শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন নিপীড়ক কারা, কেন এই পরিস্থিতি

বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা যৌন হয়রানি করে তাদের নয় ভাগই শিক্ষক। আর আর ৫৬ ভাগ সহপাঠী। আর এই যৌন নিপীড়করা রাজনৈকিভাবে প্রভাবশালী। আর যৌন নিপীড়নের শিকার ৯০ ভাগই নানা ভয়ের কারণে অভিযোগ করে না।

ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক নারী শিক্ষার্থীর আত্মহত্যার পর তার সুইসাইড নোটে স্পষ্ট হয়েছে যে তিনি যৌন হয়রানিমূলক মন্তব্য ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন দিনের পর দিন। ওই ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামকে বরখাস্ত এবং শিক্ষার্থী সিদ্দিক আম্মানকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিস্কার করা হয়েছে।

শনিবার ওই ঘটনার বিচারের দাবিতে ক্যাম্পাসে প্রতিবাদ হয়েছে। তার সহপাঠীরাও অভিযোগ করেছেন, ‘যৌন হয়রানি ও মানসিক নির্যাতনের বিচার না পাওয়াই তাকে আত্মহত্যার পথে ঠেলে দিয়েছে।’

আরেক ছাত্রী অভিযোগ করেন, তার ডিপার্টমেন্টের এক শিক্ষক তাকে বন্ধুত্বের প্রস্তাব দিয়েছিলেন তিন বছর আগে। তাতে তিনি রাজি না হওয়ায় এখন তাকে শুধু ফেল করানো হচ্ছে। ১০০ নম্বরের পরীক্ষায় তিন দেয়া হচ্ছে।

তার কথায়, ‘আমি এই ঘটনার প্রতিবাদ করেছি। অভিযোগ করেছি। কিন্তু কোনো বিচার পাইনি।’

পরিস্থিতি কেমন
দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিস্থিতি কেমন তা উঠে এসেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক শিক্ষকের গবেষণায়।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি নিয়ে একটি গবেষণায় দেখতে পান বিশ্ববিদ্যালয়ের যৌন নিপীড়কদের মধ্যে নয় ভাগই শিক্ষক। তিনি ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ ছাত্রীর ওপর ২০২২ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গবেষণাটি পরিচালনা করেন।

গবেষণার শিরোনাম ‘স্ট্র্যাটেজিস ফর প্রিভেন্টিং মাসকুলিনিটি অ্যান্ড জেন্ডার বেজড ভায়োলেন্স ইন হায়ার অ্যাডুকেশনাল ইনস্টিটিউশন ইন বাংলাদেশ: আ স্টাডি অব রাজশাহী ইউনিভার্সিটি’। গবেষণায় অংশ নেয়াদের দেয়া তথ্য মতে, ৫৬ ভাগ যৌন নিপীড়কই ছাত্রীদের সহপাঠী। ২৪ ভাগ তাদের চেয়ে ছোট বা বড়। ১১ ভাগ বহিরাগত ও নয় ভাগ শিক্ষক।

১০ ভাগ ছাত্রী জানান, নির্যাতনের ৩০ ভাগ বাজে মন্তব্য ও ৬০ ভাগ সাইবার হয়রানি। নিপীড়নের ঘটনায় মাত্র ১০ ভাগ ছাত্রী অভিযোগ করেছেন। এর মধ্যে পাঁচ ভাগ বিভাগের শিক্ষকদের কাছে এবং বাকি পাঁচ ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিযোগ সেলে।

৯০ ভাগ জানান, ন্যায়বিচার না পাওয়া ও চরিত্র হননের ভয়ে তারা সেলে অভিযোগ করেননি।

অধ্যাপক আব্দুল আলীম বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে গবেষণাটি হলেও ওই সময়ে আমি আরো কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলেছি। তাতে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থা একইরকম। কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো খারাপ। আর গবেষণাটি গত বছরের। এরমধ্যে পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে।’

তার কথায়, ‘যারা যৌন নিপীড়ক তারা রাজনৈতিক বা অন্য কোনোভাবে প্রভাবশালী। তাদের রক্ষার জন্য রাজনৈতিক এবং প্রভাবশালীদের চাপ থাকে। ফলে অনেক ঘটনাই ধামাচাপা দেয়া হয়। অনেক ঘটনার বিচার হয় না।’

তিনি তার অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, ‘রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি যৌন নিপীড়নের ঘটনায় যখন কমিটি কাজ শুরু করে তখন আরো ১৭ জন অভিযোগ করেন। তারা কিন্তু আগে ভয়ে করেননি। তাদের মধ্যে নারী শিক্ষক, শিক্ষকের স্ত্রীও রয়েছেন।’

বাংলাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানির ওপর এর বাইরে আলাদা কোনো জরিপ নাই। তবে ২০২১ সালে প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের ‘চ্যালেঞ্জিং ফিয়ার অব ভায়োলেন্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, জনসমাগমস্থলে ৮১ ভাগ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সিনিয়র সহপাঠী ও শিক্ষকদের মাধ্যমে শারীরিক-মানসিক নির্যাতন, হয়রানি ও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের শিকার হচ্ছেন ৭৪ ভাগ। ২০২২ সালে ডাটা ফর ইমপ্যাক্ট-এর এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে অবিবাহিত মেয়েদের প্রতি তিনজনে একজন ১২ মাসে (এক বছর) কমপক্ষে একবার যৌন হয়রানির শিকার হন।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের চিত্র
সর্বশেষ গত বৃহস্পতিবার যৌন হয়রানির অভিযোগে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের মানব সম্পদ ব্যবস্থাপনা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহাকে বরখাস্ত এবং বিভাগীয় প্রধান রেজোয়ান আহমেদ শুভ্রকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

অনৈতিক প্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় এক ছাত্রীকে অনুপস্থিত দেখিয়ে পরীক্ষায় জরিমানা আদায়, নম্বর কম দেয়া ও থিসিস পেপার আটকে যৌন হয়রানি করার অভিযোগ ওঠে সহকারী অধ্যাপক সাজন সাহার বিরুদ্ধে। আর বিভাগীয় প্রধানের বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি ওই ঘটনা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করেছিলেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক নাদির জুনায়েদকে যৌন হয়রানির অভিযোগে তিন মাসের বাধ্যতামূলক ছুটি দেয়া হয় ১২ ফেব্রুয়ারি। তার বিরুদ্ধে যৌন হয়রানি ও দীর্ঘদিন ধরে মানসিক নির্যাতনের অভিযোগ করেন তার বিভাগের এক নারী শিক্ষার্থী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত এক বছরে ২০টির মতো যৌন হয়রানির অভিযোগ পেয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।

৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর পর্বের থিসিস করতে গিয়ে এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির অভিযোগ করেন রসায়ন বিভাগের এক ছাত্রী।

ওই ছাত্রীর অভিযোগ, ল্যাবে একা কাজ করার সময় এবং কেমিক্যাল দেয়ার বাহানায় নিজ কক্ষে ডেকে দরজা আটকে তাকে ধর্ষণের চেষ্টা করেন ওই শিক্ষক।

ছাত্রীকে যৌন হয়রানির অভিযোগে রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের আজিমপুর শাখার গণিতের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকারকে গ্রেফতার করা হয় ২৭ ফেব্রুয়ারি।

এগুলো চলতি বছরের ঘটনা। প্রতিটি ঘটনায়ই কর্তৃপক্ষ প্রথমে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করলে তারা বিভাগীয় ব্যবস্থা নেন। যেমন ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের শিক্ষক মুরাদ হোসেন সরকার ঘটনার পর হজ করায় তাকে মাফ করে দেয়ার সুপারিশ করেছিল তদন্ত কমিটি।

আবার শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে ময়মনসিংহের কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই শিক্ষককে বরখাস্ত করা হয়। আগে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী প্রোক্টর ও ছাত্রের বিরুদ্ধে আগে একাধিককার অভিযোগ করেও ফল পাননি আত্মহত্যাকারী ছাত্রী। সে আত্মহত্যার পর এখন তারা বরখাস্ত করা হলো।

কেন এই পরিস্থিতি
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি রোধে হাইকোর্ট ২০০৯ সালে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেল গঠনের নির্দেশ দেয়। ওই নির্দেশে অভিযোগ গ্রহণ ও ব্যবস্থা নেয়ার জন্য কমিটি গঠনের কথাও বলা হয়। কোনো অভিযোগ পেলে সয়ংক্রিয়ভাবে সেল কাজ করার কথা। তবে অনেক প্রতিষ্ঠানেই এখনো যৌন নিপীড়ন বিরোধী সেল নেই।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. স্নিগ্ধা রেজওয়ানা বলেন, ‘আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে এই কমিটি থাকলেও তা ঠিক মতো কাজ করে না। কমিটির সদস্যরাই বিষয়টি ঠিকমতো বোঝেন না।’

তার কথায়, ‘এখানে ক্ষমতার একটা বিষয় থাকে। অভিযুক্তরা অনেক সময়ই ক্ষমতার কারণে পার পেয়ে যায়। দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় এখন পর্যন্ত ও নারী প্রক্টর নিয়োগ হয়নি। একজন মনে হয় হয়েছে। যারা প্রক্টরসহ গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন তাদের জেন্ডার বুঝতে হয়। আমরা মনে হয়, তাদের এখন প্রশিক্ষণ দরকার। আর ছাত্রদের কাউন্সেলিং এবং এই বিষয়ে যথাযথ জ্ঞান দেয়া প্রয়োজন।’

আর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল আলীম মনে করেন, ‘শিক্ষক নিয়োগ এবং ছাত্র ভর্তির ব্যাপারে আমাদের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। কোনো একটা ব্যবস্থা থাকা উচিত যার মাধ্যমে তাদের সচেতন করা যায়।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্ট্যাডিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. সৈয়দ শাইখ ইমতিয়াজ বলেন, ‘প্রথমত যখন কোনো ঘটনা ঘটে তার দৃষ্টন্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন। আরেকটি হলো এটা যাতে না ঘটে তার ব্যবস্থা নেয়া। এর কোনোটিই আমরা দেখি না।’

তিনি বলেন, ‘এখানে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে। যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকেন তারা রাজনৈতিকভাবে নিযুক্ত। আর যারা এই ধরনের কাজ করে তারা রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী। ফলে এরা রেহাই পেয়ে যায়।’

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমাদের শিক্ষকদের এই যদি নৈতিক মান হয় তাহলে আমরা কী শিক্ষা দেবো!’ সূত্র: ডয়চে ভেলে

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //