রাতের ফ্লাইওভার ভয়ংকর!

রাজধানী ও রাজধানীর বাইরের ফ্লাইওভার ব্রিজগুলো ক্রমেই ভয়ানক হয়ে উঠছে। বিশেষ করে রাতের ফ্লাইওভার যেন রীতিমতো অপরাধের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়েছে। নানা কৌশলে ছিনতাই ও মানুষ খুন করে লাশ ফেলে যাওয়ার জন্যও অপরাধীদের নিরাপদ স্থানে পরিণত হয়েছে ফ্লাইওভারগুলো। 

সাধারণত রাতে ফ্লাইওভারে গাড়ি চলাচল কম থাকে। রাত যত গভীর হয়, ফ্লাইওভারগুলো হয়ে ওঠে ততটাই নীরব। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে অপরাধীদের বিভিন্ন গ্রুপ আলাদা আলাদা জোনে ভাগ করে নিয়েছে ফ্লাইওভারগুলো। নিজেদের সীমানাও আলাদা। এক গ্রুপ অন্য গ্রুপের সীমানায় প্রবেশ করে না। কখনো কখনো ফ্লাইওভারগুলোর একেকটি লুপ একেক গ্রুপের নিয়ন্ত্রণে থাকে। 

এসব তথ্য নিশ্চিত হওয়া গেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে।

সীমানাগত জটিলতায় সীমিত টহল

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাধারণ সড়কের তুলনায় ফ্লাইওভারে পুলিশ টহলও খুব সীমিত। এর অন্যতম কারণ হিসেবে তারা বলছেন, সাধারণত রাজধানীর থানা এলাকাগুলো রাস্তার হিসেবে ভাগ করা। অনেক সময় দেখা যায়, রাস্তার দুই পাশ দুই থানা এলাকায়; কিন্তু ফ্লাইওভারগুলোর থানা এলাকা নিয়ে এক ধরনের জটিলতা রয়েছে। যেহেতু ব্রিজ এক এলাকা থেকে শুরু হয়ে অন্য এলাকায় শেষ হয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে টার্নগুলো এমন অবস্থায় রয়েছে, যার এলাকা নির্ধারণ খুব দুরূহ হয়ে পড়ে; তাই এই সীমানাগত জটিলতায় ফ্লাইওভারে পুলিশ টহল থাকে খুব সীমিত।

সূত্র জানায়, সীমানগত জটিলতা বাহিনীর জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের পরিষ্কার নির্দেশনা না থাকলে থানাগুলো টহল কাজে সক্রিয় হতে পারে না। একই মত অপরাধ বিশেষজ্ঞদেরও। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত ফ্লাইওভারগুলোতে নিরাপত্তা বিধান করে অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করা। না হলে ছিনতাইয়ের ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

অভিনব কায়দায় চলছে ছিনতাই

সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নামলেই ফ্লাইওভারগুলো ছিনতাইকারীদের জন্য অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। ছিনতাইকারীরা তাদের কাজ চালিয়ে যায় ভোর পর্যন্ত। কখনো কখনো বিভিন্ন এলাকা থেকে ছিনতাই করে এসে ফ্লাইওভারে সেরে নেয় নিজেদের ভাগ-বাটোয়ারা। কম নজরাদারি থাকার সুবাদে অভিনব সব কৌশলে ফাঁকা ফ্লাইওভারে একের পর এক ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেই চলেছে।

ফ্লাইওভারে বাতি না জ্বলা ও গভীর রাতের নির্জন পরিবেশ বিরাজ করায় এটিকে ছিনতাইয়ের নিরাপদ জায়গা হিসেবে বেছে নিচ্ছে দুষ্কৃতকারীরা। এ কাজে বেশির ভাগ সময় ভিকটিম হচ্ছেন মোটরসাইকেল চালক, সিএনজি অটোরিকশার যাত্রী ও পথচারীরা। 

নানা কৌশলে পথরোধ করে সর্বস্ব কেড়ে নেয় ছিনতাইকারীরা। কখনো ফ্লাইওভারের দু’পাশ থেকে সাদা নাইলনের সুতা ধরে মোটরসাইকেল আরোহীর সর্বস্ব কেড়ে নেয়া হচ্ছে। আবার চালক বেশে সিএনজিতে যাত্রী এনে ফ্লাইওভারের উপরে লুট করা হচ্ছে সবকিছু। কখনো আবার ব্যারিকেড দিয়েও ঘটছে ছিনতাইয়ের ঘটনা। এসব কাজে বাধা দিলে প্রাণ খোয়াতে হচ্ছে ভিকটিমদের। সম্প্রতি রাজধানীতে এমন বেশ কয়েকটি ঘটনাও ঘটেছে।

যেসব ফ্লাইওভারে বেশি বিপদ

থানা পুলিশ, টহল পুলিশ ও হাসপাতাল সূত্রে নিশ্চিত হওয়া গেছে, রাজধানীর মহাখালী, বনানী, মালিবাগ-মগবাজার, কুড়িল বিশ্বরোড এলাকায় ফ্লাইওভার ঘিরে বেশি সক্রিয় অপরাধী চক্রগুলো। এসব এলাকায় বেশ কিছু ঘটনার তথ্য সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া যাচ্ছে। 

জানা গেছে, রাজধানীর প্রবেশপথের যাত্রাবাড়ী মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের পাশাপাশি ডাকাতির ঘটনাও ঘটছে হরহামেশা। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলো বলছে, এই ফ্লাইওভারগুলোকে নিরাপদ করে তুলতে তৎপরতা বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা হচ্ছে।

ভয়ংকর সুতা ফাঁদ 

জানা গেছে, গত ১০ জুলাই সুতার ফাঁদে পড়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ খুঁইয়েছেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তানভীর জোবায়ের। মধ্য রাতে বন্ধুকে রামপুরায় নামিয়ে দিয়ে হাতিরঝিল হয়ে ধানমন্ডি ফেরার পথে মধুবাগ ফ্লাইওভারে সুতার ফাঁদে পড়েন তিনি। 

তানভীর সংবাদমাধ্যমকে জানান, তিনি হাতিরঝিলের মধুবাগ ফ্লাইওভার থেকে নামার পথে কিছু একটা হাতে আটকে যায়। ব্যথা পেয়ে মোটরসাইকেল থামিয়ে দেখেন, সুতা আটকে হাত কেটে গেছে। সাথে সাথে তিনি দেখতে পান কয়েকজন এসে তাকে ঘিয়ে ধরে চাকু দেখিয়ে মোবাইল ও মানিব্যাগ নিয়ে যায়। 

ভরদুপুরে সুতার ফাঁদে পড়েছিলেন সংবাদকর্মী মোহাম্মদ হোসাইন তারেক। গত ১১ জুলাই দুপুরে তিনি দুর্ঘটনার শিকার হন বলে জানান। তারেক বলেন, ‘মিন্টু রোড থেকে মগবাজার ফ্লাইওভারে উঠে বামে টার্ন নিয়ে কারওয়ান বাজারের দিকে যাচ্ছিলাম। ফ্লাইওভারের ওপর বামের লেনের রাস্তাটা বেশ নীরব ছিল। তখন বৃষ্টি হচ্ছিল। মূল ফ্লাইওভার থেকে বামে টার্ন নিতেই সুতায় গলা ও হাত জড়িয়ে যায়। আমার বাম হাতের কিছু অংশ কেটে যায়। একটু এদিক-সেদিক হলেই আরো বড় দুর্ঘটনা ঘটতে পারত।’

খুন করে ফেলে যাচ্ছে লাশ

সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য মতে, গত বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে চলতি বছরের ৬ জানুয়ারি পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন ফ্লাইওভার থেকে চারটি মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এর মধ্যে গত ৫ জানুয়ারি রাত সোয়া ১টার দিকে মগবাজার ফ্লাইওভারের ওপর সোনারগাঁও প্রান্ত থেকে মিজানুর রহমান নামের এক যুবকের লাশ উদ্ধার করা হয়। ছিনতাইয়ের উদ্দেশ্যেই তাকে হত্যা করা হয় বলে জানায় পুলিশ। 

এই ঘটনায় গত ২৩ জানুয়ারি টঙ্গী থেকে নুরুল ইসলাম এবং ২৫ জানুয়ারি গাজীপুরা ও তুরাগ থেকে আবদুল্লাহ বাবু ও জালালকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এ চক্রের সদস্যরা এক রাতে সর্বোচ্চ ছয়টি ও প্রতি জনে ২০০০-২৫০০টি ছিনতাই করেছে বলে জানায় পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে। এ ধরনের আরো বেশ কয়েকটি চক্র রাজধানীতে সক্রিয় রয়েছে বলেও ধারণা পুলিশের।

পুলিশের বক্তব্য

ফ্লাইওভারজুড়ে সক্রিয় থাকা অপরাধী চক্রের বিষয়ে ফ্লাইওভারের নিকটবর্তী থানাগুলোর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা কোনো মন্তব্য করতে না চাইলেও এ বিষয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মো. ওয়ালিদ হোসেন জানান, একটি সংঘবদ্ধ চক্র ফ্লাইওভারে ছিনতাইয়ের সাথে জড়িত। কী উদ্দেশ্যে এ ধরনের কাজ করা হচ্ছে, তা খতিয়ে দেখা হবে। যারা এ ধরনের কাজ করছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে। 

তিনি আরো বলেন, ‘ফ্লাইওভারগুলোতে কীভাবে আরও বেশি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায়, সে বিষয়ে কাজ করছে ডিএমপি।’ জনগণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি বাহিনীর কাছে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //