ঈদের পর কেমন হতে পারে শেয়ারবাজার

শেয়ারবাজার এভাবে ঘুরে দাঁড়াবে এক বছর আগেও তা কেউ চিন্তা করেননি। ২০০৯-২০১০ সালে এই বাজারে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী দেউলিয়া হয়েছেন। এরপর থেকে টানা ১০ বছর মানুষ শেয়ারবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। এখন সেই বাজার শুধু চাঙ্গাই হয়নি, প্রতিদিন কোটি কোটি বিনিয়োগ করছেন সাধারণ বিনিয়োগকারীরা।

দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সোমবার (১৯ জুলাই) একদিনে তিনটি রেকর্ড হয়েছে। এর মধ্যে দুটি সূচকের রেকর্ড আরেকটি বাজার মূলধনের। ঈদের ছুটির আগে শেষ কার্যদিবসে সূচক ও শেয়ারের দামের উত্থানের ফলে এ রেকর্ড হয়েছে প্রধান শেয়ারবাজারে। 

ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ওইদিন প্রায় ৪০ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ৪০৫ পয়েন্টে। আর বাছাই করা ভালো মৌলভিত্তির ৩০ কোম্পানির সমন্বয়ে গঠিত ডিএস–৩০ সূচকটি ১৬ পয়েন্ট বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৩২২ পয়েন্টে। তাতেই এ দুই সূচক নতুন উচ্চতায় উঠেছে। ২০১৩ সালের ২৭ জানুয়ারি এ দুটি সূচক চালু হয়েছিল। চালু হওয়ার প্রায় সাড়ে আট বছর পর এসে সোমবার (১৯ জুলাই) সূচক দুটি সর্বোচ্চ উচ্চতায় উঠেছে।  

এছাড়া ডিএসইর বাজার মূলধন সোমবার একদিনেই ২ হাজার ৮৭৪ কোটি টাকা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫ লাখ ৩৫ হাজার ১৮৫ কোটি টাকায়। এটিই ঢাকার বাজারের এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ বাজার মূলধন।

ডিএসইর দুটি সূচক ও বাজার মূলধন রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছে যাওয়ায় এখন সূচক দুটি সামান্য বাড়লেই প্রতিদিনই রেকর্ড হবে। আর বড় মূলধনসহ বেশিরভাগ কোম্পানির শেয়ারের দাম বাড়লে রেকর্ড উচ্চতায় উঠবে বাজার মূলধন। 

ডিএসইর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের নভেম্বরে ঢাকার বাজারে প্রধান সূচক ডিএসইএক্স একবার সর্বোচ্চ ৬ হাজার ৩৩৭ পয়েন্টের রেকর্ড উচ্চতায় উঠেছিল। সেখান থেকে কমতে কমতে ২০২০ সালের মার্চে করোনার জন্য সাধারণ ছুটি ঘোষণার আগে সূচকটি সর্বনিম্ন ৩ হাজার ৬০০ পয়েন্টে নেমে গিয়েছিল। এ অবস্থায় পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বে বদল আসে। বিএসইসিতে নতুন নেতৃত্ব দায়িত্ব নেয়ার পর গত বছরের জুলাই থেকে বাজার ঊর্ধ্বমুখী ধারায় ফিরে আসে।

শেয়ারবাজারকে সামাল দিতে চ্যালেঞ্জ নিয়ে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব নেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম। বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার জিরো টলারেন্স নীতিতে ছয় মাসের মধ্যেই ইতিবাচক ধারায় ফিরতে শুরু করে দেশের শেয়ারবাজার। এর মধ্যে দেশে করোনার চড়াই-উৎরাইয়ের মধ্যেও চলতি বছরের মে মাসে বিশ্বের অন্য শেয়ারবাজারগুলোকে পেছনে ফেলে শীর্ষ তালিকায় স্থান পায় বাংলাদেশের শেয়ারবাজার। রিটার্নের দিক দিয়ে তৃতীয়বারের মতো দেশের শেয়ারবাজার বিশ্বের শীর্ষ তালিকায় স্থান পায়। এর আগে গত বছর সেপ্টেম্বরে ও অক্টোবরে মাসেও বিশ্বের সেরা স্থান দখল করেছিল দেশের শেয়ারবাজার। এশিয়ান ফ্রন্টিয়ার জার্নালের প্রতিবেদনে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়।

ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, ‘শেয়ারবাজার গতিশীল অবস্থায় রয়েছে। বিনিয়োগকারীদের আস্থা বাড়ায় শেয়ারবাজার ধীরে ধীরে এ অবস্থানে এসেছে। ব্যাংকও সঞ্চয়পত্রের সুদের হার কম থাকায় মানুষ শেয়ারবাজারে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়ে উঠছে। আর অনেক কোম্পানির পারফরমেন্স ভালো রয়েছে। তারা ইতিমধ্যে লভ্যাংশও দিয়েছে। এতে বিনিয়োগকারীরা আকৃষ্ট হয়েছেন। এছাড়া বিএসইসির বেশ কিছু ইতিবাচক সিদ্ধান্ত শেয়ারবাজারকে আরো গতিশীল করে তুলেছে।’ 

এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএসইর সাবেক সভাপতি ও বর্তমান পরিচালক মো. রকিবুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে শেয়ারবাজার ভালো অবস্থানে রয়েছে। আমরা অনেক আশাবাদী। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতাও করপোরেট কালচার প্রতিষ্ঠিত হলে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী শেয়ারবাজারে আসবেন। তবে ডিএসইর সার্ভার জটিলতার কারণে সূচক, লেনদেন ও বাজার মূলধন বৃদ্ধির গতি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। তা না হলে সূচক, লেনদেনসহ বাজার মূলধনে আরো রেকর্ড বাড়তো। এতে বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। ডিএসই’র আইটি বিভাগ, ম্যানেজমেন্ট ও পরিচালনা পর্ষদ এ ঘটনার দায়ভার এড়াতে পারে না। রবিবার বিনিয়োগকারীদের আত্মবিশ্বাসে শেয়ারববাজার যেভাবে এগিয়ে চলছিল, কারিগরি ত্রুটির ঘটনায় তা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ বিষয়টি বিএসইসি’র কঠোরভাবে দেখা উচিত।’

বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিএমবিএ) সভাপতি ছায়েদুর রহমান বলেন, ‘দীর্ঘদিন বাজারে বিনিয়োগকারীরা নিস্ক্রিয় ছিল। তাদের অংশগ্রহণ ছিল না। এখন বিনিয়োগকারীদের অংশগ্রহণ বেড়েছে। করোনা পরিস্থিতিতে ব্যবসা সম্প্রসারণ হচ্ছে না। ব্যাংকে অলস টাকা পড়ে রয়েছে ও সুদের হারও কম। ফলে বর্তমানে বিনিয়োগের বিকল্প উৎস হয়ে উঠেছে শেয়ারবাজার। সূচক ৭-৮ হাজার পয়েন্টে যাওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ৬ হাজার সূচক নিয়ে বিনিয়োগকারীদের যে ভীতি ছিল, তাও কেটে গেছে। বর্তমানে বিনিয়োগকারীদের  আস্থা অনেক বেড়েছে। দেশের শেয়ারবাজার এখন আরো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে।’ 

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এখন শেয়ারবাজারে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সক্রিয়। এ কারণে বাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তারা সক্রিয় থাকলে বাজার আরো ভালো হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। ঈদের ছুটির পর পুঁজিবাজার আরো ভালো অবস্থানে যেতে পারে বলে ইঙ্গিত দেন তারা। ঈদ উপলক্ষে টানা পাঁচদিন বন্ধ থাকবে পুঁজিবাজার। আজ মঙ্গলবার (২৪ জুলাই) পর্যন্ত বন্ধ থেকে ২৫ জুলাই থেকে আবার লেনদেন চালু হবে।

এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পুঁজিবাজার বিশ্লেষক অধ্যাপক আবু আহমেদ বলেন, এখন বাজারের বেশিরভাগ শেয়ারই বিনিয়োগযোগ্য। বর্তমানে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় রয়েছে। যে কারণে বাজার গতি ফিরে এসেছে। পাশাপাশি তাদের লাভবান হওয়ারও সম্ভাবনা তৈরি হবে। অন্যদিকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা বাজারে ফিরে আসায় বিনিয়োগকারীরাও সক্রিয় হয়েছেন। এতে বাজারে স্থিতিশীলতা ফিরে এসেছে। আশা করা যায় এ পরিস্থিতি বজায় থাকলে আগামীতে বাজার আরো ভালো হবে।

এদিকে বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, লেনদেনে ফিরলেও তাদের মধ্যে এক ধরনের শঙ্কাও কাজ করছে। তারা জানান, শেয়ারবাজার ঘুরে দাঁড়িয়েছে এটা ভালো খবর। কিন্তু এটা দীর্ঘমেয়াদি হতে হবে। তারা একটি দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীল শেয়ারবাজার চান।  

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //