ডামাডোলে ডলার নিয়ে দৌড়াদৌড়ি

দেশের অভ্যন্তরে জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক রাজনীতিতে উত্তেজনা বিরাজ করছে। বিশ্বব্যাপী চলছে যুদ্ধের দামামা। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মধ্যে শুরু হয়েছে ফিলিস্তিনে ইসরায়েলি হামলা। এসব পরিস্থিতি দেশের অর্থনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ডামাডোলের মধ্যে মার্কিন মুদ্রা ডলার নিয়ে সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের দাম কমিয়ে দিয়েছে। কিন্তু বাজারে পরিস্থিতি ভিন্ন। ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের কাছ থেকে ডলার কিনছেই ১২৩ টাকা দরে। বিক্রির ক্ষেত্রেও ডলারের দাম বেশি রাখছে ব্যাংকগুলো। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ডলারের প্রকৃত বিনিময় মূল্য প্রকাশ করা হচ্ছে না। অনেক আমদানিকারক ডলারের জন্য এক ব্যাংক থেকে আরেক ব্যাংকে ধরনা দিচ্ছেন। কিন্তু চাহিদা মাফিক ডলারের সংস্থান করতে পারছেন না। ডলারের কারণে দেশের বাজারে অনেক পণ্যের সরবরাহ সংকট এবং বহু পণ্যের দাম ব্যাপক হারে বেড়েছে।

প্রবাসী আয়ের ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলো আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতি ডলারের বিনিময়ে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা দিচ্ছে। এর বাইরে আড়াই শতাংশ সরকারি প্রণোদনা এবং আড়াই শতাংশ ব্যাংক কর্তৃক প্রণোদনা মিলে প্রবাসীরা আরও ৫ টাকা বেশি পাচ্ছেন। কিন্তু এই আনুষ্ঠানিক দামে ডলার কিনতে পারছে না ব্যাংকগুলো। কোনো কোনো ব্যাংক ১২৩ টাকা পর্যন্ত দামে ডলার কিনছে। বাংলাদেশ ব্যাংক কিছু ব্যাংককে বেশি দামে ডলার কেনার সুযোগ দিচ্ছে। এর পরও নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্স এসেছে ১৯৩ কোটি ডলার। আগের মাসে অক্টোবরে ১৯৭ কোটি ৭৫ লাখ ডলার রেম্যিাটন্স এসেছিল। অর্থাৎ আগের মাসের তুলনায় ৪ কোটি ৭৫ লাখ কম পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে। 

এদিকে এসব ব্যাংক থেকে ডলার কিনে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ বাড়ানোর চেষ্টা করলেও তা বরং কমছে। গত এক সপ্তাহে রিজার্ভ কমেছে ১২ কোটি ডলার। ফলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী গত বুধবার রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৪০ কোটি বা ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলারে নেমেছে। তবে প্রকৃত বা নিট রিজার্ভ ১৬ বিলিয়নের কম।

বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ ও ব্যাংকগুলোর নিজস্ব ডলার আয় কমে যাওয়ায় আমদানিতে অনেক প্রভাব পড়েছে। আমদানি কম হওয়ায় তার প্রভাব পড়ছে রপ্তানি আয়ে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত অক্টোবর মাসে ৩ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা ২৬ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন।  

আগের বছরের একই মাসে মোট ৪ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছিল। রপ্তানি যখন এমনিতেই চ্যালেঞ্জের মুখে, তখন নতুন করে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও মানবাধিকার ইস্যুতে রীতিমতো চোখ রাঙাচ্ছে আমেরিকা-ইইউভুক্ত দেশগুলো। ডলারের দাম প্রসঙ্গে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, দাম যেহেতু কমছে, সংকট তো মনে হয় কেটে যাচ্ছে। তবে ১২২-১২৩ টাকা দরের নিচে প্রবাসী আয় পাওয়া যাচ্ছে না। এ জন্য আমরা ডলার কিনতে পারছি না। গত মাসের চেয়ে প্রবাসী আয় বেশ কমে গেছে। এর ফলে চাহিদামতো ঋণপত্র খুলতে পারছি না। আমাদের মতো আরও অনেক ব্যাংকের অবস্থা একই রকম।

সংকটের মধ্যে ডলারের দাম দুই দফায় ৭৫ পয়সা কমিয়েছে ব্যাংকগুলো। ফলে প্রবাসী ও রপ্তানি আয় কেনায় ডলারের দাম হয়েছে ১০৯ টাকা ৭৫ পয়সা। আর আমদানির ক্ষেত্রে দাম ১১০ টাকা ২৫ পয়সা। তবে নির্ধারিত দামে ডলার কেনাবেচা হচ্ছে কম। ৩০ নভেম্বরেও ব্যাংকগুলো ১২৩ টাকার বেশি দামে প্রবাসী আয় কিনেছে। বাংলাদেশ ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশন (বাফেদা) ও অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) ডলারের নতুন দাম ঠিক করেছে। 

এদিকে, বেশি দামে প্রতিযোগিতা করে প্রবাসী আয় কিনছে শরিয়াহভিত্তিক ও প্রচলিত ধারার কিছু ব্যাংক। বিদেশি রেমিট্যান্স হাউসগুলো ১২১-১২২ টাকা দামে প্রবাসী আয় সংগ্রহ করেছে। এর চেয়ে বেশি দামে তাদের কাছ থেকে ডলার কিনেছে দেশের ব্যাংকগুলো। একটি ব্যাংকের কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক কোনো পদক্ষেপ নেবে না, এমন আশ্বাস পাওয়ার পরই বেশি দামে ডলার কেনা হচ্ছে। এর মাধ্যমে পুরনো কিছু আমদানি দায় শোধ করা সম্ভব হয়েছে।  

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরও কমেছে। এক সপ্তাহে কমেছে ১২ কোটি ডলার। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি অনুযায়ী গত ২৯ নভেম্বর রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৪০ কোটি ডলার বা ১৯ দশমিক ৪০ বিলিয়নে নেমেছে। এর আগের সপ্তাহে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ১৯ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। তবে দায়হীন বা প্রকৃত রিজার্ভ এখন ১৬ বিলিয়নের কম। 

এদিকে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে আরেক সংকট বৈদেশিক ঋণ। ক্রমাগতভাবে এই ঋণ বাড়ছে। ঋণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পরিশোধের চাপও বাড়ছে। দেশে বৈদেশিক ঋণ গত এক বছরে বেড়েছে ৩৪৯ কোটি ডলার। গত বছরের (২০২২) জুনে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল ৯ হাজার ৫৪৫ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৯ হাজার ৮৯৪ কোটি ডলার। আলোচ্য সময়ে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ বেড়েছে, কমেছে স্বল্পমেয়াদি ঋণ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়েছে ঠিকই, কিন্তু সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগ বা এফডিআই কমেছে। আর বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের বিদেশে বিনিয়োগের স্থিতিও সামান্য কমেছে।

২০২২ সালের জুনে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ ছিল ৭ হাজার ৪৮০ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ২৯০ কোটি ডলার। গত বছরের জুনে স্বল্পমেয়াদি ঋণ ছিল ২ হাজার ৬৫ কোটি ডলার। আর চলতি বছরের জুনে তা কমে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ৬০৩ কোটি ডলার। 

সূত্র জানায়, গত দেড় বছর ধরে দেশে ডলার সংকট চলছে। স্বল্পমেয়াদি বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের কারণে এ সংকট আরও বেড়েছে। কিন্তু সার্বিকভাবে স্বল্পমেয়াদি ঋণ কমলেও এখন বেড়ে গেছে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ। ফলে সার্বিকভাবে মোট বৈদেশিক ঋণের স্থিতি বেড়ে গেছে, যা পরিশোধে ডলারের ওপর আরও চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //