সন্দেহজনক লেনদেন, কোথায় যায় অর্থ

দেশের আর্থিক খাতে সন্দেহজনক লেনদেন ও কার্যক্রম বেড়েই চলেছে। কোনো লেনদেনের বিষয়ে সন্দেহ হলে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বা অন্য প্রতিবেদন প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ব্যাংকের ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) কাছে রিপোর্ট করে।

সংস্থাটির বার্ষিক প্রতিবেদন বলছে, এক অর্থবছরে ৫২০টি সন্দেহজনক ঋণের তথ্য রয়েছে তাদের হাতে। ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে আমদানি-রপ্তানির আড়ালে বড় অঙ্কের অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমেও বৈদেশিক মুদ্রা পাচারের ঘটনা ঘটছে।

বাংলাদেশ থেকে বছরে কত অর্থ পাচার হয়- তার কোনো হিসাব বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে নেই। বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির হিসাবে, গত ৫০ বছরে বাংলাদেশ থেকে ১২ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। তার পাঁচ শতাংশ উদ্ধার করতে পেরেছে সরকার। আর গ্লোবাল ফিন্যান্সিয়াল ইনটেগ্রিটি বলছে, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের আড়ালে প্রতিবছর বাংলাদেশ থেকে গড়ে ৬৪ হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচার হচ্ছে।

বিএফআইইউয়ের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, দেশের আর্থিক খাত থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে তাদের কাছে পাঠানো ঋণসংক্রান্ত সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫২০, যা এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৩৪১টি। অর্থাৎ এ ধরনের লেনদেন প্রতিবেদনের সংখ্যা বেড়ে দেড় গুণ হয়েছে। আর গত অর্থবছরে ব্যাংক, আর্থিক প্রতিষ্ঠান, বীমা, ব্রোকারেজ হাউসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বিএফআইইউতে সব মিলিয়ে সন্দেহজনক লেনদেন প্রতিবেদন পাঠিয়েছিল ১৪ হাজার ১০৬টি, যা ২০২১-২২ অর্থবছরে ছিল ৮ হাজার ৫৭১টি।

সীমান্তবর্তী জেলাগুলো বেশি অপরাধপ্রবণ
বিএফআইইউর তথ্যানুসারে, সীমান্তবর্তী ২১ জেলায় বেড়েছে বড় অঙ্কের নগদ অর্থ লেনদেন। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এসব জেলার ব্যাংকগুলোয় ৩ লাখ ৮৮ হাজার ৬৭ কোটি টাকা নগদ লেনদেন হয়েছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ২৩ হাজার ৬০৫ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত অর্থবছরে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোয় নগদ লেনদেন বেড়েছে ১৯ দশমিক ৯২ শতাংশ। কুমিল্লা, যশোর, দিনাজপুর ও ময়মনসিংহ জেলায় এ ধরনের লেনদেন হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এ তালিকায় সীমান্তবর্তী অন্য জেলাগুলো হলো- কক্সবাজার, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি, ফেনী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, সিলেট, হবিগঞ্জ, শেরপুর, নওগাঁ, পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, সাতক্ষীরা ও চুয়াডাঙ্গা।

কোথায় যাচ্ছে এসব অর্থ
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিনের মতে, এই সন্দেহজনক লেনদেনের একটি অংশ পাচারও হয়েছে। মূল কথা হলো লোন পাওয়ার যোগ্যতা নেই- এমন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে লোন দেওয়া হয়েছে। আবার যা পায় তার চেয়ে বেশি দেওয়া হয়েছে। লোন নিয়ে টাকা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের দায়িত্ব এগুলো দেখা। শুধু প্রতিবেদন প্রকাশ করলেই হবে না। মনিটরিং বাড়িয়ে এটা বন্ধ করতে হবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে তারা ১৩৩টি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে বিভিন্ন সংস্থার কাছে। এর মধ্যে সিআইডিতে ৮৫টি, দুদকে ৩৩টি, এনবিআরে ১০টি ও অন্যান্য সংস্থায় পাঁচটি প্রতিবেদন পাঠানো হয়েছে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে।

নগদ লেনদেন সীমিত করতে উদ্যোগ
অবৈধ কর্মকাণ্ডে অর্থায়ন প্রতিরোধে বিশ্বের অনেক দেশ নগদ অর্থ লেনদেনের পরিমাণ কমিয়েছে। তারা ডিজিটাল লেনদেনকে বেশি উৎসাহিত করছে। বর্তমান বিশ্বে নগদ অর্থের সবচেয়ে কম লেনদেন হয় সুইডেনে। সুইডেনের পর নগদ অর্থ লেনদেনে শীর্ষ চারের তালিকায় আছে ফিনল্যান্ড, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাজ্য। আন্তর্জাতিকভাবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ কার্যক্রম তদারককারী সংস্থাগুলোও এ নীতি গ্রহণ করতে সদস্যদেশগুলোকে উৎসাহিত করছে। বাংলাদেশেও নগদ অর্থের লেনদেন কমানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশে ক্যাশবিহীন লেনদেন শুরু হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর জানুয়ারির তুলনায় গত ডিসেম্বরে দেশের ভেতরে ও বাইরে ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে মোট ৩ হাজার ২৫৩ কোটি ৭০ লাখ টাকা, যা এ-যাবৎকালে সর্বোচ্চ। আর নির্দিষ্ট একটি অঙ্কের বেশি লেনদেন হলেই তা অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে করতে হবে। ওই অঙ্কের নিচে হলে নগদ আকারে করা যাবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নগদ লেনদেন কমানো গেলে কর ফাঁকি, অর্থ পাচার বা সন্ত্রাসী কর্মকা- যেমন প্রতিহত করা সম্ভব হবে, তেমনি বেড়ে যেতে পারে সাইবার ক্রাইম। তুলনামূলকভাবে ক্যাশবিহীন লেনদেনের ঝুঁকি কম থাকায় সেদিকে অগ্রসর হওয়ার পরামর্শ তাদের। নগদ লেনদেন কমিয়ে আনা গেলে অপরাধলব্ধ অর্থের পরিমাণও নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //