১৭৬৪ থেকে ১৭৮৯ সালের মধ্যে বর্তমান বাংলাদেশে আসে মণিপুরীরা। মূলত সিলেটেই প্রথম বসতি তাদের। তারপর মণিপুর-বার্মা যুদ্ধের সময় (১৮১৯-১৮২৫) ব্যাপক হারে আগমন ঘটে মণিপুরীদের। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, ময়মনসিংহের দুর্গাপুর এবং ঢাকার তেজগাঁও এলাকায় মণিপুরী বসতি গড়ে উঠেছিল; যা সময়ের স্রোতে আজ নিশ্চিহ্ন। বর্তমানে এই জাতিসত্তার মানুষ বৃহত্তর সিলেটে বসবাস করছে।
নিজস্ব ভাষা, বর্ণমালা, সাহিত্য ও সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ছাড়াও তাঁত শিল্পে মণিপুরীদের রয়েছে দারুণ খ্যাতি। তাদেরই হাতে বোনা ‘মণিপুরী শাড়ি’ হাল আমলে বাঙালি নারীদের অন্যতম পছন্দের।
তবে শাড়ি মণিপুরীদের পোশাক নয় এবং তারা এক সময় শাড়ি বুনত না। তাদের আসল পোশাক হলো লাহিং বা ফানেক। এই পোশাকের সঙ্গে মণিপুরী নারীরা ফিতুপ বা ইনাফি নামের একটি ওড়না পরে থাকেন। ইনাফির উন্নত সংস্করণ যখন তৈরি করা হয়েছিল তখন তার নাম দেওয়া হয় ‘মৈরাংফি’। কারণ কারুকার্যখচিত এই ওড়না তৈরি হয়েছিল মৈরাং রাজ্যের রাজকুমারীর জন্য। তাই এর নাম রাখা হয়েছিল মৈরাংফি অর্থাৎ মৈরাংয়ের পোশাক। গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শুরুতে মৈরাংফি থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে মণিপুরী তাঁতিরা শাড়ি তৈরি শুরু করেন। কারণ শাড়ি তৈরি লাভজনক- বাঙালি নারীর প্রিয় পোশাক, ফলে বিক্রিও যে বহুগুণ বাড়বে তা তো অনুমেয়ই ছিল। তাঁতিদের বড় অংশই মণিপুরী নারী, নিজেদের পোশাক তৈরির পাশাপাশি তারা শাড়ি তৈরি করে থাকেন। মণিপুরী শাড়ির বৈচিত্র্যময় রঙের সংমিশ্রণ খুব সহজেই আকর্ষণ করে। এ শাড়ির মূল বৈশিষ্ট্য হলো জমিনের রঙ থেকে পাড়ের রঙ গাঢ় হয়। তাই অনেক দূর থেকেই নজর কাড়ে। প্রতিটি শাড়ির আঁচল, পাড় তৈরিতে ব্যবহৃত হয় উজ্জ্বল রঙের সুতা, আর জমিনে থাকে একটু হালকা রঙ। সম্পূর্ণ হাতে বুনন হয় বলে শাড়িগুলোর দুপাশে কোনো পার্থক্য থাকে না। এবং শাড়িগুলোর নকশাও একটি অন্যটির থেকে আলাদা হয়।
জামদানি বা মসলিন থেকে মণিপুরী শাড়ি তুলনামূলক সাশ্রয়ী। একেকটি শাড়ির দাম ১২০০ থেকে ৮ হাজার টাকার মধ্যে। দাম নির্ভর করে মূলত সুতা এবং নকশার ওপর। মণিপুরীদের শাড়ি বুননের প্রক্রিয়া অনেকটা জামদানি শাড়ির মতোই। কোনো প্রকার যন্ত্রের ব্যবহার ছাড়া কাপড় তৈরির সুতা হস্তচালিত চরকায় তৈরি করা হয়। তারপর নানা প্রক্রিয়া শেষে তাঁতে বোনা হয়।
মণিপুরী তাঁত শিল্পের যার পুরোটাই চলে মণিপুরীদের লোকজ্ঞানে। তারা নিজেরাই উদ্ভাবন করে চোখজুড়ানো সব নকশার। একটি শাড়ি তৈরি করতে দুজন মণিপুরী নারীর সময় লাগে ৭ থেকে ১৪ দিন। বাংলাদেশের তাঁত শিল্পের ইতিহাসে মণিপুরীরা আলাদা জায়গা তৈরি করে নিয়েছে প্রাচীন কাল থেকেই। শাড়ি ছাড়াও মণিপুরীরা নকশীকাঁথা এবং বকুলকাঁথাও তৈরি করে থাকে। এ ছাড়া ফানেক, শাল, ওড়না, থ্রি পিস, গামছা ইত্যাদি তো রয়েছেই। বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জায়গায় মণিপুরীদের হাতে বোনা কাপড়ের দোকান রয়েছে।
সিলেটে ঘুরতে আসা পর্যটকরা ভিড় করেন সেসব দোকানে। সিলেটের প্রবাসীদের হাত ধরে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেছে মণিপুরী শাড়ি ও তাঁত শিল্প।
কিন্তু শাড়ির চাহিদা বাড়লেও মণিপুরী তাঁতিরা অনেকেই এ পেশা থেকে সরে এসেছেন। এর কারণ যেসব ব্যবসায়ী সরাসরি তাঁতি পর্যায় থেকে শাড়ি কিনে থাকেন অধিকাংশই ন্যায্যমূল্য পরিশোধ করেন না, বাজার মূল্য থেকে অনেকটাই কমে তারা কেনার চেষ্টা করেন। তারপর দ্বিগুণ মূল্যে বিক্রয় করেন ক্রেতা পর্যায়ে। ফলে আশানুরূপ আয় করতে না পেরে, আয়ের বিকল্প উৎসের সন্ধানে অনেকেই তাঁতির পেশা ছেড়েছেন। শাড়ি তৈরির কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য যে অর্থের প্রয়োজন হয় সেটিও অনেক ক্ষেত্রে জোগানো সম্ভব হয় না। সব মিলিয়ে বছরের পর বছর ধরে পারিবারিকভাবে বয়ে আনা ঐতিহ্যবাহী এ পেশাটি ছাড়ছেন অনেকেই।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh