সেশনজটে পূরণ হলো না বিসিএসের স্বপ্ন

গত শুক্রবার (১৯ মে) সকাল ৮ টার দিকে রুহুল আমিন (ছন্দনাম) বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বাদাম তলায় বিষন্নমনে বসে আছেন। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র ও ব্যাচমেটরা স্বপ্নের বিসিএস দিতে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসে বসে স্বপ্ন পূরণের আশা দেখছেন। আজ তারও সেই স্বপ্ন পূরণ করার কথা ছিল। কিন্তু, সেশনজটের কারণে তার বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন অপূরণীয়ই রয়ে গেল। চিত্রটি বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সেশনজটে পড়া ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের একজন শিক্ষার্থীর। 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের ৪৫তম বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার স্বপ্ন থাকলেও সেশনজটের কারণে ৬টি অনুষদে ২৫টি বিভাগের মধ্যে ১৮টি বিভাগের শিক্ষার্থীদের স্বপ্নের ৪৫তম বিসিএস অধরাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে, সেশনজটমুক্ত হওয়ায় ৪টি বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন।

নাম প্রকাশ না করা শর্তে, রুহুল আমিন (ছন্দনাম) ইংরেজি বিভাগের এই শিক্ষার্থী বলেন, আজকে সেশনজটের কারণে এই পরিস্থিতির জন্য খুব বিষন্ন লাগছে। একদিকে পরিবার, আত্মীয়স্বজন অনেক আশা নিয়ে তাকিয়ে আছেন, অন্যদিকে সেশনজটে পড়ে নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে না পারা সব মিলে একটা বিদঘুটে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে আমার জন্য। বিভাগের শিক্ষক, অনুষদের ডিন আর উপাচার্যের অবহেলাই আজকের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। 

২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ১৮টি বিভাগের এক হাজারের অধিক শিক্ষার্থী সেশনজটে পড়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি বিভাগের ফাইনাল পরীক্ষা চলমান। সেশনজটের কারণে সরকারি চাকরি থেকে পিছিয়ে পড়ছেন এসব বিভাগের শিক্ষার্থীরা।

সরেজমিনে দেখা যায়, কলা ও মানবিক অনুষদের চারটি বিভাগের দুটিতে জট রয়েছে। এ কারণে ইংরেজি ও বাংলা বিভাগের ১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। এই অনুষদের শুধু দর্শন বিভাগের শিক্ষার্থীরাই বিসিএস আবেদন করতে পেরেছেন। এবং ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষে চালু হওয়া ইতিহাস ও সভ্যতা বিভাগের কোন ব্যাচ বের হয়নি।

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ৬টি বিভাগের মধ্যে  গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ ছাড়া ৪টি (অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও লোক প্রশাসন) বিভাগে সেশনজট রয়েছে। এই চারটি বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অন্যদিকে, ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হওয়া সমাজকর্ম বিভাগের কোন ব্যাচ বের হয়নি।

ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদের ৪টি বিভাগের প্রত্যেকটিতে জট রয়েছে। চারটি (মার্কেটিং, ম্যানেজম্যান্ট স্টাডিজ, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস, ফিন্যাস এন্ড ব্যাংকিং) বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।

বিজ্ঞান ও প্রকৌশল অনুষদের ৬টি বিভাগের মধ্যে ৫টি (সিএসই, গণিত, রসায়ন, ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা ও পদার্থবিজ্ঞান) বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরা সেশনজটের কারণে বিসিএসে পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অন্যদিকে, ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষ থেকে চালু হওয়া পরিসংখ্যান বিভাগে কোন জট নেই।

জীব বিজ্ঞান অনুষদের ৪টি বিভাগের মধ্যে দুইটি (কোস্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, প্রাণরসায়ন ও জৈবপ্রযুক্তি) বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি। অন্যদিকে, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান এবং উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছেন।

আইন অনুষদের আইন বিভাগের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীরাও সেশনজটের কারণে বিসিএস পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারেননি।

বিসিএস পরীক্ষা দিতে না পারায়, নাম প্রকাশ না করা শর্তে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের গণিত বিভাগের এক শিক্ষার্থী ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,  এভাবে আর কতদিন চলবে। করোনাভাইরাস শিক্ষা জীবন থেকে দেড় বছরের মতো সময় কেড়ে নিয়েছে। এখন যদি এই সেশনজট কারণে আরও বসে থাকার লাগে তাহলে আমাদের জীবনের মূল্য কোথায়? যে কারণে আজ আমরা বিসিএস পরীক্ষা দিতে পারলাম না, তা সমাধানের জন্য উপাচার্য, ডিন ও শিক্ষকদের কাছে বিশেষ অনুরোধ করছি। 

সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক দিল আফরোজ খানম বলেন, আমরা শিক্ষকরা সবসময় শিক্ষার্থীদের প্রতি আন্তরিক কখনো একজন শিক্ষক চান না কোন শিক্ষার্থী সেশনজটে পড়ুক। কিন্তু নানাবিধ নিয়ম আর সংকটে সেশনজটের সৃষ্টি হয়। যেমন আমাদের শিক্ষক যে অনুপাতে পাওয়ার কথা সেই অনুপাতে শিক্ষক আমাদের ইউজিসি দিচ্ছে না। আর সেকেন্ড এক্সামিনার হিসেবে বাইরের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকের কাছে খাতা পাঠাতে হয়, অনেক সময় তারা খাতা দেরিতে পাঠান। পূর্ববর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা না হওয়া পর্যন্ত পরবর্তী সেমিস্টারের পরীক্ষা নিতে পারি না আমরা। এছাড়াও বিভাগগুলোতে শ্রেণিকক্ষেরও সংকট রয়েছে।

এ বিষয়ে বিজ্ঞান ও ইঞ্জিনিয়ার অনুষদের ডিন সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. শফিউল আলম বলেন, সেশনজটের মূল যে সমস্যাটা আমাদের তা হলো শিক্ষক সংকট, শ্রেণিকক্ষ সংকট আর ল্যাব সংকট। বিভাগগুলোতে যে অনুপাতে শিক্ষক থাকার প্রয়োজন আসলে সেই অনুপাতে নেই। এজন্য একজন শিক্ষককে অনেকগুলো কোর্সের ক্লাস নিতে হয় যা কঠিন ব্যাপার। দ্বিতীয়ত ল্যাব সংকটের কারণে একটি ব্যাচকে তিন থেকে চারটি ভাগে ভাগ করে ল্যাব পরীক্ষা শেষ করতে হয় যার জন্য দেরি হয়ে যায়।

এই বিষয়ে জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. বদরুজ্জামান ভূঁইয়া বলেন, বিষয়টি খুবই দুঃখজনক। এটি আরও গুরুত্বের সাথে দেখতে হবে, কারণ শিক্ষার্থীরা যতদ্রুত তাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে নিয়োজিত হতে পারবে তাতেই আমাদের সাফল্য। আমরা আগামীতে বিসিএসসহ সকল ধরনের চাকরির পরীক্ষায় সময়মত শিক্ষার্থীরা যেন অংশগ্রহণ করতে পারে সেই বিষয়ে নানাবিধ কর্মপ্রয়াস গ্রহণ করব। লক্ষ্যনীয় উদ্যোগ নেওয়া হবে সেশনজটের বিষয়ে। একাডেমিক কাউন্সিল এবং ডিন ও চেয়ারম্যানদের মিটিংয়ে এ বিষয়টি যেন গুরুত্ব পায় সেজন্য সংশ্লিষ্টদের সাথে আমি আলোকপাত করব।

এ বিষয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. ছাদেকুল আরেফিন বলেন, আমাদের মূল যে সেশনজটটি করোনাকালীন সময় থেকে শুরু হয়েছে। করোনাকালীন এবং এর আগের সেশনজট নিরসনে আমি আগে থেকেই ডিন এবং বিভাগের চেয়ারম্যানদের নির্দেশ দিয়েছি। এছাড়াও, একাডেমিক কাউন্সিল সভায় ডিন এবং বিভাগের চেয়ারম্যানদের সেশনজট নিরসনে আরও জড়ালো নির্দেশ দিব।

উল্লেখ্য, বিসিএস দিতে না পারার বিষয়ে ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থীদের নাম প্রকাশ করতে বলা হলে, একাডেমিক রেজাল্টে সমস্যা হওয়ার ভয়ে কেউ নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //