ভাত খাওয়ানোর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যুবককে পিটিয়ে হত্যা

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক মুসলিম হলে চোর সন্দেহে গণপিটুনিতে এক যুবক নিহত হয়েছেন। গতকাল বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় আটক করে ফজলুল হক মুসলিম হলের শিক্ষার্থীরা। পিটুনির আগে ওই তরুণকে ভাত খাওয়ানো হয়েছিল।

হলের প্রত্যক্ষদর্শী শিক্ষার্থীদের তথ্যানুযায়ী, তোফাজ্জলকে মারধরে জড়িতদের মধ্যে অন্যতম হলেন হল ছাত্রলীগের সাবেক উপবিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পাদক এবং পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী জালাল আহমেদ (২০১৮-১৯ সেশন), মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের রাশেদ কামাল অনিক (২০১৮-১৯ সেশন), পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের আব্দুস সামাদ (২০২০-২১ সেশন), প্রাণিবিদ্যা বিভাগের সুলতান (২০২০-২১ সেশন), গণিত বিভাগের রাব্বি (২০২১-২১), উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগের ফিরোজ (২০২০-২১), মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সুমন (২০২১-২২), সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের ওয়াজিবুল (২০২১-২২), ফার্মেসি বিভাগের মোহাম্মদ ইয়ামুজ জামান, মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগের সাকলাইন (২০১৮-১৯ সেশন) এবং গণিত বিভাগের শিক্ষার্থী আহসান উল্লাহ (২০১৮-১৯ সেশন)।

নিহতের নাম তোফাজ্জল (৩০)। তার বাড়ি বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার কাঠালতলি ইউনিয়নে। তিনি মানসিক ভারসাম্যহীনতায় ভুগছিলেন বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে।

জানা যায়, সন্ধ্যায় ফজলুল হক মুসলিম হলে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চলছিল। এমন সময় হঠাৎ তোফাজ্জল নামে যুবক হলে প্রবেশ করলে শিক্ষার্থীরা দুপুরে ছয়টি মোবাইল চুরির ঘটনার চোর সন্দেহে মূল ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে তাকে মারধর ও জেরা করতে থাকে। একপর্যায়ে, তাকে নিয়ে হল ক্যানটিনে খাওয়ানো হয়। এরপর এক্সটেনশন ভবনের অতিথি কক্ষে নিয়ে দ্বিতীয় দফায় বুক, পিঠ, হাত ও পায়ে মারধর করেন একদল শিক্ষার্থী।

মারধরের ফলে ওই যুককের পা থেকে রক্ত বের হতে থাকে। এরপর রাত পৌনে ১০টার দিকে ফের মূল ভবনের অতিথিকক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর ১০টার দিকে প্রক্টোরিয়াল মোবাইল টিমের সদস্যরা এলে মারধরকারীরা তাকে তাদের হাতে তুলে দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে কিছু শিক্ষার্থী ও কয়েকজন হাউস টিউটরের সহায়তায় তাকে প্রথমে শাহবাগ থানায় এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে দায়িত্বরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।

এ ঘটনায় পরের দিন ভোরে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদসহ কয়েকজন সহকারী প্রক্টর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ও ফজলুল হক হল পরিদর্শন করে বিস্তারিত খোঁজখবর নেন। ঘটনায় জড়িতদেরকে বৃহস্পতিবারের মধ্যে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য হল প্রশাসনকে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

নিজ হলে সংঘটিত এই ঘটনায় হল প্রশাসনের ভূমিকা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে হল প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. শাহ মো. মাসুম বলেন, আমাকে ঘটনার শুরুর দিকে কিছু জানানো হয়নি। যখন কয়েকজন কল দিয়েছেন তখন আমি ঘুমিয়েছিলাম, রিং বুঝতে পারিনি। পরে সকালে উঠে জানতে পারলাম মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। এখন আমরা সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে এবং প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেব।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দীন আহমদ বলেন, আমি বিষয়টি জানার পর এবং খোঁজখবর নেওয়ার পর ফজলুল হক মুসলিম হলের প্রাধ্যক্ষকে ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করে আজকের মধ্যেই হলের বিধি অনুযায়ী হল পর্যায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের জন্য বলেছি। এরপর একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হবে। সেই কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন দ্বিতীয়বার এমন ঘটনা না ঘটে সেই ব্যবস্থা আমরা নেব।

এদিকে তোফাজ্জল হোসেনকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় থানায় মামলা হয়েছে। বৃহস্পতিবার রাজধানীর শাহবাগ থানায় হত্যা মামলাটি দায়ের করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। 

শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এ কে এম শাহাবুদ্দিন শাহীন জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের এস্টেট অফিসার মোহাম্মদ আমানুল্লাহ বাদী হয়ে মামলা করেছেন।

মামলার এজাহারে বলা হয়, গত ১৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা পৌনে ৮টার সময় একজন যুবক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলের গেটে সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করছিলেন। এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু ছাত্র তাঁকে আটক করে প্রথমে ফজলুল হক মুসলিম হলের মূল ভবনের গেস্ট রুমে নিয়ে সে মোবাইল চুরি করেছে বলে এলোপাতাড়ি চর থাপ্পড় ও কিলঘুষি মারে। তাঁকে জিজ্ঞাসা করলে তার নাম তোফাজ্জল বলে জানায়। পরবর্তী সময়ে সে মানসিক রোগী বুঝতে পেরে তাঁকে ফজলুল হক মুসলিম হলের ক্যান্টিনে নিয়ে খাবার খাওয়ানো হয়। পরে ফজলুল হক মুসলিম হলের দক্ষিণ ভবনে গেস্ট রুমে নিয়ে জানালার সঙ্গে পেছনে হাত বেঁধে স্ট্যাম্প, হকিস্টিক ও লাঠি দিয়ে উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছাত্র বেধড়ক মারধর করলে তিনি অচেতন হয়ে পড়ে।

এজাহারে আরও বলা হয়, এ বিষয়টি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন আবাসিক শিক্ষককে জানালে তাদের সহায়তায় অচেতন যুবককে ধরাধরি করে মেডিকেলে নেওয়া হয়। পরে ওই যুবককে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দিবাগত রাত পৌনে ১টার সময় তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। 

ওই ঘটনার বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে এজাহার দায়ের করতে সামান্য বিলম্ব হয়েছে বলেও এতে উল্লেখ করা হয়।