নিষেধাজ্ঞার শঙ্কায় তৈরি পোশাক খাত

বাংলাদেশের বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিতে পারে যুক্তরাষ্ট্র সরকার- এমন আলোচনা সবখানে। সম্প্রতি রাশিয়ার পক্ষ থেকেও এমন আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে। লেনদেনের ক্ষেত্রে বিদেশি ব্যাংক নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত শর্ত জুড়ে দিচ্ছে। যদিও সরকার থেকে বারবারই বলা হচ্ছে এরকম পরিস্থিতি বাংলাদেশে তৈরি হয়নি। তবে এই সংক্রান্ত ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে। সবচেয়ে বেশি চাপে পড়বে দেশের পোশাক খাত। অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি জারি এবং স্যাংশন আরোপ করার কথা বলে আসছে। যদিও কোন পরিস্থিতিতে কিসের ভিত্তিতে কোন কোন খাতের ওপর স্যাংশন দেওয়া হবে সেটি পরিষ্কার করে বলা হচ্ছে না। সম্প্রতি রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আনুষ্ঠানিক মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা বলেন, ‘পশ্চিমা শক্তিগুলোর পক্ষে অসুবিধাজনক’ বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে নানা রকমের অবরোধ আরোপ করা হতে পারে। অর্থনীতিবিদ ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, ব্যক্তি বা সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞায় কিছু আসে যায় না। এটা ওদের বিষয়। কিন্তু বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত বড় বিষয়। একটাই মাত্র পণ্য। সেটার ওপর নতুন বিধিনিষেধ এলে অর্থনীতিতে বড় ধাক্কা আসবে।

তবে বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার মতো কোনো পরিস্থিতি কিন্তু নেই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেমোরেন্ডামে চাচ্ছে শ্রম পরিস্থিতির আরও উন্নতি হোক সব দেশে, এটা শুধু বাংলাদেশকে টার্গেট করে না। সেটা আমরা আমলে নিয়েছি। স্যাংশন আলোচনার মধ্যে পোশাক খাত নিয়ে উদ্বিগ্নতা বাড়ছে। ঋণপত্র (এলসি) খোলার সময় স্যাংশন বিষয়টি শর্ত হিসেবে জুড়ে দিচ্ছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠান ও বিদেশি ব্যাংক। 

বিজিএমইএর পক্ষ থেকে জানানো হয়, সম্প্রতি বিদেশি ক্রেতার পাঠানো একটি এলসি অনুলিপি তাদের নজরে এসেছে। সংগঠনটির এক সদস্যকে পাঠানো সে এলসির ধারায় উল্লেখ রয়েছে ‘আমরা জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইইউ, যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা আরোপিত কোনো দেশ, অঞ্চল বা দলের সঙ্গে লেনদেন প্রক্রিয়া করব না। নিষেধাজ্ঞার কারণগুলোর জন্য আমরা কোনো বিলম্ব, নন-পারফরম্যান্স বা তথ্য প্রকাশের জন্য দায়ী নই।’

এদিকে ঋণপত্রের ওই ধারাটি আলোচনায় আসতেই দেশের বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়ায় বিশেষ মনোযোগ দিয়েছে। ব্যাংকগুলোর প্রধান কার্যালয় থেকেও ধারাটির খুঁটিনাটি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা সাপেক্ষে ঋণপত্র গ্রহণের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এসব প্রক্রিয়ায় বিপাকে পড়তে হচ্ছে রপ্তানিসংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশি এক বায়িং হাউস ৬ ডিসেম্বর পোশাকের একটি ঋণপত্র পায়। তাতে স্যাংশন-সংক্রান্ত একটি ধারা যুক্ত রয়েছে। তবে ধারাটি নতুন নয়, ২০২২ সাল কিংবা তার আগেও ঋণপত্রে তা যুক্ত ছিল। যেগুলো গ্রহণের পর পণ্য জাহাজীকরণ হয়ে অর্থও পরিশোধ হয়েছে। কিন্তু ৬ ডিসেম্বরের ঋণপত্রের খসড়া সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছে দেওয়া হলে রপ্তানিকারককে ধারাটি তুলে নেওয়ার শর্ত দেওয়া হয়। পরে ব্যাংকের ওই বার্তা ক্রেতাকে দেওয়া হলে তাদের পক্ষ থেকে জানানো হয়, এ ধরনের ধারাযুক্ত ঋণপত্র দিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ চলছে। নতুন করে এখন কেন সেটি তুলে নেওয়ার কথা বলা হচ্ছে? পাশাপাশি ক্রেতার পক্ষ থেকে এও জানানো হয় যে পণ্য আমদানিকারক ঋণপত্রে এ ধারা যুক্ত করেনি, সেটি করেছে মূলত ইউরোপীয় ওই আমদানিকারকের সংশ্লিষ্ট ব্যাংক। তাই ধারাটি কোনোভাবেই তুলে নেওয়া সম্ভব নয়।

জানতে চাইলে সংশ্লিষ্ট বায়িং হাউসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাজুল ইসলাম বলেন, ‘৬ ডিসেম্বর ঋণপত্র পাওয়ার পরপরই কারখানা কর্তৃপক্ষ বা রপ্তানিকারকের কাছে তা খসড়া হিসেবে দেওয়া হয়। সেটি যাচাই-বাছাই করে রপ্তানিকারকের ব্যাংক স্যাংশন-সংক্রান্ত ধারাটি তুলে নিতে বলে। তার কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে ব্যাংকের পক্ষ থেকে। তারা জানিয়েছে, সুনির্দিষ্ট কিছু ধারা যুক্ত থাকলে বিজিএমইএর পক্ষ থেকেই ঋণপত্র গ্রহণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। সে কারণেই এ পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে ব্যাংক।

এই পরিস্থিতিতে সতর্কতাস্বরূপ ব্যাংকগুলো এখন ঋণপত্রে থাকা ধারাগুলো যাচাই-বাছাইয়ে অনেক বেশি সচেতনতা অবলম্বন করছে। মার্কেন্টাইল ব্যাংক পিএলসির পক্ষ থেকে তাদের শাখাগুলোকে দুটি ব্যবস্থা অনুসরণের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রথমটি হলো সব রপ্তানি এলসি বা বিক্রয় চুক্তি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই করা। তাতে কোনো প্রতিকূল ধারা পাওয়া গেলে, এর বিপরীতে যে কোনো ব্যাক টু ব্যাক এলসি ইস্যু করার জন্য সংশ্লিষ্ট এবং প্রযোজ্য বিভাগ থেকে কেস টু কেস ভিত্তিতে পূর্ব অনুমতি নেওয়া। দ্বিতীয় ব্যবস্থাটি হলো ক্লায়েন্টদের অনুরোধের ক্ষেত্রে এ ধরনের রপ্তানি এলসি বা বিক্রয় চুক্তির জন্য; আবেদনকারী এবং সুবিধাভোগীর সহযোগিতায় প্রতিকূল ধারায় প্রয়োজনীয় সংশোধনের ব্যবস্থা করা। কোনোভাবেই প্রয়োজনীয় সংশোধনী বা প্রধান কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে গৃহীত অনুমোদনের আগে এ ধরনের রপ্তানি এলসি বা বিক্রয় চুক্তিতে না যাওয়ার নির্দেশনা রয়েছে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের সার্কুলারে।

জানতে চাইলে মার্কেন্টাইল ব্যাংকের ডিএমডি শামীম আহম্মদ বলেন, ‘অ্যাডভার্স ক্লজের এলসির জন্য যেন সচেতনতামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয় সেদিকে আমরা নির্দেশনা দিয়েছি। ঋণপত্রে এ ধরনের ক্লজ আগেও ক্রেতার পক্ষ থেকে দেওয়া হতো। তবে সম্প্রতি অ্যাডভার্স ক্লজের ক্ষেত্রে প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি নিতে বলা হয়েছে। আমরা কোনো কিছু করতে মানা করিনি। আমাদের ব্যাংকের বিদ্যমান অনেক কাস্টমার এ ধরনের অ্যাডভার্স ক্লজ নিয়ে গত কয়েক বছর ধরেই ব্যবসার কার্যক্রম চালিয়ে আসছেন। আমাদের কাস্টমার এবং তাদের ক্রেতার স্ট্রেংথ অনুযায়ী আমরা কার্যক্রমগুলো চালিয়ে যাই।’

এদিকে ব্যাংকের এ সতর্কতামূলক পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে বিজিএমইএ। তবে যাচাই-বাছাই যতটা সম্ভব দ্রুততার সঙ্গে সম্পন্ন করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে সংগঠনটির সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, ‘রপ্তানিকারকের বিড়ম্বনা বা বিপাকে পড়ার বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়েই আমাদের অবস্থানটা পরিষ্কার থাকতে হবে। প্রথমেই যে বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ সেটা হলো আমাদের দেশের ওপর কোনো স্যাংশন নেই। আমি দৃঢ়ভাবে বলছি যে স্যাংশন আসার কোনো কারণ ও আশঙ্কাও নেই। শ্রম আইন অনুসরণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চেয়ে খারাপ পরিস্থিতি বিরাজ করছে এমন দেশের সঙ্গে ব্যবসার ক্ষেত্রে যদি ক্রেতা স্যাংশন সম্পর্কিত কোনো ক্লজ ব্যবহার না করেন, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তা ব্যবহার হলে আমরা মেনে নেব না।’

স্যাংশন সম্পর্কিত কোনো ক্লজ যদি বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই কেবল ব্যবহার করা হয়, সে ঋণপত্রের মাধ্যমে ক্রয়াদেশ না নেওয়ার জন্য সদস্যদের সতর্ক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বিজিএমইএ সভাপতি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এর জন্য ক্রয়াদেশ কম হতে পারে কিন্তু ঝুঁকিমুক্ত থাকা যায়। আগেও এ ধরনের ক্লজ ব্যবহার হতো, যেমন রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ সম্পর্কিত স্যাংশন ক্লজ ব্যবহার হচ্ছিল। তবে এখন অনেক সুনির্দিষ্ট ক্লজ দেওয়া হচ্ছে। এ ধরনের ক্লজ যদি আগেও ব্যবহার হয়ে থাকে সেটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। চুপচাপ মেনে নেওয়া যাবে না। তার পরও যদি কেউ এ ধরনের ক্লজযুক্ত ঋণপত্র গ্রহণ করে সেটা সংশ্লিষ্ট রপ্তানিকারক ও ব্যাংকের বিষয়। আমাদের সাবধান থাকা দরকার, কারণ আন্তর্জাতিক ব্যবসা করতে গেলে যদি অর্থ পরিশোধ না হয় তার প্রভাব অনেক বেশি নেতিবাচক। ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতিও তৈরি হয়। সব মিলিয়ে অ্যাডভার্স ক্লজগুলো নিয়ে সচেতন ও সতর্ক হতেই হবে।’

ব্যাংকাররাও বলছেন, স্যাংশন সম্পর্কিত ক্লজ এলসিতে আগেও ব্যবহার হতো। তবে যুক্তরাষ্ট্র শ্রম অধিকার ইস্যুতে স্মারক ঘোষণা দেওয়ার পর ঋণপত্রগুলোয় বাংলাদেশের জন্য অ্যাডভার্স ক্লজ আরও সুস্পষ্টভাবে ব্যবহার হচ্ছে। এতে করে সময়ক্ষেপণ ও ব্যবসা হারানোর ঝুঁকি তৈরি হলেও সবার স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিতে অনেক ব্যাংকের পক্ষ থেকেই তাদের সংশ্লিষ্ট শাখাগুলোকে এ ক্ষেত্রে সতর্ক হতে বলা হয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //