নতুন খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন-মজুদ আইন বাস্তবায়নের উদ্যোগ

হরহামেশাই নানান খাদ্যদ্রব্য মজুদ ও সরবরাহে কারসাজি করছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তাই কোনো কারণ ছাড়াই হু-হু করে বাড়ছে এসব পণ্যের দাম। ভুগছেন সাধারণ ক্রেতা। কিন্তু কঠিন শাস্তির বিধান রেখে ‘খাদ্যদ্রব্যের উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩’ করেছে সরকার। এ আইন অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তি সরকার নির্ধারিত পরিমাণের বেশি খাদ্যদ্রব্য মজুদ করলে বা মজুদ সংক্রান্ত সরকারের কোনো নির্দেশনা অমান্য করলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড এবং অর্থদণ্ডে দণ্ডিত হবেন। কিন্তু আইন করার তিন মাস পার হয়ে গেলেও অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে এ আইনের বাস্তবায়ন নেই।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইন হলেও বিধিমালা না থাকায় বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে নানা জটিলতা দেখা দেয়, সেজন্য আইনের অধীনে বিধিমালা করার কাজ চলমান। একই সঙ্গে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে যাতে অসাধু ব্যবসায়ীদের শাস্তি দেওয়া যায় সেজন্য খাদ্যদ্রব্য আইনের কয়েকটি ধারা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে যুক্ত করা হয়েছে। এ বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, আইনটি বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। বিধিমালার খসড়া করা হয়েছে। খসড়াটির বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের মতামত নেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে শাস্তি দিতে আইনের কয়েকটি ধারা মোবাইল কোর্ট আইনের তফসিলে যুক্ত করা হয়েছে।

খাদ্যদ্রব্য আইনের ৪টি ধারার শাস্তি মোবাইল কোর্টে
‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) আইন, ২০২৩’-এর চারটি ধারার শাস্তি ভ্রাম্যমাণ আদালতের (মোবাইল কোর্ট) মাধ্যমে দেওয়া হবে। এজন্য নতুন খাদ্যদ্রব্য আইনের ৩, ৫, ৬ ও ৮ ধারা ‘মোবাইল কোর্ট আইন, ২০০৯’-এর তফসিলে যুক্ত করে সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।

ধারা-৩-এ ‘উৎপাদন বা বিপণন সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড’ উপশিরোনামে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি- ক. কোনো অনুমোদিত জাতের খাদ্যশস্য হইতে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যকে উক্তরূপ জাতের উপজাত পণ্য হিসেবে উল্লেখ না করিয়া ভিন্ন বা কাল্পনিক নামে বিপণন করেন; খ. খাদ্যদ্রব্যের মধ্য হইতে কোনো স্বাভাবিক উপাদানকে সম্পূর্ণ বা আংশিকভাবে অপসারণ করিয়া বা পরিবর্তন করিয়া উৎপাদন করেন বা বিপণন করেন; গ. খাদ্যদ্রব্যের সহিত মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কৃত্রিম উপাদান মিশ্রণ করিয়া উৎপাদন করেন বা বিপণন করেন; ঘ. খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক ইস্যুকৃত খাদ্যশস্য ব্যবসার লাইসেন্স ব্যতীত বা মেয়াদোত্তীর্ণ লাইসেন্স দ্বারা কোনো ব্যবসা পরিচালনা বা লাইসেন্সে উল্লিখিত পরিমাণের অধিক পরিমাণ খাদ্যশস্য বিপণন করেন; তাহা হইলে, উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনূর্ধ্ব ২ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

ধারা-৫-এ (সরবরাহ সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড) বলা   হয়েছে- কোনো ব্যক্তি- ক. পুরাতন বা মেয়াদ উত্তীর্ণ খাদ্যদ্রব্য পলিশিং বা অন্য কোনো খাদ্যদ্রব্যের সহিত মিশ্রণ করিয়া; খ. সরকার কর্তৃক খাদ্যদ্রব্য সংগ্রহকালে সরকারি গুদামে রক্ষিত খাদ্যদ্রব্য বৈধ বা অবৈধভাবে সংগ্রহ করিয়া; গ. দেশে উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের পরিবর্তে আমদানিকৃত খাদ্যদ্রব্য; ঘ. সরকারি গুদামের পুরাতন বা বিতরণকৃত সিল বা বিতরণ করা হইয়াছে এইরূপ চিহ্নযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ; বা ঙ. আংশিক বা সম্পূর্ণরূপে খাদ্যদ্রব্যের পরিমাণগত বা গুণগত পরিবর্তন করিয়া অথবা অন্য কোনো অসৎ উদ্দেশ্যে; সরকারি গুদামে সরবরাহ করিলে, উহা হইবে একটি অপরাধ এবং তজ্জন্য তিনি অনূর্ধ্ব ২ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

ধারা-৬-এ (বিতরণ, স্থানান্তর, ক্রয় বা বিক্রয় সংক্রান্ত অপরাধ ও দণ্ড) বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তি খাদ্য অধিদপ্তর কর্তৃক প্রদত্ত বিতরণকৃত সিল বা বিতরণ করা হইয়াছে এইরূপ চিহ্নযুক্ত সিল ব্যতীত সরকারি গুদামের খাদ্যদ্রব্য ভর্তি বস্তা বা ব্যাগ বিতরণ, স্থানান্তর, ক্রয় বা বিক্রয় করিলে, উহা হইবে একটি অপরাধ এবং এজন্য তিনি সর্বোচ্চ ২ বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

ধারা-৮-এ (কর্তব্য পালনে বিরত থাকা বা কর্তব্য পালনে বাধা প্রদানের দণ্ড) বলা হয়েছে, এই আইনের অধীন শ্রমিক, কর্মচারী, ঠিকাদার, মিল মালিক, ডিলার বা সরকার কর্তৃক নিযুক্ত কোনো ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ, বিপণন বা এতদ্‌সংক্রান্ত কোনো কর্মসম্পাদনে নিজে বিরত থাকিলে বা সম্পৃক্ত কোনো ব্যক্তিকে তাহার কর্তব্য পালনে বিরত থাকিতে বাধ্য বা প্ররোচিত করিলে বা তাহাদের মধ্যে অসন্তোষ বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করিলে, উহা হইবে একটি অপরাধ। এজন্য তিনি সর্বোচ্চ এক বছর কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হইবেন।

যা আছে খসড়া বিধিমালায়
‘খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন (ক্ষতিকর কার্যক্রম প্রতিরোধ) বিধিমালার, ২০২৩’-এর খসড়া করেছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।

খসড়ায় বলা হয়েছে, অনুমোদিত জাতের খাদ্যশস্য থেকে উপজাত হিসেবে যে খাদ্যদ্রব্য পাওয়া যাবে তাকে ওই জাতের উপজাত হিসেবে নামকরণ করতে হবে। ভিন্ন কোনো নামে নামকরণ হলে, যেমন-বিআর-২৮ ধান থেকে মিলিংয়ের পর প্রাপ্ত চালের নাম বিআর-২৮ চাল হিসেবে নামকরণ করতে হবে। অন্য নামে যেমন- মিনিকেট, কাজল লতা, আশালতা, রাঁধুনী বা অন্য নামকরণে বাজারজাত করা যাবে না।

খাদ্যদ্রব্যের বিদ্যমান বিভিন্ন উপকরণের বর্ণ, গন্ধ, আকার, আকৃতি, গঠন ইত্যাদির প্রাকৃতিক উপস্থিতি ও মানব স্বাস্থ্যের প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান নিশ্চিত করতে হবে।

খাদ্যদ্রব্যের সঙ্গে মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর (প্রাকৃতিক বা মানব সৃষ্ট) উপাদান যা খাদ্যদ্রব্যের স্বাভাবিক গুণাবলিকে ব্যাহত করে যেমন- বিভিন্ন ধরনের প্রিজারভেটিভ, ফরমালিন, কার্বাইড, ইথিলিন প্রভৃতি (ক্ষেত্রবিশেষে অনুমতি মাত্রার অতিরিক্ত ব্যবহার করলে) এবং বিভিন্ন ধরনের কৃত্রিম রং, পাথর, বালি ইত্যাদি মিশ্রণ করলেও শাস্তির মুখে পড়তে হবে।

কোনো ব্যক্তি খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন, মজুদ, স্থানান্তর, পরিবহন, সরবরাহ, বিতরণ ও বিপণন সম্পর্কিত কোনো গুজব মিথ্যা তথ্য বা বিবৃতি প্রিন্ট বা ইলেকট্রনিক মিডিয়া, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তৈরি, মুদ্রণ, প্রকাশ, প্রচার বা বিতরণ করলে তা অপরাধ বলে বিবেচিত হবে।

খসড়া বিধিমালায় উৎপাদন বা বিপণন, সরবরাহ সংক্রান্ত, বিতরণ স্থানান্তর ক্রয় বা বিক্রয়, বিভ্রান্তি সৃষ্টি, কোম্পানি কর্তৃক অপরাধ সংগঠন, প্রবেশ ও পরিদর্শন, জব্দকৃত খাদ্যদ্রব্য নিষ্পত্তিকরণ এবং অপরাধের আমলযোগ্যতা, জামিন যোগ্যতা ও জামিন অযোগ্যতা বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //