তীব্র সেশনজটে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, ক্ষোভ শিক্ষার্থীদের

দক্ষিণবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ খ্যাত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) শিক্ষার্থীরা ভুগছেন তীব্র সেশনজট সমস্যায়। এর মূলে রয়েছে শ্রেণীকক্ষ ও শিক্ষক সংকট, পরীক্ষা কমিটি ও নিয়ন্ত্রক দফতরের গাফিলতি আর শিক্ষকদের সদ্বিচ্ছার অভাব। এসব কারণে দীর্ঘায়িত হচ্ছে হাজারো শিক্ষার্থীর শিক্ষাজীবন।

এরই মধ্যে চরম সংকটে পড়েছেন স্নাতক শেষ পর্বের শিক্ষার্থীরা। করোনাভাইরাস পরিস্থিতিতে দীর্ঘদিন পরীক্ষা আটকে থাকায় তাদের মধ্যে বাড়ছে হতাশা। তাই শিক্ষাজীবন দীর্ঘায়িত রোধের সর্বশেষ উপায় হিসেবে আন্দোলনের পথ বেছে নিতে যাতেন তারা। অবশ্য বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন দাবি করেছে চলমান সমস্যাগুলো নিরসনে কাজ করছেন তারা।

শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মিত ক্লাস না হওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সেশনজটের একটি অন্যতম কারণ। ক্লাস না হবার পিছনে ক্লাসরুমের অভাব ও শিক্ষক সংকটকে দায়ী করেছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছয়টি অনুষদের ২৪টি বিভাগে বর্তমানে ১৯৩ জন শিক্ষক কর্মরত আছেন। এছাড়া দুটি একাডেমিক ভবনে ক্লাস রুম রয়েছে মোট ৩৪টি। বেশিরভাগ বিভাগের ক্লাস নেয়ার জন্য বরাদ্দ মাত্র একটি কক্ষ। আর বিভাগ প্রতি শিক্ষক সংখ্যায় তুলনামূলক কম।

বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী জিয়াউল হক জিহাদ বলেন, প্রয়োজনের তুলনায় আমাদের প্রতিটি বিভাগে শিক্ষক ও শ্রেণীকক্ষ সংকট। তার ওপর করোনার নয়মাসে শিক্ষা কার্যক্রম এক প্রকার বন্ধ হয়ে আছে। যে কারণে আমরা বড় ধরনের সেশনজটের সম্মুখীন হচ্ছি।

অপরদিকে, শিক্ষকদের সদ্বিচ্ছার অভাবকেও দুষছেন অধিকাংশ শিক্ষার্থী। তারা বলছেন, ‘প্রাণঘাতী করোনা সংক্রমণের কারণে গত মার্চ থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে গত মে মাস থেকে অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেয় প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। তবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে থেকে অভিযোগ উঠেছে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে কোনো উদ্যোগ নেননি কিছু শিক্ষক।

অন্যদিকে শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে স্বাভাবিক সময়েও নিয়মিত ক্লাস নেয়ার ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন। যে কারণে চরম সেশনজটে ভুগতে হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। এমনকি এ ব্যাপারে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কথা বলার মতো পরিস্থিতিও নেই সেখানে। কারণ ৪০ শতাংশ নম্বর বিষয়ভিত্তিক শিক্ষকদের হাতে থাকায় তাদের বিরুদ্ধে কথা বললে তার প্রভাগ গিয়ে পরীক্ষার ফলাফলের ওপর পরে বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘উপাচার্যের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও তাদের বিভাগের একাধিক শিক্ষক বিগত ছয়মাসে অনলাইনে কোনো ক্লাস নেননি।’

অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান বলেছেন, ‘কিছু শিক্ষক আছেন যারা নির্ধারিত সময়ে ক্লাস কিংবা পরীক্ষাও নেন না। যে কারণে গুটি কয়েক শিক্ষকের জন্য গোটা সেমিস্টার সমাপ্তিতে বিলম্ব হয়। এর প্রভাব পড়ে শিক্ষাজীবনে।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিভাগে সেমিস্টার হিসেবে পড়ানো হয়। হিসেব অনুযায়ী প্রতিবছর দুটি সেমিন্টার অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। স্নাতকের চার বছরে প্রতিটি শিক্ষার্থীকে শেষ করতে হবে আটটি সেমিন্টার। এর বাইরে কিছু বিভাগে ইয়ার (৬০-৭০ শতাংশ নম্বরের বছরে একটি বার্ষিক পরীক্ষা) ব্যবস্থা চালু আছে।

প্রতিটি সেমিন্টার বা বার্ষিক পরীক্ষার জন্য বিভাগীয় শিক্ষকদের নিয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি নির্ধারিত সময়ে প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ, উত্তরপত্র মূল্যায়ন বিষয়ক সিদ্ধান্ত ও ফলাফল প্রকাশ করে থাকে। এ কমিটিকে সহায়তা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দফতর।

বিশেষ করে প্রশ্নপত্র মডারেশন, পরীক্ষার তারিখ নির্ধারণ, উত্তরপত্র মূল্যায়নের জন্য বহিঃশিক্ষকদের কাছে পাঠানো ও ফলাফল প্রকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এ দফতরটি।

কিন্তু পরীক্ষা কমিটি আর দফতরের গাফিলতিতে বিলম্বিত হচ্ছে শিক্ষাবর্ষ, এমন অভিযোগ কিছু শিক্ষার্থীর। বাংলা, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা এবং রসায়ন বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, ‘একটি সেমিস্টার শুরু করে পরীক্ষা গ্রহণ এবং ফলাফল প্রকাশে প্রায় আটমাস অতিবাহিত করে পরীক্ষা কমিটি ও নিয়ন্ত্রক দফতর। প্রতি সেমিস্টারে যদি গড়ে তিনমাস বিলম্ব হয়, তবে স্নাতক শেষ করতে অতিরিক্ত দুই বছর লেগে যাবার সম্ভাবনা থেকে যায়।’

ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান এবং কম্পিউটার ও প্রকৌশল বিজ্ঞান বিভাগের ২০১৪-১৫ সেশনের শিক্ষার্থীদের স্নাতক পর্যায়ের সর্বশেষ সেমিস্টার পরীক্ষা আটকে আছে প্রায় এক বছর। কিন্তু তাদের স্নাতক শেষ হয়ে যাবার কথা দুই বছর আগেই। এই শিক্ষার্থীরা কদিন যাবত কয়েকবার করে বিভাগীয় শিক্ষক, চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের সাথে দেখা করে তাদের সমস্যার কথা জানিয়ে সমাধানের প্রত্যাশা করেছেন। দ্রুত সমাধান না আসলে আন্দোলনে যাওয়ারও প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।

মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিনের সেশনজটে চাকরির বয়স হারাচ্ছি আমরা। স্নাতকের শেষ পরীক্ষা আটমাস যাবত আটকে থাকায় একের পর এক সরকারি চাকরির বিজ্ঞপ্তি চলে গেলেও আবেদন করতে পারছি না। দ্রুত এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রশাসন সহায়তা না করলে আমরা আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো।’

সমস্যা ও সমাধান প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার (অতিরিক্ত দায়িত্ব) ড. মুহসিন উদ্দীন বলেন, ‘বিগত দেড় বছর যাবত ইউজিসি প্রভাষক ও সহকারী অধ্যাপক পদে নিয়োগের জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে ছাড়পত্র দেয়নি। অন্যদিকে অধ্যাপক ও সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হলেও যোগ্য প্রার্থী আবেদন করেন না। যে কারণে শিক্ষক সংকট বেশ বড় আকার ধারণ করছে।

তিনি বলেন, বর্তমান একাডেমিক ভবনের সমমানের আরো তিনটি ভবন করার জন্য পরিকল্পনা ইউজিসিতে পাঠানো হয়েছে। বরাদ্দ অনুযায়ী নির্মাণ কাজ শুরু হবে। একইসাথে শিক্ষকরা যেন নিয়মিত ক্লাস কার্যক্রম এগিয়ে নেন সে ব্যাপারে ইতিমধ্যে তদারকি শুরু হয়েছে।’

এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, চলতি সপ্তাহে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ বর্ষের শিক্ষার্থীদের বিষয়ে আলোচনা করা হবে। জরুরি ভিত্তিতে একাডেমিক কাউন্সিলের সভা আহ্বানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, মহামারি পরিস্থিতিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের সুলভ মূল্যে ইন্টারনেট ও ডিভাইস দেয়ার ব্যাপারটি প্রক্রিয়াধীন। এ বিষয়টি শিক্ষাজীবনের দীর্ঘসূত্রিতা রোধে ভূমিকা রাখবে বলে আমার প্রত্যাশা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //