাদের কাছ থেকে ক্রয়াদেশ কমে গেছে। এর ফলে অনেক শ্রমিক কাজ হারাচ্ছে। আবার কর্মসংস্থান কমায় জীবনযাত্রা খারাপ হয়ে পারিবারিকভাবেও সমস্যায় পড়ছেন অনেক শ্রমিক। তাই অনেকে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। আবার অনেকেই পেশা বদলাতে বাধ্য হচ্ছেন। 

শিল্পোদ্যোক্তারাও বলছেন, শ্রমিকের সংখ্যা এখন কমছে। অনেক ক্ষেত্রে প্রয়োজনমাফিক শ্রমিক পাওয়াও যাচ্ছে না। কোনো কোনো উদ্যোক্তা এখন অটোমেশনের মাধ্যমে শ্রমিকের ঘাটতি পূরণের চেষ্টা চালাচ্ছেন। পোশাক খাতের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বিজিএমইএর পরিচালক মো. খসরু চৌধুরী বলেন, ‘নতুন প্রজন্ম এখন আর পোশাক খাতে আসছে না। আগে গেটের কাছে অনেক শ্রমিক দেখা গেলেও এখন সে ভিড় কমে গেছে। তাই শ্রমিক সংকটের বিষয়টি আধুনিক যন্ত্রপাতির মাধ্যমে কাটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।’

বছরের প্রথম প্রান্তিকে শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণের হার ছিল ৬১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। এপ্রিল-জুন প্রান্তিকে তা নেমে এসেছে ৬০ দশমিক ৭৪ শতাংশে। তবে সেবা খাতে শ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে ৫ লাখ। অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কৃষি থেকে যারা বের হয়ে আসছেন তাদের জন্য শিল্প খাতে কর্মসংস্থান করতে পারছি না, এটি বড় চ্যালেঞ্জ। ফলে এক সময় তারা বেকার হয়ে পড়ছেন। সার্বিক কর্মসংস্থান সংকুচিত করে আনার ক্ষেত্রে রিজার্ভ ধরে রাখার নীতি বড় ধরনের প্রভাব ফেলছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। কেননা রিজার্ভ সংকট প্রবৃদ্ধির প্রক্রিয়াকে সংকুচিত করে ফেলেছে। এর প্রভাবে কর্মসংস্থান কমছে। আর এটি দারিদ্র্যের বিষয়টিকেও আরও গভীর করছে। 

এ বিষয়ে গবেষণা প্রতিষ্ঠান পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টারের (পিপিআরসি) নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান বলেন, ‘সরকার বহুমুখী সংকট মোকাবিলায় মূলত দুটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে। প্রথমত রিজার্ভ ধরে রাখতে প্রবৃদ্ধিকে সংকুচিত করা। দ্বিতীয়ত রাজনৈতিক কারণে প্রকল্প ব্যয় চলমান রাখা, যেমন ডিসিদের গাড়ি দেওয়া। সেখানে ব্যয় কমছে না। এটিকে স্বল্পমেয়াদি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির নীতি কৌশল ছাড়া আর কিছু বলা যায় না। এখানে কর্মসংস্থান ধরে রাখার বিষয়টিকে সে অর্থে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। এ অবস্থায় সরকারের সার্বিক নীতিকৌশল পুনরায় পর্যালোচনা করে দেখা জরুরি।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //