পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্য কি সমাজের আর দশজন মানুষের চেয়ে আলাদা? তার কাছ থেকে কি আমরা একটু বেশি নৈতিকতা, একটু বেশি উন্নত রুচি ও শালীনতা প্রত্যাশা করব? এই প্রশ্নটি করেছিলাম একজন সিনিয়র সাংবাদিককে। তিনি বললেন, তিনি এই প্রত্যাশা করেন না। কেন করেন না- সেই ব্যাখ্যায় যাওয়ার আগে আমরা একটু দেখতে চাই, কেন কিছুদিন পরপরই আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা বিতর্কিত হন।
স্মরণ করা যেতে পারে, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ না পেয়ে প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের ‘রাজাকারের বাচ্চা’ বলে গালি দিয়েছিলেন উপাচার্য এসএম ইমামুল হক। এ নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডে বাঁধে এবং শিক্ষার্থীদের টানা ৩৫ দিনের আন্দোলনের পর ছুটি দেওয়া হয় ভিসিকে। নানা অনিয়মের অভিযোগ মাথায় নিয়ে আন্দোলনের মুখে ক্যাম্পাস ছাড়েন নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম অহিদুজ্জামান। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে বাধা দিয়েছিলেন এবং পদে থাকাকালীন তাদের ক্যাম্পাসে প্রবেশ করতেও দেননি।
রাতের আঁধারে পুলিশি পাহারায় বাসভবন ছেড়েছিলেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য একেএম নুরুন নবি। যিনি কোষাধ্যক্ষসহ একইসঙ্গে ১৪টি পদে একাই দায়িত্ব পালন করতেন। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, ক্ষমতার অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন ও সরকারের কাছে প্রতিবেদন দেয় তদন্ত কমিটি। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে তার উত্তরসূরি নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহও দিনের পর দিন অনুপস্থিত থেকে বিতর্কিত হয়েছেন।
সংবাদমাধ্যমের খবর বলছে, সবসময় ক্যাম্পাসে থাকার শর্তে নিয়োগ পেলেও অধ্যাপক নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ সব সময় ঢাকায় থাকেন। মাঝে মধ্যে সভা-সেমিনারে যোগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। প্রথম ৩৪০ দিনের কর্মকালে ২৫০ দিনই তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপস্থিত ছিলেন। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি মীজানুর রহমানকে নিয়েও কম বিতর্ক হয়নি। ‘বিশেষ কর্মকর্তার’ পদ তৈরি করে এবং নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি ছাড়াই ছাত্রলীগের ১২ জন নেতাকে নিয়োগ নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে।
সম্প্রতি উন্নয়ন প্রকল্পের অর্থ থেকে ছাত্রলীগকে চাঁদা দেওয়ার ইস্যুতে বিতর্কে জড়িয়ে পড়েছেন জাহাঙ্গীরনগরের ভিসি ফারজানা ইসলামও। অথচ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী উপাচার্য হিসেবে তার একটি অন্যরকম গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পর দলমত নির্বিশেষে সব মহল থেকেই তাকে অভিনন্দন জানানো হয়েছিল। ব্যক্তিজীবনে তিনি একজন সৎ মানুষ হিসেবেই পরিচিত ছিলেন। অথচ বিতর্ক তারও পিছু ছাড়েনি। বলা হচ্ছে, তার এই বিতর্কিত হওয়ার জন্য দায়ী তার স্বামী ও সন্তান। যদি তা-ই হয়, তাহলে উপাচার্য নিজে এর দায় এড়াতে পারেন না।
‘সিঙাড়া-চা-চপ-সমুচা’ নিয়ে বক্তব্য দিয়ে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আখতারুজ্জামান। তবে এই আলোচনাটি সীমাবদ্ধ ছিল রসিকতায়। কিন্তু এবার গণমাধ্যমে খবর এলো, তিনি বাংলোয় বসার জন্য যে দুটি চেয়ার ব্যবহার করেন, তার প্রতিটির দাম ৫০ হাজার টাকা। বাংলোর অভ্যর্থনা কক্ষে বিশালাকার টেবিলটি ঘিরে রয়েছে ৩৮টি মিটিং চেয়ার। চেয়ারগুলোর দাম ১৪ লাখ ৪৪ হাজার টাকা। অর্থাৎ বৈঠকের জন্য ব্যবহৃত একেকটি চেয়ারের দাম ৩৮ হাজার টাকা। আর টেবিলটির দাম ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা। এসব আসবাবপত্র নিশ্চয়ই ভিসি নিজে কেনেননি। কিন্তু যারা এই কেনাকাটায় দুর্নীতি করেছেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার কোনো আশ্বাস কি তিনি দিয়েছেন?
তবে এইসব বিতর্ক ছাপিয়ে গেছেন গোপালগঞ্জে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি খন্দকার নাসির উদ্দীন। অনেক দিন ধরেই তাকে নিয়ে বিতর্ক। অনিয়ম তো বটেই, নারী কেলেঙ্কারির অভিযোগও আছে তার বিরুদ্ধে। যে কারণে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে নামেন শিক্ষার্থীরা। সবশেষ বঙ্গবন্ধুর জন্মস্থানে তাঁর নামে স্থাপিত বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁরই ম্যুরাল নির্মাণে অনিয়মের খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ভিসি নাসিরউদ্দিনের রোষানলে পড়েন এক ছাত্রী, যিনি একইসঙ্গে একটি ইংরেজি দৈনিকের বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি। ওই ছাত্রী ফেসবুকে লিখেছিলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ কী?’ এর জেরে ভিসি তাকে ফোন করে শাসান এবং বলেন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ তোর মতো বেয়াদব তৈরি করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কী কাজ সেটা তোর বাপকে জিজ্ঞেস কর। গেছে কোনোদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে?’
এরপর আরেকটি অডিও ফাঁস হয়েছে, যেখানে শোনা যায় উপাচার্য আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ‘জানোয়ার’ বলে গালি দিচ্ছেন। একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক কী করে তার সন্তানতুল্য ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে এমন কদর্য ভাষায় কথা বলেন এবং তাদের বাবাকে অপমান করেন? অথচ উপাচার্য মহোদয়ের বেতন হয় ওই ছাত্রীর বাবার মতো সাধারণ মানুষের করের পয়সায়। কিন্তু তারা যখন ক্ষমতায় আরোহন করেন, তখন সেটাকে নিজের বাপ-দাদার সম্পত্তি মনে করেন। সারাজীবন তিনি সাধারণ মানুষের করের পয়সায় পড়ালেখা করলেন এবং চাকরির পরে সেই সাধারণ মানুষের করের পয়সাতেই বেতন পান। অথচ তাদের প্রতি যে ন্যূনতম সৌজন্যবোধ বা শালীনতা প্রদর্শনেরও প্রয়োজনবোধ করেন না। যদিও অধ্যাপক বললে আমাদের চোখের সামনে একজন শিক্ষিত, সজ্জন, সংস্কৃতিবান মানুষের মুখচ্ছবি ভেসে ওঠে।
এখন প্রশ্ন হলো, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বা উপাচার্যের কাছ থেকে আমরা সর্বোচ্চ নৈতিকতা ও শালীনতা প্রত্যাশা করব কি না? নিশ্চয়ই সবাই হ্যাঁ বলবেন। কিন্তু এটিও বাস্তবতা যে, ভিসিরা সমাজের বাইরের কেউ নন। যখন একটি সমাজ বা রাষ্ট্রের সর্বত্র অনিয়ম ও দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে, সেখান থেকে শিক্ষকরা মুক্ত থাকবেন, এমনটা প্রত্যাশা করা কঠিন। তাছাড়া পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো পদও যখন পলিটিক্যাল পোস্টে পরিণত হয়, অর্থাৎ সেখানে শিক্ষকের একাডেমিক ও প্রাতিষ্ঠানিক যোগ্যতা যা-ই থাকুক না কেন, দলীয় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে যেখানে তিনি ভিসি হতে না পারেন- সেখানে তার কাছ থেকে অন্য পেশার মানুষের চেয়ে বাড়তি নীতি- নৈতিকতা প্রত্যাশা করাও হয়তো ভুল।
যখন সব প্রতিষ্ঠানেই দলীয়করণ প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেয়েছে, সেখানে এই দুষ্টচক্র থেকে হয়তো বেরিয়ে আসা কঠিন। কিন্তু তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের মতো পদে কাউকে নিয়োগের আগে অন্তত তার প্রতিষ্ঠান চালানোর মতো দক্ষতা আছে কি না, তার অতীত কর্মকা-, তার আচার-আচরণ বিবেচনায় নেওয়া দরকার। বলা হয়, রাষ্ট্রের যে কোনো সমস্যার সমাধান রাজনীতিবিদদের হাতে। অর্থাৎ পলিটিকাল উইল বা রাজনৈতিক সদিচ্ছাই পারে যে কোনো বড় সংকটের সমাধান করতে। কিন্তু সেই রাজনীতিই যদি পথ হারায়, তখন তাকে সুপথে আনবে কে?
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh