পাটের দুর্দিন

টেক্সটাইলে ঝুঁকছে প্রতিষ্ঠানগুলো

রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ২৫ পাটকল বন্ধ করে বেসরকারি খাতে দেওয়ার পরও বাড়েনি পাটপণ্যের রপ্তানি। বরং কয়েক বছরে অস্বাভাবিক হারে কমেছে। পাটপণ্যের উৎপাদন কমিয়ে তাই টেক্সটাইলে ঝুঁকছে লিজ নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো। 

বছরের পর বছর ধরে লোকসান করায় ২০২০ সালের জুলাই থেকে শ্রমিকদের গোল্ডেন হ্যান্ডশেকের আওতায় এনে দেশের সরকারি পাটকলগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়। পর্যায়ক্রমে বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় লিজের মাধ্যমে চালু করা হয় অধিকাংশ মিল। কিন্তু বেসরকারি খাতে যাওয়ার পরও দেশের প্রক্রিয়াজাতকৃত পাট রপ্তানি ক্রমশ কমছে। এর মধ্যে পাট ও পাটজাত পণ্যের জন্য মিলগুলো ইজারা দেওয়া হলেও সেটিও সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে না, যা দেশের রপ্তানিমুখী পাট শিল্পে নতুন সংকট বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) আওতাধীন মিলগুলো বন্ধ ঘোষণার পর পর্যায়ক্রমে আটটি পাটকল বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা দেওয়া হয়েছে। আরও আটটি মিল দেশি-বিদেশি প্রতিষ্ঠানের কাছে ইজারা প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানা গেছে। চারটি মিলের ইজারাও প্রক্রিয়াধীন। তবে তিনটি মিল আপাতত ইজারা না দিয়ে বিজেএমসির কাছেই রেখে দেওয়ার চিন্তা ভাবনা সরকারের। 

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রপ্তানি তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ২০২০-২১ অর্থবছরেও বিশ্ববাজারে পাটপণ্য রপ্তানি হয়েছিল ১২৪ কোটি ডলারের বেশি। এটি কমে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে নেমে এসেছে ৯০ কোটি ডলারে। আগে মোট পাট রপ্তানির মধ্যে হেসিয়ান, স্যাকিংসহ ভ্যালু অ্যাডেড পাটপণ্য বেশি হলেও বর্তমানে কাঁচা পাট ও পাটজাত সুতা রপ্তানির পরিমাণ বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি লাভজনক পাটের বহুমুখী পণ্য রপ্তানির পরিমাণ কমে কাঁচা পাট ও সুতা রপ্তানির হার বৃদ্ধি পাওয়ায় পাট রপ্তানির মাধ্যমে দেশে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। 

বেসরকারি খাতে ইজারা দেওয়া পাটকলগুলোর মধ্যে প্রথম পর্যায়ে উৎপাদনে গেছে বাংলাদেশ জুট মিল, কেএফডি জুট মিল ও জাতীয় জুট মিল। সিরাজগঞ্জের জাতীয় জুট মিলস লিমিটেডের ইজারা পাওয়া প্রতিষ্ঠান রশিদ অটোমেটিক রাইস কোম্পানি শুরুতে দৈনিক ১০ থেকে ১২ টন পাটপণ্য উৎপাদন করলেও বর্তমানে এর উৎপাদন নেমে এসেছে ৩-৪ টনে। যদিও বিজেএমসির অধীনে থাকাকালে মিলটির দৈনিক গড় উৎপাদন ছিল ২৫ টন। চট্টগ্রামের কেএফডি জুট মিলস ইজারা পেয়েছে ইউনিটেক্স কম্পোজিট মিলস। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনীয়া উপজেলার এই মিলটিতে বিজেএমসি প্রতিদিন ১৫-২০ টন পাটজাত পণ্য উৎপাদন করলেও বর্তমান ইজারাদার প্রতিষ্ঠান উৎপাদন করছে ২-৩ টন। শুরুতে ৫-৬ টন পাটপণ্য উৎপাদন কমলেও রপ্তানিতে পিছিয়ে পড়াসহ নানান কারণে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। একইভাবে ইজারা পাওয়ার পর বাংলাদেশ জুট মিলসে দৈনিক গড়ে ১০ থেকে ১২ টন পাটপণ্য উৎপাদন করলেও বর্তমানে সেটি কমে এসেছে ৫-৬ টনে। বে-গ্রুপের কাছে ইজারা দেওয়ার আগে বিজেএমসির অধীনে এ মিলে দৈনিক ৩০-৩৫ টন পাটপণ্য উৎপাদন হতো। ইজারা নেওয়া অন্য কোম্পানিগুলো পাটজাত পণ্য উৎপাদনের পরিবর্তে বিকল্প চিন্তাভাবনা করছে। যার কারণে দ্বিতীয় পর্যায়ের ইজারা প্রক্রিয়ায়ও বেশকিছু পরিবর্তন এনেছে বিজেএমসি। 

খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, মিলগুলো ইজারা দেওয়ার আগে বিজেএমসির মিল নিয়ে বেসরকারি খাত কিংবা সরকারিভাবেও একটি ভুল ধারণা ছিল। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি পর্যায়ে যাওয়ার পরও এসব মিল পাটপণ্য উৎপাদনের মাধ্যমে মিল চালাতে পারছে না। উদ্যোক্তাদের অনেকেই পাটের উৎপাদন কমিয়ে মিল এলাকায় বিকল্প পণ্য উৎপাদনের পরিকল্পনা করছে। বিজেএমসির কর্মকর্তারা বলছেন, ইজারাগ্রহীতা কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই বর্তমানে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। কেউ কেউ পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদন না করে কাঁচা পাট থেকে সুতা তৈরির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকটি মিলের উৎপাদিত সুতা রপ্তানি করতে না পেরে মিল প্রাঙ্গণে মজুদ করে রেখেছে বলেও দাবি করেছেন তারা। 

বিজেএমসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের পাট খাত হিসেবে বিজেএমসিকেই চিনত ক্রেতারা। বিজেএমসির কলগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে এক সঙ্গে বড় অর্ডার দিতে পারছে না। সরকারি সংস্থাটির নিয়ন্ত্রণাধীন ২৫টি মিলে কার্যাদেশপ্রাপ্ত পণ্যের অর্ডার ডিস্ট্রিবিউট করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পাটপণ্য সরবরাহ করতে পারত। কিন্তু বর্তমানে বেসরকারি মিলগুলো এককভাবে পাটের বড় অর্ডার নিতে পারছে না। ইরান, সুদান, ঘানা, আইভরিকোস্ট, সিরিয়াসহ বিভিন্ন দেশ বিজেএমসি বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে বাংলাদেশবিমুখ হয়েছে। এসব দেশের অর্ডারগুলো এখন ভারতে চলে যাচ্ছে। ফলে ইজারা নেওয়া কোম্পানি কিংবা বেসরকারি খাতের পাটকলগুলোও পাটের বৈদেশিক রপ্তানি বাজার ধরতে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছে। 

বিভিন্ন পাটকল সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বিজেএমসির পাটকলগুলো এক সময় প্রতিবছর ৫০ মিলিয়ন সিবিসি ব্যাগ তৈরি ও রপ্তানি করত সুদানে। একইভাবে প্রতিবছর গড়ে ৪০-৫০ মিলিয়ন সিবিসি ব্যাগ রপ্তানি হতো ঘানায়, ১০ মিলিয়ন সিবিসি ব্যাগ রপ্তানি হতো আইভরিকোস্টে। বন্ধ হওয়ার আগে টানা ১০ বছর সিরিয়ায় হেসিয়ান ও স্যাকিং পাটপণ্য রপ্তানি হতো। এ ছাড়াও ইরানসহ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশি পাটপণ্যের ব্যাপক চাহিদা ছিল। কিন্তু বিজেএমসি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এসব বাজারের ৫০ থেকে ১০০ শতাংশই ভারতের দখলে চলে গেছে। বিজেএমসি আগে বহুমুখী পাটপণ্য উৎপাদনে বেশি আগ্রহী থাকলেও বর্তমানে ইজারা নেওয়া কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই ইয়ার্ন বা পাটের সুতা তৈরিতে মনোযোগী। তা ছাড়া বাংলাদেশের পাটজাত সুতা সংগ্রহ করে ভারতসহ বিভিন্ন দেশ উন্নতমানের পাটজাত পণ্য তৈরি করে বিশ্ববাজারে রপ্তানি করায় বাংলাদেশের পাটের রপ্তানি বাজার সংকুচিত হয়ে পড়েছে। ফলে ইজারা নেওয়া পাটকলের মালিকরা পাটের পরিবর্তে বিকল্প শিল্প স্থাপনের দিকেই মনোযোগী বলে মনে করছেন বিজেএমসির শীর্ষ কর্মকর্তারা। 

জানতে চাইলে বিজেএমসির ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, মিলগুলো বন্ধ করে দেওয়ার পর অনেক বিদেশি প্রতিষ্ঠান ই-মেইলে কিংবা সরাসরি বাংলাদেশে এসে বিজেএমসির মিলগুলোর কাছে পাটপণ্য ক্রয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। বেসরকারি খাতের কাছে এক সঙ্গে বড় অর্ডার দিতে না পারায় তারা বিকল্প দেশে আমদানির দিকে মনোযোগী হয়েছে। এক সময় বিজেএমসি দেশের এবং বিশ্ববাজারে পাটের স্ট্যান্ডার্ড দাম নির্ধারণে ভূমিকা রাখত। এমনকি কাঁচাপাটের দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রেও প্রতিষ্ঠানটির ভূমিকা ছিল। কিন্তু এটি কার্যত বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বিশ্বের বিভিন্ন পাট উৎপাদন ও পাটপণ্য উৎপাদনকারী দেশ নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম নির্ধারণ করেই পণ্য বিক্রি করছে। যার কারণে দেশের বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তা কিংবা ইজারা নেওয়া প্রতিষ্ঠানগুলোও বিশ্ববাজারে নিজেদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রির ক্ষেত্রে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতার মুখোমুখি হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। 

এ বিষয়ে একমত বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের (বিজেএমএ) সভাপতি আবুল হোসাইনও। তিনি বলেন, ‘বিজেএমসি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের পাট খাত উঠে দাঁড়াতে পারেনি। পাট নিয়ে নানান উচ্চাভিলাষী পরিকল্পনা সত্ত্বেও প্রতিবেশী দেশের অ্যান্টিডাম্পিং নীতিমালা, কাঁচা পাট ক্রয় প্রক্রিয়ায় ২ শতাংশ ক্রয় ট্যাক্স প্রদানসহ নানান সংকটে পাট খাত গভীর সংকটের মধ্যে পড়ে গেছে। বর্তমানে বিজেএমসির মিলগুলো ইজারা দেওয়া হলেও সেগুলো আসলেই পাটপণ্য উৎপাদন করছে কিনা, কিংবা পাটের বহুমুখী পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানিতে উদ্যোগী কিনা সে বিষয়টি দেখা প্রয়োজন।’ পাটের রপ্তানি বাজারকে আগের অবস্থানে নিয়ে যেতে হলে বিজেএমসিকে ভূমিকা রাখার পাশাপাশি পাট নিয়ে নতুন পরিকল্পনা, নীতিমালার বাস্তবায়ন জরুরি বলে মনে করেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //