কোন পথে পুঁজিবাজার

ভালোই চলছে দেশের পুঁজিবাজার। প্রতিদিনই নতুন রেকর্ড গড়ছে লেনদেন ও সূচক। কিন্তু কতটা টেকসই হয় বাজারের এই অবস্থা- তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকের মনেই। 

কারণ করোনাকালে ব্যবসা না বাড়লেও বিমা কোম্পানির শেয়ার দরে টানা উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। বছরের পর বছর লোকসানে থাকা বেশ কিছু কোম্পানির শেয়ার দরও বাড়ছে। এমনকি উৎপাদনে না থাকলেও দর বাড়ছে- এমন কোম্পানিও রয়েছে পুঁজিবাজারে। 

অন্যদিকে ভালো মৌলভিত্তির বেশ কিছু শেয়ারের দর অবমূল্যায়িত হয়ে আছে দীর্ঘদিন। তাই কেউ কেউ বিষয়টিকে ভালো চোখে  দেখছেন না। তবে অধ্যাপক শিবলী রুবায়েত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন নতুন কমিশনের তদারকিতেও আস্থা রাখছেন অনেকেই। সেই সঙ্গে পুঁজিবাজারের এই উত্থানকে টেকসই করার তাগিদ দিচ্ছেন তারা।

পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর পুঁজিবাজারে ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) ইস্যুর ক্ষেত্রে কোম্পানির উৎপাদন সক্ষমতা থেকে শুরু করে কোম্পানির অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস, সুশাসন সব কিছুই দেখা হচ্ছে। আগের মতো কাগুজে কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত হতে পারছে না। এছাড়া যারাই অনিয়ম করার চেষ্টা করছে তাদের কড়া শাস্তির আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে। 

সর্বোপরি পুঁজিবাজারের সুশাসনের বিষয়ে বেশি নজর দেয়া হচ্ছে। যার কারণে বহুদিন পর কিছুটা স্থিতিশীল অবস্থায় এসেছে বাজার। তবে এই বাজারকে টেকসই করতে আরো যেসব পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তা অবশ্যই নিতে হবে। মনিটরিংয়ের ক্ষেত্রে যাতে আইন সবার জন্য সমান হয়, সেবিষয়ে খেয়াল রাখারও তাগিদ দিয়েছেন তারা। 

বিগত বছরগুলোয় অনেক অনিয়মের অভিযোগ ছিল, আইনের কঠোর প্রয়োগ ছিল না, নিয়মনীতির কোনো তোয়াক্কা না করে যে যার মতো ব্যবসা করেছেন। এক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে, যার ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ছিল না, তাকে ৯ বছর এসইসির চেয়ারম্যান পদে রাখা হয়েছিল কেন? 

দীর্ঘ প্রায় এক দশক পর এই বাজারে কিছুটা স্বস্তি লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যার অন্যতম কারণ, নিয়ন্ত্রক সংস্থা সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে পরিবর্তন। 

অনেকেই বলছেন, বাজারে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করার জন্য বিএসইসি কঠোর অবস্থানে রয়েছে। কারসাজি করে ১৯৯৬ ও ২০১০ সালের মতো পুঁজিবাজার আর ফেলে দেয়া (পতন ঘটানো) সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। 

তিনি বলেন, পুঁজিবাজারে অনেক সংস্কার করা হয়েছে; আধুনিকায়ন হয়েছে। তাই চাইলেই স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় বাজারে কারসাজির সুযোগ নেই। আগামী দুই বছরের মধ্যে পুঁজিবাজারে বড় ধরনের পরিবর্তন দেখা যাবে। তখন আমরা শ্যালো ক্যাপিটাল মার্কেট থেকে বেরিয়ে আসতে পারব।  

বিভিন্ন সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, স্টক মার্কেটে তারল্য বাড়লে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথ সুগম হয়। তবে দেশ যত উন্নতির দিকে যায়, সেই বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্তির হার ধাপে ধাপে কমতে থাকে। সেজন্য অনেকেই বলছেন, বাংলাদেশ এখন শেয়ারবাজার থেকে লাভবান হওয়ার মতো আদর্শ অবস্থানে। কিন্তু দেশের শেয়ারবাজারে তারল্যের পরিমাণ সমপর্যায়ের দেশগুলোর তুলনায় অনেকটাই কম। দেশে যেখানে গড়ে দিনে ৮ কোটি ১০ লাখ ডলার সমমূল্যের শেয়ার হাতবদল হয়, ভিয়েতনামে তার পরিমাণ ৭১ কোটি ৪০ লাখ ডলার। 

করোনা মহামারির মধ্যেই এক বছরের ব্যবধানে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) তালিকাভুক্ত কোম্পানি ও ফান্ডগুলোর মধ্যে ৭০টির শেয়ার দর বেড়েছে ১০০ শতাংশের বেশি। আর ৫০ শতাংশের বেশি দর বেড়েছে ১৩৮টি প্রতিষ্ঠানের। এর মধ্যে বিমা খাতের তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরে উল্লম্ফন ছিল সবচেয়ে বেশি। পাশাপাশি উৎপাদন বন্ধ থাকা, লোকসানি কোম্পানিগুলোর শেয়ার দরও ছিল ঊর্ধ্বমুখী।

১০০ শতাংশের বেশি দর বাড়া শীর্ষে থাকা ৫০টি কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- পাইনিওর ইন্স্যুরেন্স, বিডি ফাইন্যান্স, ঢাকা ডাইং, গ্লোবাল ইন্স্যুরেন্স, ফেডারেল ইন্স্যুরেন্স, ঢাকা ইন্স্যুরেন্স, ফারইস্ট ইন্স্যুরেন্স, পূরবী জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ন্যাশনাল ফিড, নর্দান ইন্স্যুরেন্স, প্রিমিয়ার ইন্স্যুরেন্স, এশিয়া প্যাসিফিক ইন্স্যুরেন্স, সোনার বাংলা ইন্স্যুরেন্স, রিপাবলিক ইন্স্যুরেন্স, ম্যাকসন স্পিনিং, পিপলস ইন্স্যুরেন্স, অগ্রণী ইন্স্যুরেন্স, শাইনপুকুর সিরামিক, রূপালি ইন্স্যুরেন্স, প্রগতী ইন্স্যুরেন্স, ইসলামিক ইন্স্যুরেন্স, ফনিক্স ইন্স্যুরেন্স, সিএপিএম আইবিবিএল মিউচুয়াল ফান্ড, জনতা ইন্স্যুরেন্স, গোল্ডেন ইন্স্যুরেন্স, জিল বাংলা সুগার, ডেল্টা স্পিনিং, সেন্ট্রাল ইন্স্যুরেন্স, লঙ্কাবাংলা ফাইন্যান্স, কন্টিনেন্টাল ইন্স্যুরেন্স, নিটল ইন্স্যুরেন্স, আরডি ফুড, বেক্সিমকো ফার্মা, জিবিবি পাওয়ার, আরামিট সিমেন্ট, বিডি থাই, কাট্টালি টেক্সটাইল, বিজিআইসি, মুজাফ্ফর হোসেন স্পিনিং, বে-লিজিং, আনোয়ার গ্যালভানাইজিং, সন্ধানী ইন্স্যুরেন্স, কর্ণফুলী ইন্স্যুরেন্স, কেয়া কসমেটিকস ও আমান কটন ফেব্রিকস লিমিটেড।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাজারের স্বাভাবিক উত্থান বিনিয়োগকারী ও অর্থনীতির জন্য মঙ্গলজনক। কিন্তু কোনো কারণ ছাড়াই ২০ টাকার শেয়ারের দাম ২০০ টাকা হওয়ায় বাজারের নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানগুলোকে অশনি সংকেত দিচ্ছে। এখনই পদক্ষেপ না নিতে পারলে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির মুখে পড়বেন বিনিয়োগকারীরা। আরো বড় দান মেরে কেটে পড়বে কারসাজি চক্র। 

এ প্রসঙ্গে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, কোনো কারণ ছাড়া এক বছরে একটি কোম্পানির শেয়ারের দাম ১০ গুণ ও ছয় মাসে ৭ গুণ বেড়ে যাওয়ার যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। একমাত্র কারসাজির মাধ্যমেই এটি সম্ভব। বাজার যখন চাঙা থাকে, তখন কারসাজি বেশি হয়। বর্তমান নিয়ন্ত্রক সংস্থা অনেক ভালো কাজ করছে। কিন্তু কারসাজি বন্ধে এ কমিশনের আরও বেশি সক্রিয় হওয়া উচিত। যেসব কোম্পানির শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে, সেগুলোর বিষয়ে দ্রুত তদন্ত করে জড়িত কারসাজিকারীদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।

বিএসইসির মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে পাঠানো বিমা কোম্পানিসহ বেশ কিছু কোম্পানির বিষয়ে তদন্ত প্রতিবেদন আমাদের এনফোর্সমেন্ট বিভাগে রয়েছে। এর বাইরে নিয়ন্ত্রক সংস্থাও বেশ কিছু কোম্পানির অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে জড়িতদের তথ্য সংগ্রহ করেছে। কারও বিরুদ্ধে আইন লঙ্ঘনের প্রমাণ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। এছাড়া কারসাজি রোধে বাজারে তদারকি বাড়ানো হয়েছে। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //