ঢাবিতে ভাস্কর্যের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা

কুড়ি শতাব্দীর বিশের দশকের গোড়া থেকে পূর্ববঙ্গে উচ্চ শিক্ষার আলো জ্বেলে চলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি)। সৃষ্টিলগ্ন থেকে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের আছে গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস। বাংলায় মুসলমান সমাজে উচ্চশিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গঠনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা অগ্রগণ্য। 

৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬২’র শিক্ষা আন্দোলন, ৬৯’র গণঅভ্যুত্থান এবং ৭১’র স্বাধীনতা সংগ্রাম, ৯০’র দশকে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসহ সব ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন-সংগ্রামের সাথে মিশে আছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এসব সংগ্রামের গৌরব জানান দিতে বিভিন্ন সময়ে বিশ্ববিদ্যালয় আঙ্গিনায় গড়ে তোলা হয়েছে বেশ কিছু ভাস্কর্য। 

প্রতিটি ভাস্কর্যের পেছনে রয়েছে একেকটি সংগ্রামের গল্প। ভাস্কর্যগুলো মাথা উঁচু করে বলছে, এ ভূখ-ের মানুষের অধিকার, ত্যাগ ও মহিমার কথা। 

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দেশ ও জাতি গঠনে অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য, স্বোপার্জিত স্বাধীনতা বা স্বাধীনতা ভাস্কর্য থেকে শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীই নয়; গোটা জাতি ও জনগণের মননে ধারণ করার আছে অনেক কিছুই। বর্তমান সময়ে পরিবার, স্কুল-কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে খুব একটা ইতিহাস চর্চা না হওয়ায় ইতিহাসের প্রতি অবহেলা তৈরি হয়েছে। আর এ কারণেই তরুণদের অনেকে ভাস্কর্যগুলোর প্রেক্ষাপটই জানছে না; মননে ধারণ করা অনেক দূরের কথা! 

সরেজমিনে গিয়ে চার থেকে পাঁচজন দর্শনার্থীকে অপরাজেয় বাংলার প্রেক্ষাপট ও তার ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞেস করে একজনের কাছ থেকেও যথাযথ উত্তর পাননি এই প্রতিবেদক।

অপরাজেয় বাংলা

১৯৭১ সালে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামে নারী-পুরুষসহ সর্বস্তরের মানুষের সম্মিলিত প্রতিরোধ লড়াইয়ের ইতিহাস জানিয়ে দেয় যে ভাস্কর্যটি, তার নাম ‘অপরাজেয় বাংলা’। ভাস্কর্যটির নির্মাতা শিল্পী সৈয়দ আবদুল্লাহ খালিদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনের বেদিতে দাঁড়ানো তিন মুক্তিযোদ্ধার প্রতিমূর্তি যেন অন্যায় ও বৈষম্য দূর করে সাম্য প্রতিষ্ঠার গান গাইছে। ১৯৭৩ সালে ‘স্বাধীনতা ভাস্কর্য’ নামে এটির প্রাথমিক কাজ শেষ হয়। পরে লোকমুখে পরিচিতি পায় ‘অপরাজেয় বাংলা’ হিসেবে। বহু আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র এটি। ভাস্কর্যটির মডেল ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা বদরুল আলম বেনু, সৈয়দ হামিদ মকসুদ ফজলে। আর নারীমূর্তির মডেল ছিলেন হাসিনা আহমেদ।

স্বোপার্জিত স্বাধীনতা

১৯৭১ সালের দীর্ঘ নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির মহাকাব্য। দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে অর্জিত হয় স্বাধীনতা। ত্যাগের বিনিময়ে এই অর্জনকে স্মরণ রেখেই টিএসটির সড়কদ্বীপে নির্মিত হয় ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’। এটি নির্মাণ করেন ভাস্কর শামীম শিকদার। ১৯৮৮ সালের ২৫ মার্চ এ ভাস্কর্যের নির্মাণকাজ শেষ হয়।

রাজু ভাস্কর্য

১৯৯৭ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর তৈরি হওয়া এই ভাস্কর্য বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্ত্রাসবিরোধী আন্দোলনের নিদর্শন। শ্যামল চৌধুরী ও সহযোগী গোপাল পাল এ ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। উল্লেখ্য, ১৯৯২ সালের ১৩ মার্চ ঢাবির ক্যাম্পাসে দখলদারিত্বের রাজত্ব কায়েম করার প্রতিবাদ করতে গিয়ে নিহত হন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মঈন হোসেন রাজু। তার স্মৃতি রক্ষার্থে ভাস্কর্যটি নির্মাণ করা হয়।

স্বাধীনতা সংগ্রাম

বাংলাদেশের সবচেয়ে অধিক ভাস্কর্যের সমাহারের নাম ‘স্বাধীনতা সংগ্রাম’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের পশ্চিম ফুলার রোডের সড়কদ্বীপে স্থাপন করা হয়েছে এই ভাস্কর্য। এই সড়কদ্বীপে রাখা হয়েছে আরও অনেক ভাস্কর্য। এক জায়গায় এত ভাস্কর্য দেশের আর কোথাও নেই। মূল ভাস্কর্যটিতে ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ তথা বিজয়ের আনন্দ ঠাঁই পেয়েছে। ভাস্কর্যের সবচেয়ে উঁচুতে বন্দুকের সঙ্গে বাংলাদেশের লাল-সবুজের পতাকা বাঁধা। ভাস্কর্যটিতে ৪২টি বাতি, একটি সংকেত বাতি, একটি লাইটিং ও পানির পাম্প এবং ছয়টি পানির ফোয়ারা সংযুক্ত করা আছে। ভাস্কর্যগুলোর নির্মাতা শামীম শিকদার।

দর্শনার্থীর বয়ান

সরেজমিনে গিয়ে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে দেখা মেলে কয়েকজন দর্শনার্থীর। তাদের মধ্যে একজন নাজমুল সোহাগ। তিনি এসেছেন পুরান ঢাকা থেকে। পড়াশোনা করেন একাদশ শ্রেণিতে। অপরাজেয় বাংলা সম্পর্কে কী জানেন- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘এটি সৌন্দর্যের জন্য রাখা হয়েছে। এটার নাম মূর্তি।’

সাথে থাকা আরেকজন বলেন, ‘এসব তো ভাষা শহীদদের মূর্তি।’ তাদের কেউই এই প্রতিবেদককে যথাযথ উত্তর দিতে পারেননি অপরাজেয় বাংলা সম্পর্কে।

শিক্ষাবিদদের মতামত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্য বিভাগের অনারারি অধ্যাপক মো. হামিদুজ্জামান খান বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য নির্মাণ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অপরাজেয় বাংলা আব্দুল্লাহ খালিদ অনেক সময় নিয়েই নির্মাণ করেছেন। তখন তো অত চিন্তা-ভাবনা করে করা হয়নি যে, এটি একটা স্কাল্পচার হবে। মূলত শিক্ষার্থীদের গণদাবি থেকেই তৈরি হয়েছে। ছাত্র সংসদের চাওয়া থেকেই তৈরি হয়েছে। এরপর শামীম শিকদার টিএসসির সড়কদ্বীপে স্বোপার্জিত স্বাধীনতা এবং ফুলার রোডে উদয়ন স্কুলের সামনে স্বাধীনতা সংগ্রাম নির্মাণ করেছেন। এছাড়া আরো অনেক ভাস্কর্য আছে ক্যাম্পাসে।’ 

তবে এগুলো আরো গোছানো এবং যথাযথভাবে নির্মাণ করা উচিত বলে তিনি মন্তব্য করেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘পৃথিবীজুড়ে জাতীয় চেতনা বলতে আমরা যা বুঝি, তার প্রচারণামূলক বা তার ধারণমূলক ভাস্কর্য নির্মাণের প্রবণতা খুবই বেশি। আমাদের দেশের ভাস্কর্যের চর্চা খুব বেশি পরিমাণে আমাদের জাতীয়তাবাদী ধারণার সঙ্গে যুক্ত; মানে আমাদের রাষ্ট্রীয় এবং জাতীয় যে ইতিহাস, অনুপ্রেরণা, শক্তি এসবের সঙ্গে। যেমন ধরা যাক, অপরাজেয় বাংলা। এটি এক ধরনের তাৎপর্য অর্জন করেছে। যার সামনে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ হয়; বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় প্রোগ্রাম হয়।’ তিনি আরো বলেন, ‘রাজু ভাস্কর্যের সামনে আবার দীর্ঘদিন ধরে বাম ঘরানার প্রতিবাদী আন্দোলন-সংগ্রাম হয়ে আসছে। এটির অবস্থান অপেক্ষাকৃত মূল সড়কের মধ্যে। ফলে এর আরেক ধরনের তাৎপর্য রয়েছে।’ 

তবে ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে গড়ে উঠলেও ভাস্কর্যগুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নায়ক হয়ে উঠেছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষের এসব থেকে কী শেখার আছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে মোহাম্মদ আজম বলেন, ‘ব্যাপারটি সরাসরি শেখার নয়; ব্যাপারটি হলো প্রথমত, যে অ্যাটমোসফেয়ারের মধ্যে ভাস্কর্যটি আছে, সেই জায়গার সৌন্দর্যের সঙ্গে ভাস্কর্যটি য্ক্তু। দ্বিতীয়ত, ভাস্কর্য হলো একটা জায়গার চিহ্নায়ক। যেমন- নিউইয়র্ক সিটিতে স্বাধীনতার ভাস্কর্য, অপরাজেয় বাংলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চিহ্নায়ক। অর্থাৎ এখানে যারা আসবেন, তারা ভাস্কর্যগুলো থেকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত হবেন।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজীমউদ্দিন খান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে সবাই শিখতে ও জানতে আসে। ভাস্কর্যগুলো কোন প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছিল, তার একটি ছোট বর্ণনা থাকতে হবে। ভাস্কর্যটি কে নির্মাণ করেছেন, কেন নির্মাণ করেছেন, কোন প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়েছে, সেই সময়কালটা কী- এটি তো মুখের ইতিহাসে চলবে না। এর একটি লিখিত ইতিহাস থাকতে হবে। সাধারণত ভাস্কর্যে ছোট করে হলেও এই ইতিহাস থাকে; কিন্তু আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যগুলোতে এটি নেই। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই কাজটি একটা নির্দিষ্ট বিভাগকে দিয়ে করাতে পারতো। যেমন ইতিহাস বিভাগ এই দায়িত্ব নিতে পারতো; কিন্তু সেটা করা হয়নি। প্রতিবাদী সংস্কৃতিতে একটা প্রতিষ্ঠান কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তার বড় উদাহরণ। অথচ সেই ইতিহাস ভাস্কর্যে ধারণ করে তার লিখিত ব্যাখাসহ স্থাপন করার কাজটি বিশ্ববিদ্যালয় করতে পারেনি।’

সাধারণ মানুষ ভাস্কর্যগুলো থেকে চেতনা ধারণ করতে পারছেন কিনা- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘ভাস্কর্যগুলো কিসের প্রতীক- তা যদি না জানি, তাহলে আমার ওই বোধটুকু কীভাবে জন্মাবে।’ 

রাজু ভাস্কর্যের প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরো বলেন, ‘এটি তো সন্ত্রাসবিরোধী ভাস্কর্য; কিন্তু কী প্রেক্ষাপটে এটি নির্মিত হলো, রাজু কে, তিনি কীভাবে গুলিবিদ্ধ হলেন- সেটির সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা তো থাকতে হবে। আমাদের কলা ভবনে যে ১৯৫২, ৬৬, ৬৯ লেখা আছে পাথরে। এই লেখাটি কেন এলো, তার একটি বর্ণনা থাকা দরকার, যা নেই। আরেকটা ব্যাপার হলো- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস তো ১৯৫২ সাল থেকে শুরু হয়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকাল থেকে, অর্থাৎ ১৯২১ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত অনেক তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা আছে, সেগুলো কোথায়? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়কে বুঝতে হবে ১৯২১ সাল থেকে। এর মধ্যে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন আছে। আমাদের ইতিহাস তো শুধু ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত না। তার আগেও আমাদের ইতিহাস আছে। সেটি কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় ভাস্কর্যে ধারণ করতে পারেনি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাস্কর্যগুলো সম্পর্কে তরুণ প্রজন্ম খুব একটা জানে না- এ বিষয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. নাদির জুনাইদ বলেন, ‘সমাজের পুরো চিত্রের আলোকে এটিকে ব্যাখ্যা করতে হবে। ক্যাম্পাসে নূর হোসেনের ভাস্কর্য আছে; কিন্তু নূর হোসেনকে কতজন চিনেন। হয়তো নামটা জানেন; কিন্তু নূর হোসেন কোন প্রেক্ষাপটে মারা গেছেন, কোনদিন মারা গেছেন- সেটি অনেকেই জানেন না। ডা. মিলনের কথাই যদি বলি- তার স্মরণেও বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্য আছে; কিন্তু ডা. মিলনকে কতজন চেনেন ক্যাম্পাসে। আবার রাউফুন বসুনিয়ার ভাস্কর্য আছে ক্যাম্পাসে। তাকেই বা কতজন চেনেন। এই না জানার সংস্কৃতি আসলে ইতিহাসের প্রতি যে অবহেলা তৈরি হয়েছে সমাজে, সেটিরই প্রতিফলন।’ 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এই ভাস্কর্যগুলোর প্রেক্ষাপট না জানার কারণ হলো ইতিহাসের চর্চা কমে যাওয়া। এখন ইতিহাসের কোনো চর্চাই নাই। ভাস্কর্য জানার বা বোঝার আগে তো ইতিহাস জানতে হবে। সেই চর্চাটুকুই এখন নেই।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //