শুল্কযুদ্ধে অনিশ্চয়তায় পড়বে অর্থনীতি, আশঙ্কায় সিপিডি

বাণিজ্যিক দেশগুলোর পাল্টাপাল্টি শুল্কযুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক অবস্থা অনিশ্চয়তার মুখে পড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)।

রবিবার আগামী অর্থবছরের (২০২৫-২৬) বাজেট সুপারিশ নিয়ে সিপিডি ধানমন্ডির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে সংস্থাটির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন এমন আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

সংবাদ সম্মেলনে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম এবং সম্মাননীয় ফেলো মোস্তাফিজুর রহমান বক্তব্য দেন।

এরইমধ্যে আর্থিক অনিশ্চয়তায় পড়ছেন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ নাগরিকরা। বাণিজ্যিক অংশীদার দেশগুলোর পাল্টাপাল্টি শুল্ক বৃদ্ধির পদক্ষেপে মূল্যস্ফীতি ও মন্দার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এর প্রভাব পড়েছে মার্কিনদের কেনাকাটার ক্ষমতা ও আর্থিক আস্থায়।

শুল্কারোপের ফলে আমদানীকৃত পণ্যের ওপর কর বাড়ছে, যা বাড়িয়ে দিচ্ছে পণ্যের দাম। ফলে মূল্যস্ফতির আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। যাতে বাড়ছে জীবনযাত্রার ব্যয়। কিন্তু সে অনুপাতে বাড়ছে না মজুরি। ফলে মানুষ আর্থিকভাবে বেশি চাপের মধ্যে পড়ছে। এ অবস্থা দীর্ঘস্থায়ী হলে ভোক্তারা অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তায় ভুগবে। ফলে কমে যাবে দৈনন্দিন ব্যয়, যা অর্থনীতিকে আরো ধীর করে দিতে পারে। এতে অর্থনৈতিক মন্দা ঘটতে পারে।

বাংলাদেশ জ্বালানি নিয়ন্ত্রণ কমিশন গত মাসে নতুন শিল্পের জন্য প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম ৭৫.৭২ টাকা করার প্রস্তাব করেছে।

লিখিত বক্তব্য ফাহমিদা খাতুন বলেন, “প্রায় তিন বছর ধরে দীর্ঘস্থায়ী উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ব্যাপক দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পর্যায়ে, গ্যাসের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব গৃহীত হলে, মুদ্রাস্ফীতির পরিস্থিতির ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। শুল্ক যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতিতেও অনিশ্চয়তা আরও বাড়তে পারে।”

গ্যাসের দাম বৃদ্ধি হলে ২০২৫ সালের জুনের শেষ নাগাদ মুদ্রাস্ফীতি ৭-৮ শতাংশের মধ্যে রাখার বাংলাদেশ ব্যাংকের লক্ষ্য পূরণ না হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করে প্রতিষ্ঠানটি।

সিপিডির মতে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার একটি চ্যালেঞ্জিং সামষ্টিক অর্থনৈতিক পরিবেশের মধ্যে আগামী অর্থবছরের জাতীয় বাজেট প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। তাই বাজেটের তাৎপর্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ জন্য সদুরপ্রসারী এবং সমন্বিত প্রচেষ্টা প্রয়োজন।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি, রাজস্ব আদায়ে ধীরগতি, বাজেট বাস্তবায়নে ধীরগতি, ব্যাংকিং খাতে তারল্য সংকট এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাসের বৈশিষ্ট্যযুক্ত অর্থনীতির উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে বলেও মনে করেন সংস্থাটি।

সিপিডি এর মতে, রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহের নিম্ন গতি অর্থনৈতিক দুর্বলতাকে আরও বাড়িয়ে তুলেছিল। এই পরিস্থিতিতে, নীতিনির্ধারকদের জন্য সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধারই প্রধান উদ্বেগের বিষয়। মুদ্রাস্ফীতির চাপ মোকাবিলা, বিনিময় হার স্থিতিশীল করা এবং রাজস্ব বিচক্ষণতা নিশ্চিত করার জন্য লক্ষ্যবস্তু হস্তক্ষেপ প্রয়োজন।

ফাহমিদা খাতুন বলেন, “বাজেটে দুর্বল ও সুবিধাবঞ্চিত গোষ্ঠীর সুরক্ষা এবং অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।”

বছর শেষে বাজেট ঘাটতি নিয়ে সিপিডির পর্যবেক্ষণ হলো, “২০২৫ অর্থবছরের জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি যদি দেখি, সেটি খুবই দুর্বল। এই সময়কালে রাজস্ব সংগ্রহ হয়েছে মাত্র ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। গত বছরের আদায় যেহেতু কম হয়েছে, সেই ঘাটতি এবং এ বছরের জন্য যা নির্ধারণ করা হয়েছে তা বাকি সময়ে পূরণ করা অসম্ভব বিষয়।”

“আমরা মনে করি, বাকি অর্থবছরে আরও যেসব জায়গায় থেকে কর আদায়ের সম্ভাবনা রয়েছে। সেগুলো বিবেচনায় রেখেও আমরা যদি হিসাব করি, বছর শেষে বাজেট ঘাটতি ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকা পৌঁছাতে পারে” বলেন ফাহমিদা।

তিনি বলেন, “২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বরে বাজেট বাস্তবায়ন পরিস্থিতি, সেখানে আমরা দেখব যে, সেখানে মূল বাজেট ব্যবহারের হার ছিল ২৮ দশমিক ৩ শতাংশ। এটি ২০২৪ অর্থবছরের তুলনায় একটু বেশি। অন্যদিকে আমরা দেখি, ২০২৫ অর্থবছরের জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে এডিপি বাস্তবায়নের হার কমে গেছে। জুলাই-ডিসেম্বরে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ ২৯ হাজার ৫২৭ কোটি টাকা। যা ২০২৪ এর একই সময়ে অনেক কম ছিল।”

চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে ব্যক্তিশ্রেণির করদাতাদের বার্ষিক করমুক্ত আয়সীমা চার লাখ টাকায় বাড়ানোর সুপারিশ করেন তিনি। বর্তমানে একজন করদাতার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা আছে। ২০২৫-২৬ অর্থবছরে তা আরও ৫০ হাজার টাকা বাড়ানোর কথা বলেছে সিপিডি।

রাজস্ব আয় বাড়াতে সিপিডির পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, ভ্যাট ফাঁকি দেয়ার প্রবণতা কমাতে আগামী বাজেটে ভ্যাট হার ১৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা উচিত।

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্প এর শুল্কনীতির কারণে বাংলাদেশের ব্যাবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ হবে এমনটি মনে করেন না সিপিডির ফেলো মুস্তাফিজুর রহমান।

তিনি মনে করেন, ট্রাম্প চীনা পণ্যে শুল্কহার ২৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩৫ শতাংশ করেছেন। এতে আপাতদৃষ্টে বাংলাদেশের জন্য সুবিধা হবে বলে মনে করা হচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে সেটি হবে বলে মনে করেন না মুস্তাফিজুর রহমান। কারণ আমেরিকা চীন থেকে যেসব পণ্য আমদানি করে বাংলাদেশ তা উৎপাদন করে না। এ ছাড়া ২০১৬ সালেও ট্রাম্প প্রশাসন চীনা পণ্যে শুল্কহার ০ থেকে ১৫ শতাংশ করেছিলেন। তাতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়েনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh