জুলাই উত্তাল সময়ের প্রতীক। ৩৬ দিনের এক অনির্বাণ আন্দোলন, যা এক জাতির হৃদয়ে অমর হয়ে আছে। সেই দিনগুলোর প্রতিটি মুহূর্ত ছিল আগুনের মতো জ্বলন্ত। রক্তে লেখা ইতিহাসের সেই পৃষ্ঠাগুলো যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে আজও। শহীদদের রক্তমাখা স্বপ্ন আর আহতদের দুঃসহ যন্ত্রণা এখনো স্পষ্ট। পরিবারের বুকে শূন্যতা, স্মৃতির মাঝে বেদনার ছায়া—জুলাইয়ের নির্মমতা কারও কাছে কেবল অতীত নয়, প্রতিদিনের জীবন্ত বাস্তবতা।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিক এবং শিক্ষার্থীরা সেই দিনগুলোর সাক্ষী। তাদের ক্যামেরায় বন্দি হয়েছে সংগ্রামের প্রতিটি স্পন্দন। তাদের তোলা ছবিগুলো শব্দের ভাষায় আঁকতে চেয়েছে সেই অন্ধকার সময়ের গল্প। সেই আলোকচিত্র, ভিডিও এবং শব্দের সুর মিলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তৈরি করেছে এক অনন্য আলোকচিত্র প্রদর্শনী। ১৪ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে তা চলবে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রদর্শনীতে ২২০টি আলোকচিত্র প্রদর্শনী করা হয়েছে। যেখানে অধিকাংশ আলোকচিত্র আন্দোলনের সময় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত সাংবাদিকদের তোলা ছবি। ছবিতে বিপ্লবীর কণ্ঠস্বর, সত্য প্রকাশে অদম্য সাংবাদিক, প্রতিবাদী শিক্ষার্থী, শিক্ষার্থীর গণজোয়ার, ছাত্রলীগের পালানোর দৃশ্য, ছাত্রদের ৮ দফা, প্রতিবাদী শিক্ষক সমাজ, বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে, ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই, পানি লাগবে, গ্রাফিতি এবং প্রতিবাদী প্রতিরোধ অগ্নিসন্তানের দৃশ্য তুলে ধরা হয়েছে। আলোকচিত্র প্রদর্শন করতে এসে জুলাই বিপ্লবের স্মৃতি স্মরণ করে আবেগে আপ্লূত হয়ে পড়েন অনেকে।
আলোকচিত্র প্রদর্শন করতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব। আলোকচিত্র দেখে জুলাই অভ্যুত্থানের কথা স্মরণ করে আবেগে নিস্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলেন তিনি। বিজয়ের মাসে আরেকটি বিজয়ের স্মরণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, জুলাই আগস্টের ছাত্র জনতার অকাতরে জীবন বিলিয়ে দেওয়ার মাধ্যমে স্বাধীনতার মাসে আরেকটি বিজয় উদযাপন করার সুযোগ পেয়েছি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের স্বাধীন রাষ্ট্র দিয়েছিল, ঠিক তেমনি স্বাধীনতার আসল রূপ ৫ আগস্টের পর আমরা আবার পেয়েছি।
জুলাই অভ্যুত্থানকে হৃদয়ে ধারণ করে নেওয়ার জন্য তিনি বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল স্তরের শিক্ষক এবং কর্মচারীরা প্রদর্শনীতে এসে দেখে নিবেন ৫ আগস্টের পূর্বে আমরা কত ভয়ংকর সময় পার করেছিলাম। তখন ছাত্র-জনতার সাহসিকতার মাধ্যম আমরা নতুন একটা বাংলাদেশ পেয়েছি। প্রদর্শনী থেকে আমাদের সকলকে উদ্দীপ্ত হতে হবে। আমরা যে সুযোগ পেয়েছি সেটা যেন আর না হারায়। কত কষ্ট, কত ত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে সুযোগটা এসেছে এটা যেন আমরা প্রতিদিন উপলব্ধি করি। আমার যদি সুযোগ হতো তাহলে সারাবছর আলোকচিত্র প্রদর্শন আয়োজন করতাম যেন আমরা ভুলে না যায়। কত মানুষের আত্মত্যাগ এবং মর্মান্তিক পরিণতির ভিতর দিয়ে মুক্ত বাতাসে মন খুলে কথা বলতে পারি।
আলোকচিত্র প্রদর্শন করতে এসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী শোয়েব আহমেদ। তিনি বলেন, এই আলোকচিত্রগুলো শুধু ছবি নয়, এগুলো আমাদের ইতিহাসের জীবন্ত সাক্ষী। জুলাই আন্দোলনের প্রতিটি মুহূর্তে যে সাহস, ত্যাগ, আর রক্তের গল্প লুকিয়ে আছে, তা নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার এটাই সেরা মাধ্যম। আমরা যারা এই প্রদর্শনীতে এসেছি, তারা শুধু ছবি দেখছি না; আমরা সেই সময়কে অনুভব করছি, যেন রক্তমাখা মাটির গন্ধ আজও আমাদের মনে গেঁথে আছে। এই আয়োজন আমাদের দায়িত্বের কথা মনে করিয়ে দেয়—এই অর্জন, এই স্বাধীনতার মর্যাদা যেন আমরা কখনো ভুলে না যাই।
আলোকচিত্র প্রদর্শন করে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মাঈন উদ্দিন মন্তব্য করেন, এ প্রদর্শনী আমাদের ঐক্যকে সংহত করবে।
প্রদর্শনীতে দাড়িয়ে সকলে অতীতের সময়ে ফিরে গিয়ে অশ্রু মুছে। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ব্যারিকেড, মিছিলে স্লোগান তোলা মানুষের মুখ, রক্তাক্ত পথ। স্মৃতির চাদরে মোড়া এই আয়োজন যেন আন্দোলনের অর্জনকে সকলের সামনে আবারও জাগরিত করে তুলে।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2025 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh