ঢাবির হল প্রশাসনের অধীনে নয়, থাকে ‘ভাইদের আন্ডারে’

‘ওখানে বড় ভাইরা থাকে। তাদেরকে জবাবদিহিতা দিতে হয়, প্রোগ্রামে গেলি না কেন, আস্তে হাততালি বা শ্লোগান দিলি ক্যান? বকাঝকা করা হয়।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে ‘গেস্টরুম কালচার’ বলে পরিচিত কার্যক্রমে কী হয়, তার বর্ণনা দিচ্ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক আবাসিক ছাত্র। তার অনুরোধে তার আসল নাম পরিচয় গোপন রাখা হচ্ছে। ধরুন তার নাম অনিক।

ক্যাম্পাসে যখন তার সাথে কথা হয় তখন তার সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করতে গেলে কিছুটা ইতস্তত বোধ করেন তিনি। পরে অনুরোধ করেন, এমন জায়গায় সাক্ষাৎকারটি রেকর্ড করতে যেখানে তাকে কেউ দেখবে না।

তার সুবিধা মতো জায়গায় নিয়ে যেতে বললে অনিক তার আরো তিন বন্ধুর সাথে একটি ভবনের গ্যারেজে নিয়ে যান আমাকে। সেখানে গিয়ে বলতে থাকেন তার হল জীবনের অভিজ্ঞতা। তিনি বলেন, গণরুমে থাকতে হয় আর যেহেতু আমরা ফার্স্ট ইয়ার, তাই সবাই আমাদের উপর কর্তৃত্ব চালায়। আমাদের দিয়েই সবকিছু করায়। বিভিন্ন পলিটিক্যাল প্রোগ্রাম হয়, সেগুলোতে অংশ নিতে হয়, বাধ্যবাধকতা অবশ্যই আছে। আর আমাদের ক্লাস মিস দিতে হয়। রিডিং রুম থেকে ধরে নিয়ে আসা হয়।

বাংলাদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে থাকা সাধারণ শিক্ষার্থীরা অভিযোগ করেছেন যে তাদেরকে নানা ধরণের হেনস্তার শিকার হতে হয়। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা অভিযোগের আঙুল তোলেন ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ছাত্র-সংগঠন ছাত্রলীগের দিকে।

তাদের অভিযোগ, হল প্রশাসন নয় বরং রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরাই নিয়ন্ত্রণ করে আবাসিক হলগুলো। আর এই পরিস্থিতি দিনের পর দিন ধরে চলছে।

অনেকটা একই ধরণের অভিযোগ করছিলেন আরেক শিক্ষার্থী সাদিক। এখানেও তার নামটি বদলে দেয়া হয়েছে তার নিরাপত্তার জন্য। প্রথম বর্ষের এই শিক্ষার্থী হল জীবনের অভিজ্ঞতা বলতে গিয়ে কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। জানান, হলে থাকার বিনিময়ে বড় ভাইদের নির্দেশ মানতে হয় সবার আগে। আর হল কর্তৃপক্ষ বা প্রশাসন তাদের কোন কাজে আসে না। এখানে হচ্ছে কি, ভাইদের আন্ডারে, লিডারদের আন্ডারে থাকে।

সাদিক অভিযোগ করে বলেন, হলটা একটি অনিশ্চিত জায়গা হয়ে গেছে। সেখানে থেকে যেকোনো সময় যে কাউকে বের করে দিতে পারে হলের নিয়ন্ত্রণে থাকা রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনের নেতারা। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে প্রশাসনেরও এ বিষয়ে তেমন কিছু করার থাকে না। প্রভোস্ট যারা, কর্তৃপক্ষ- দে আর জাস্ট ফর শো (স্রেফ লোক দেখানো), তারা একটা নামেমাত্র পুতুল।

তিনি বলেন, হলে ওঠার পর তিনি লক্ষ্য করেন যে, সেখানে আলাদা আলাদা সম্প্রদায় তৈরি হয়ে গেছে। সেখানে অন্যরা সেগুলো যেমন মেনে চলে ঠিক, তেমনি তাকেও জোর করে মেনে চলতে বাধ্য করে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধমক দিবে, বলবে তোর সিট নাই, সিট পাবি না। আপনি কোন কমিউনিটির না হলে আপনার কিছুই হবে না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মোক্তার আহমদ। তিনি জানান, হলগুলোতে থাকার সময় গেস্ট-রুম করানোর মতো নানা ধরণের অভিজ্ঞতা হয়েছে তার।

তিনি অভিযোগ করেন, অনেক সময় সাধারণ শিক্ষার্থীদের শারীরিক নির্যাতন করা হতো। এরকম অনেক ঘটনা তিনি হতে দেখেছেন উল্লেখ করে নিজের গেস্ট-রুম অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, রাতে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হত। সেখানে দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বড় ভাইদের কথা শুনতে হতো, জবাবদিহি করতে হতো। এরপর রাতের বেলা হল থেকে বের করে দেয়া হত। বলতো যে, রাত বাইরে থেকে ভোর চারটায় হলে যেতে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলগুলোতে থাকা যেসব শিক্ষার্থীর সাথে কথা হয় তাদের মধ্যে বেশিরভাগই বলেছেন যে, হলে তাদেরকে যে ধরণের অনাকাঙ্ক্ষিত অভিজ্ঞতার শিকার হতে হয় তা বেশিরভাগ সময়ই বাবা-মায়ের কাছে জানান না তারা।অভিভাবকরা যাতে কোন ধরণের দুশ্চিন্তায় না থাকেন সেটিই চান তারা।

তবে সম্প্রতি বুয়েট শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদ হত্যাকাণ্ডের পর অনেক অভিভাবকই এ বিষয়ে সচেতন। থাকেন দুশ্চিন্তাতেও। এমনই একজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হাসনা বেগম। তার ছোট ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনা করেন। থাকেন একটি আবাসিক হলে।

হাসনা বেগম জানান, সম্প্রতি নানা উদ্বেগ পেয়ে বসে তাকে। আবরার ফাহাদের মৃত্যুর পর এখন অনেক চিন্তা। অনেক কিছু, ভয় থাকে, মনডা ওইদিক পইড়া থাকে, কোন দিন আবার কোন খবর আসে।

আবাসিক শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতির মুখে পড়ার অভিযোগ স্বীকার করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব হলের আবাসিক শিক্ষক জোবাইদা নাসরীন। তিনি বলেন, ভয়ের কারণে বেশিরভাগ সময়েই হল প্রশাসনের কাছে এ ধরণের অভিযোগ আসে না। শিক্ষার্থীরা মনে করে যে, একবার অভিযোগ দিলে পরবর্তীতে তাকে আরো বেশি অপদস্থ হতে হবে, আরো সমস্যায় পড়তে হবে। এজন্য অভিযোগ করে না। ভয়ের একটা সংস্কৃতি আছে।

নৃবিজ্ঞান বিভাগের এই শিক্ষক বলেন, হল পরিচালনার ক্ষেত্রে হল প্রশাসনকে অনেক ক্ষেত্রেই দলীয় ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতা-নেতৃদের সাথে লিয়াজোঁ রক্ষা করতে হয়। হলের যিনি প্রভোস্ট থাকেন তিনি নিজেই এসব নেত্রীদের সাথে যোগাযোগ করেন। অনেক ক্ষেত্রেই তাদের সাথে লিয়াজোঁ করতে হয়।

তবে আবাসিক হলগুলোতে সাধারণ শিক্ষার্থীদেরকে জোরপূর্বক রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন। তিনি বলেন, আবাসিক হলগুলো থেকে বাধ্য হয়ে নয় বরং স্বেচ্ছায় বিভিন্ন রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। কারণ সাধারণ শিক্ষার্থীদের কল্যাণেই তারা বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচি নিয়ে থাকেন বলে জানান তিনি।

এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি আক্তারুজ্জামান অবশ্য বলেছেন, হল প্রশাসনের সব শিক্ষার্থীকেই সমানভাবে দেখা হয়। এছাড়া কারো কোন অভিযোগ আসলে তার বিরুদ্ধে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়া হয়।

তবে হলগুলো পরিদর্শন করে এবং শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে যে, পরিস্থিতি এখনো পরিবর্তিত হয়নি।--বিবিসি বাংলা

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //