শ্রমিক ঠকাচ্ছে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান

শ্রমিকদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করার অভিযোগ উঠেছে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে। এমনকি তারা সরকারি নিয়মকানুনেরও তোয়াক্কা করে না। নিয়ম অনুযায়ী কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই) থেকে লাইসেন্স নেয় না সরকারি বিভিন্ন সংস্থা ও প্রতিষ্ঠানে জনবল সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো (আউটসোর্সিং)। লাইসেন্স নিলেও অনেকে নবায়ন করছে না।

শ্রম বিধিমালা অনুযায়ী ‘কর্মী সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল’ গঠনের বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা গঠন করছে না আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলো। এমনকি নবায়নের সময় দাখিল করা কাগজপত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করা শ্রমিকের সঠিক সংখ্যা দিচ্ছে না। এ সব নানা অনিয়মের মাধ্যমে শ্রমিকদের ঠকাচ্ছে আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান। শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণে ইতোমধ্যে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী-প্রতিন্ত্রীদের কাছে চিঠিও দিয়েছেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মন্নুজান সুফিয়ান।

লাইসেন্স গ্রহণ, লাইসেন্স হালনাগাদ পর্যন্ত নবায়ন ছাড়া কোনো কাজ না দেওয়ার জন্য মন্ত্রণালয় ও অধীন দপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগত সহযোগিতা ও সহানুভূতি চেয়ে বিভিন্ন মন্ত্রীর কাছে ওই চিঠি পাঠিয়েছিলেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী। আউটসোর্সিং ব্যবস্থায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হয়। পাশাপাশি নিরাপত্তাকর্মী, ক্লিনার ও গাড়িচালকসহ বিভিন্ন ধরনের কর্মী সরবরাহ করে এ ব্যবসা-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী চিঠিতে লিখেছিলেন, “জনবল সরবরাহকারী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানসমূহের (আউটসোর্সিং) ‘বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা, ২০১৫’-এর বিধি-৭ মোতাবেক কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইসেন্স গ্রহণ করা বাধ্যতামূলক। ২০১৫ সালে এ বিধিমালা প্রণয়নের পর থেকে বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান অদ্যাবধি অত্র দপ্তর থেকে ঠিকাদার সংস্থার নামে লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন। এখনো অনেক প্রতিষ্ঠান ঠিকাদার সংস্থার নামে ডিআইএফই হতে লাইসেন্স গ্রহণ না করে বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি/আধা-সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত/বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে জনবল/কর্মী সরবরাহ করে যাচ্ছেন। এ ছাড়াও যে সব প্রতিষ্ঠান ডিআইএফই হতে লাইসেন্স গ্রহণ করেছেন তারা প্রতিবছর এ দপ্তর থেকে নেওয়া লাইসেন্স নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নবায়ন করছেন না। উপরন্তু কিছু ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান দু-তিন বছর পর নবায়নের আবেদন করলেও অত্যন্ত স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক তারা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহ করেছে বলে দাখিলকৃত কাগজপত্রে উল্লেখ করে যা প্রকৃত তথ্য নয়।”

এতে আরও বলা হয়, শ্রম বিধিমালার ১৭(১) মোতাবেক ‘প্রত্যেক ঠিকাদার সংস্থাকে লাইসেন্স প্রাপ্তির ছয় মাসের মধ্যে উক্ত সংস্থার নাম সম্বলিত ‘কর্মী সামাজিক নিরাপত্তা তহবিল’ নামে যে কোনো তফসিলি ব্যাংকে একটি ব্যাংক হিসাব শুরু করতে হয় এবং বাংলাদেশ শ্রম বিধিমালা ১৭(২) মোতাবেক ‘ব্যাংক হিসাবে ঠিকাদার সংস্থায় নিয়োগকৃত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকৃত প্রত্যেক কর্মীর বিপরীতে কর্মীর প্রতি সম্পূর্ণ বছরের চাকরির জন্য ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রাপ্য এক মাসের মূল মজুরির সমপরিমাণ অর্থ বা ধারা ২(১০) অনুসারে গ্র্যাচুইটি (যদি প্রযোজ্য হয়) হিসাবে জমা রাখতে হবে।

এ সকল প্রতিষ্ঠানের বছর বছর লাইসেন্স নবায়ন না করার মূল কারণ হলো ‘কর্মী সামাজিক নিরাপত্তা তহবিলে’ টাকা জমাদান না করা। যা কর্মীর চাকরি যে কোনো ধরনের অবসানে আইন অনুযায়ী ক্ষতিপূরণ বা গ্রাচুইটির অর্থ পরিশোধের অংশ হিসাবে কর্মীকে সরাসরি চেকের মাধ্যমে পরিশোধ করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রায়শই যে সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন তা হলো, এ সব ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন সরকারি/বেসরকারি দপ্তরে প্রকৃতপক্ষে কতজন জনবল সরবরাহ করছেন তা নির্ণয় করা সম্ভব হচ্ছে না। নবায়নের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলো দাখিল করা কাগজপত্রে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সরবরাহকৃত শ্রমিকের সঠিক সংখ্যা দিচ্ছে না। তবে বিভিন্ন সেবাগ্রহীতা মারফত জানা যায় যে, তারা যে তথ্য দিচ্ছেন প্রকৃত পক্ষে তাদের সরবরাহকৃত শ্রমিকের সংখ্যা আরও বেশি। ফলে শ্রমিকের স্বার্থ সংরক্ষণ করা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। অনেক লাইসেন্স গ্রহণকারী সংস্থা নবায়ন ছাড়াই বিভিন্ন কাজ করতে টেন্ডারে অংশগ্রহণ করছে যা আমাদের না জানালে তা শ্রম আইন বহির্ভূত কাজ হবে বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়।

‘এমতাবস্থায়, আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে লাইসেন্সের আওতাভুক্ত করতে এবং যারা ইতোমধ্যে লাইসেন্স নিয়েছেন তাদের লাইসেন্স হালনাগাদ পর্যন্ত নবায়ন এবং নবায়নপ্রাপ্তের আওতাভুক্ত করার জন্য লাইসেন্স ছাড়া কোনো কাজ না দেওয়ার জন্য আপনার মন্ত্রণালয় ও দপ্তরকে নির্দেশনা দেওয়ার ব্যাপারে আপনার ব্যক্তিগত সহযোগিতা ও সহানুভূতি কামনা করছি’ লিখেছেন শ্রম প্রতিমন্ত্রী।

এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব মো. এহছানে এলাহী বলেন, ‘আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোর অনিয়মের বিষয়ে আমাদের পদক্ষেপ আরও জোরদার করছি। এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নিতে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের মহাপরিদর্শককে নির্দেশনা দেওয়া আছে।

অধিদপ্তরের সাধারণ শাখার এক কর্মকর্তা জানান, শোনা যায় অনেক আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স না নিয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করছেন। অধিদপ্তর জানলে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিয়ে থাকলে, কেউ অভিযোগ করলেও তা আমলে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘তারা টাকা পয়সা খরচ করে টেন্ডার সিডিউল কেনে। কার্যাদেশও নেয়, কিন্তু শ্রমিকদের ফান্ডামেন্টাল গ্রাচুইটির টাকাটা তারা দিতে চায় না। আমরাই শ্রম প্রতিমন্ত্রী মহোদয়ের কাছে এ বিষয়ে একটি প্রস্তাব দিয়েছিলাম, যদি স্টেক হোল্ডারদের কাছে চিঠি ইস্যু করা যায়, তবে অনিয়মের প্রতিকার সম্ভব।’

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলোর ইল মোটিভ (খারাপ উদ্দেশ্য) আছে, এটা বাস্তব। এই ধরনের প্রতিষ্ঠান কী সংখ্যক আছে, সেই বিষয়ে আমাদের কাছে অ্যাকচুয়াল ডাটা নেই। তবে হাজার দেড়েকের কম নয়।’

তিনি বলেন, ‘কেউ কেউ সরকারি চাকরির কথা বলে কর্মীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে থাকে। কোথাও সরবরাহ করে ২ হাজার লোক, আমাদের হিসাবপত্রে তারা দেখান হয়তো ২০০। সংখ্যাটা তারা গোপন করে, কারণ গ্রাচুইটির টাকা দিতে হবে। গ্রাচুইটির তহবিলটি কোম্পানি ও ডিআইএফই-এর যৌথ অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। কেউ কেউ গ্রাচুইটির টাকা দেবেন না বলে মামলাও করেছেন।’

ক্যাটাগরি অনুযায়ী, আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স ফি ২০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। নবায়ন ফি ৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত হয় বলেও জানান ডিআইএফই-এর এক কর্মকর্তা।

আউটসোর্সিং কোম্পানির এক কর্মকর্তা বলেন, বাজেটে শ্রমিকের গ্রাচুইটিটা অন্তর্ভুক্ত করা নেই। অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রে শুধু কর্মীদের বেতনটাই নির্ধারণ করা আছে। কোম্পানিগুলো এর ওপর ৫ শতাংশ কমিশন পাচ্ছে। কোম্পানি পরিচালনায় খরচ আছে। এজন্য আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠানগুলো অন্যায়ের আশ্রয় নেয়।

আউটসোর্সিং প্রতিষ্ঠান এলিট ফোর্সের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করে বলেন, সারা দেশে আমাদের ২২ হাজারের মতো কর্মচারী রয়েছে। নিরাপত্তা কর্মীদের ক্ষেত্রে সরকার ন্যূনতম বেতন ৯ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে। আমরা তো অনেক সময় কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে এ পরিমাণ বেতন নিতে পারি না। একটি বড় ব্যাংক গার্ডপ্রতি মাত্র সাড়ে ৫ হাজার টাকা দেয়। এই টাকা দিয়ে একজন গার্ড কীভাবে পরিবার চালাবেন? তাই অনেকে ডাবল ডিউটি বা ওভার টাইম করে টিকে আছেন।

সেবা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে যেটা নিই তার ৭০ শতাংশ কর্মীদের দিয়ে দেই। বাকিটা অফিস পরিচালনায় ব্যয় করা হয় বলেও দাবি করেন ওই কর্মকর্তা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //