আমদানি নিয়ন্ত্রণ

অর্থনীতিকে অনিশ্চয়তায় ফেলবে

ডলার সংকটের কারণে আমদানি কমাতে নানা শর্ত আরোপ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। তাদের তদারকির কারণে প্রতিনিয়ত কমছে আমদানি ব্যয়। কমেছে শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য দ্রব্যের আমদানি। এর ফলে স্থানীয় বাজারে অনেক পণ্যের দাম কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। শিল্প খাতে আমদানি কমার কারণে রপ্তানিতে প্রভাব পড়ছে। কাঁচামালের অভাবে আশানুরূপ উৎপাদন বাড়ছে না। উৎপাদনমুখী শিল্প ব্যাপকহারে সচল না হলে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। দীর্ঘমেয়াদে আমদানি কমতে থাকলে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। 

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে পণ্য আমদানির জন্য ব্যাংকগুলোতে ঋণপত্র (এলসি) নিষ্পত্তির হার ২৭ শতাংশ কমেছে। শিল্পের মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি সবচেয়ে বেশি কমেছে। আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে মূলধনী যন্ত্রপাতি আমদানি কমেছে ৩৬ শতাংশ। আর শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমেছে ৩৪ শতাংশ। ব্যক্তির প্রয়োজনীয় দ্রব্য আমদানি কমেছে ২২ শতাংশ। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ডলার সংকট কাটাতে নানা উপায়ে আমদানি নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিভিন্ন পণ্য আমদানিতে শুল্ক বাড়িয়েছে সরকার। একই সঙ্গে তুলনামূলক কম প্রয়োজন বা বিলাসী পণ্যের এলসি খোলার সময় শতভাগ পর্যন্ত নগদ মার্জিনের শর্ত দেওয়া আছে। এ ছাড়া বড় এলসি খোলার ২৪ ঘণ্টা আগে তথ্য নিয়ে তার সঠিকতা যাচাই করছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ডলার সংস্থান করা ছাড়া ব্যাংকগুলোকে এলসি না খুলতে বলা হয়েছে। এর প্রভাবে আমদানি কমেছে।

পণ্য আমদানি কমার প্রভাব পড়েছে রপ্তানিতে। রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্যমতে, ২০২২ সালের ডিসেম্বরের চেয়ে ২০২৩ সালের একই মাসে রপ্তানি আয় ১.০৬ শতাংশ কমেছে। চলতি অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয় হয়েছে ২৭.৫৪ বিলিয়ন ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় যা সামান্যই (শূন্য দশমিক ৮৪ শতাংশ) বেড়েছে। 

বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, কাঁচামাল আমদানি কমার প্রবণতা অব্যাহত থাকলে শিল্প খাতে উৎপাদন কমতে থাকবে। আর ধারাবাহিকভাবে এই প্রবণতা কর্মসংস্থান ও জিডিপির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

তিনি আরও বলেন, অর্থনীতিতে দুষ্টচক্র তৈরির প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। শক্ত হাতে জরুরি ভিত্তিতে এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হবে। অর্থ পাচার ও হুন্ডি রোধে কঠোর পদক্ষেপ এবং প্রবাসী আয় বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। কারণ ডলার সংকট আরও তীব্র হলে অর্থনীতি বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।

ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশি ক্রেতাদের ক্রয়াদেশ কমে যাওয়ায় রপ্তানিমুখী বিভিন্ন খাতের কাঁচামাল আমদানি কমেছে। তবে আমদানি প্রতিস্থাপক শিল্পের কাঁচামাল আমদানি কমার কারণ দুটি; এক. ডলার সংকট, দুই. চাহিদা কম। এ ছাড়া রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা তৈরি হওয়ায় ব্যবসায়ীরাও ঝুঁকি নিতে চাইছেন না।

তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সহসভাপতি শহিদউল্লাহ আজিম বলেন, তৈরি পোশাকের ক্রয়াদেশ কম থাকায় কাঁচামাল আমদানি কমেছে। অধিকাংশ কারখানা ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ উৎপাদন সক্ষমতায় চলছে। দীর্ঘদিন ধরে অতিরিক্ত কর্মঘণ্টা (ওভারটাইম) নেই। বছরের প্রথমার্ধে গ্যাস সংকট ছিল। ক্রয়াদেশ কম থাকায় চাহিদাও সেভাবে ছিল না। এর ওপর আমদানিকারকরা ডলার সংকটে ঋণপত্র খুলতে সমস্যায় পড়েন। 

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমদানিতে নানা শর্তের কারণে বৈদেশিক বাণিজ্যের ঘাটতি কিছুটা কমছে। চলতি হিসাবের পরিস্থিতিও বেশ উন্নতি হয়েছে। তবে আর্থিক হিসাবে বড় ঘাটতিতে পড়ছে দেশ। এর মূল কারণ যে হারে দেশে বিদেশি ঋণ আসছে তার চেয়ে বেশি আগের নেওয়া ঋণ পরিশোধ করতে হচ্ছে। এ কারণে বহির্বিশ্বের সঙ্গে দেশের সামগ্রিক লেনদেনে বড় ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। 

চলতি অর্থবছরের জুলাই-নভেম্বর সময়ে দুই হাজার ৯৬ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলারের পণ্য রপ্তানি করেছে। এ সময় আমদানি হয়েছে দুই হাজার ৫৭২ কোটি ডলারের পণ্য। এতে করে অর্থবছরের পাঁচ মাসে ৪৭৬ কোটি ২০ লাখ (৪ দশমিক ৭৬ বিলিয়ন) ডলারের বাণিজ্য ঘাটতিতে পড়েছে বাংলাদেশ। বর্তমান বিনিময় হার হিসাবে দেশীয় মুদ্রায় (প্রতি এক ডলার ১১০ টাকা ধরে) এর পরিমাণ ৫২ হাজার ৩৮২ কোটি টাকা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, পাঁচ মাসে বৈদেশিক বাণিজ্যের আর্থিক হিসাবে ৫৪০ কোটি ডলার ঘাটতি হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ৪ গুণের চেয়ে বেশি। গত অর্থবছরের জুলাইয়ে এ ঘাটতি ছিল ১২৬ কোটি ডলার।

এদিকে সামগ্রিক লেনদেন ভারসাম্যে ঘাটতি বেড়ে যাওয়া মানে বিভিন্ন উৎস থেকে দেশে যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আসছে, তার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে পরিশোধ ঝুঁকি এড়াতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ বা রিজার্ভ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক প্রচুর পরিমাণ ডলার বিক্রি করছে। সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ৬৭০ কোটি (৬ দশমিক ৭ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে বাংলদেশ ব্যাংক। ফলে ধারাবাহিকভাবে কমছে রিজার্ভ। গত ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত রিজার্ভ ছিল ২৭ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার, যা বিপিএম ৬ অনুযায়ী রয়েছে ২১ দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার। 

এদিকে বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের প্রভাব পড়েছে নিত্যপণ্যের বাজারে। টাকার অবমূল্যায়ন ও ডলার সংকটে আমদানি কমে বিদেশ থেকে আনা পণ্যের দাম বেড়েছে। এর প্রভাব পড়েছে পেঁয়াজ, রসুন, আলু, বেগুন ও ইলিশের মতো দেশে উৎপাদিত পণ্যের বাজারেও। গত এক বছরে পণ্যগুলোর দাম বেড়েছে অন্তত দুই-তিন গুণ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //