ঢাবি শিক্ষার্থীদের মধ্যে ‘আত্মহত্যা’র প্রবণতা বাড়ছে

বয়স ও লিঙ্গ নির্বিশেষে মানুষের মধ্যে মানসিক সমস্যায় নাটকীয় উত্থানের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে করোনাভাইরাস মহামারি। আর কভিডের কারণে সৃষ্ট মানসিক চাপকে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।

তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যা ও নিজের ক্ষতি করার প্রবণতা উদ্বেগের বিষয়।

ঢাবির পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের ২৮ ডিসেম্বরের মধ্যে ৩৯ জন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। তবে ২০২০ সালে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে আত্মহত্যার প্রবণতা। সদ্য শেষ হওয়া বছরটিতে ঢাবির ১০ শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেছে। এর মধ্যে সর্বশেষ ছিল প্রাণিবিদ্যা বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম সিয়ামের মৃত্যু।

গত ২৮ ডিসেম্বর তৌহিদুল ঢাকার মোহাম্মদপুরে নিজ বাসায় আত্মহত্যা করেন। তার সহপাঠীদের দাবি, তৌহিদ কেবল পড়ালেখা নিয়েই নয়, তার ব্যর্থ প্রেম নিয়েও হতাশায় ভুগছিলেন। 

তৌহিদের আত্মহত্যার ঘটনা নিশ্চিত করে দুঃখ প্রকাশ করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী।

গত ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর আজিমপুর সরকারি স্টাফ কোয়ার্টারে রুমানা ইয়াসমিন (৩০) নামে এক আনসার কর্মকর্তা গলায় ফাঁস দিয়ে আত্মহত্যা করেন। ৩৭তম বিসিএসের রুমানা ইয়াসমিন আনসার বাহিনীর সহকারী পরিচালক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান বিভাগের ১৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিয়ে নিয়ে পরিবারের সাথে মনোমালিন্য হওয়ায় রুমানা হতাশাগ্রস্থ ছিলেন বলে জানা যায়।

গত ২৬ অক্টোবর আত্মহত্যা করেন ঢাবির ইংরেজি বিভাগের শিক্ষার্থী ফারিহা তাবাসসুম রুম্পা। তার এক সহপাঠী জানান, রুম্পার পরিবার তার পছন্দের ছেলের সাথে সম্পর্ক মেনে নেয়নি ও পরে অন্য ব্যক্তির সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছিল।

২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে আত্মহত্যা করেন ঢাবির তিন শিক্ষার্থী। পারিবারিক কলহের জের ধরে ২৪ সেপ্টেম্বর আত্মহত্যা করেছিলেন ম্যানেজমেন্টের শিক্ষার্থী জাকারিয়া হক শুভ। এর মাত্র তিন দিন আগে নিজের জীবন কেড়ে নেন ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বিভাগের শিক্ষার্থী কামরুল বাহার।

গত ১১ সেপ্টেম্বর রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ছাত্র আসিফ ইমতিয়াজ খান জিসাদ আত্মহত্যা করেন। তবে তাকে হত্যা করা হয়েছিল বলে অভিযোগ রয়েছে পরিবার ও সহপাঠীদের। এ মামলার তদন্ত চলছে। এছাড়া চাকরি না পেয়ে গত ২ এপ্রিল আত্মহত্যা করেন ঢাবির দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থী তরুন সেন।

কভিড দ্বারা উত্থাপিত মানসিক চাপকে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নির্দেশনা ও পরামর্শ দান দফতরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও এডুকেশনাল এবং কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের চেয়ারপারসন অধ্যাপক মেহজাবীন হক বলেন, হতাশা, ব্যক্তিত্ত্বজনিত সমস্যা ও বিভিন্ন মানসিক রোগের কারণে বেশিরভাগ মানুষ আত্মহত্যা করেন। সময়মতো এই ব্যাধিগুলোর যত্ন নেয়া গেলে আমরা সহজেই আত্মহত্যার সংখ্যা কমিয়ে আনতে পারি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং অফিসের তথ্য অনুযায়ী, গত বছরের এপ্রিল থেকে অক্টোবরের মধ্যে প্রায় ৩৫৮ জন শিক্ষার্থী মানসিক সহায়তা চেয়েছেন। তাদের মধ্যে ৯০ জন হতাশায় ভুগেছে, ৮১ জন উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছে ও ৫২ জন সম্পর্কের টানাপোড়েনের কথা জানিয়েছেন। বাকিরা অন্যান্য মানসিক সমস্যায় ভুগছিলেন।

অধ্যাপক মেহজাবীন বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নোট লেখা বা হতাশা প্রকাশ করা আত্মহত্যার কথা ভাবা মানুষের প্রত্যক্ষ বা অপ্রত্যক্ষ ইঙ্গিত। তাদের কথা আমাদের শুনতে হবে, তাদের আশ্বস্ত করতে হবে যে তারা একা নয়, তাদের জীবন মূল্যবান। ভবিষ্যতের বিষয়ে উদ্বিগ্ন না হয়ে বর্তমানের দিকে মনোনিবেশ করতে হবে যা আমাদের ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের আশাবাদী হতে হবে।

শারীরিক অসুস্থতার মতো মানসিক অসুস্থতার চিকিৎসার প্রয়োজনীয়তার ওপরও জোর দিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় এই মনোবিজ্ঞানী।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ড. মেহতাব খানম বলেন, কেস বিশ্লেষণ না করে কভিড চলাকালীন আত্মহত্যা বা এ ধরনের প্রবণতার পেছনের কারণ চিহ্নিত করা খুব কঠিন। তবে কেউ যদি আত্মঘাতী হয়ে ওঠে পরিস্থিতি আরো ভালোভাবে মোকাবিলায় তাদের ব্যস্ত রাখা আমাদের কর্তব্য।

এ সমস্যার বিষয়টি স্বীকার করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক ড. এ কে এম গোলাম রাব্বানী বলেন, এটি গভীর উদ্বেগের বিষয় যে আমাদের মেধাবী শিক্ষার্থীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। আমি তাদের অনুরোধ করব তারা যেন জীবনকে এভাবে উপেক্ষা না করে। তাদের জানা উচিত, পরিবার ও জাতি উভয়ের কাছেই তাদের জীবন মূল্যবান।

ঢাবির উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, আত্মহত্যার প্রবণতা কমাতে সহায়তা করার জন্য পরিবার, বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের এগিয়ে আসতে হবে। কারণগুলো খুঁজে বের করে আত্মহত্যা বা এ জাতীয় চিন্তাভাবনা কমাতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।- ইউএনবি

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //