৯১১ দোকান মালিকের কান্না, এতো টাকা কার পকেটে

রাজধানীর ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৯১১টি দোকান উচ্ছেদ অভিযানে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসার উপকৃম হয়েছে। অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ৯১১টি দোকানের বেশির ভাগই লাখ লাখ টাকা বিক্রি করা হয়েছে। দোকান মালিকদের অভিযোগ প্রতিটি দোকান ১২ লাখ থেকে ২০ লাখ টাকায় দোকান ক্রয় করে ব্যবসা করছেন। 

এই হিসেবে দেখা যায়- অবৈধ দোকানগুলো থেকে কোটি কোটি টাকা নেয়া হয়েছে। সংশ্লিষ্ট করপোরেশনের কর্তাব্যাক্তিরাই এই বন্দোবস্ত করে দেন টাকার বিনিময়ে। প্রশ্ন হচ্ছে অবৈধভাবে গড়ে উঠা ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এর দোকান বিক্রির কোটি কোটি টাকা কার পকেটে গেল?

গতকাল মার্কেটের অবৈধ দোকান উচ্ছেদ করতে গিয়ে ব্যবসায়ীদের বাধার মুখে পড়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। এক পর্যায়ে দুপুরে ব্যবসায়ীদের সাথে পুলিশের সাথে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এ সময় তিনজন আহত হন। পরে ব্যবসায়ীদের বাধা উপেক্ষা করে মার্কেটের অবৈধ ৯১১ দোকান উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় অনেক ব্যবসায়ীকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেছে।

জানা যায়, গতকাল সকালে গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ নকশা বহির্ভূত ৯১১টি অবৈধ দোকান উচ্ছেদ অভিযানে যায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দোকান উচ্ছেদের খবর শুনে সকাল থেকেই ব্যবসায়ী ও দোকানদাররা সড়কে নেমে বিক্ষোভ করতে থাকে। অভিযান শুরু করতে গেলে এক পর্যায়ে পুলিশ ও ডিএসসিসির কর্মকর্তাদের ওপর ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। এ সময় বেশ কয়েকজন পুলিশ সদস্য আহত হয়। পরে, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ করে ব্যবসায়ী ও বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়ে অভিযান শুরু হয়।

ডিএসসিসির নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনিরুজ্জামান, এ এইচ ইরফান উদ্দিন আহমেদ ও তানজিলা কবির ত্রপার নেতৃত্বে গতকাল সকাল ১১টার দিকে অভিযান শুরু করার কথা থাকলেও বাধার মুখে অভিযান শুরু করতে করতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়। শেষ পর্যন্ত বিক্ষোভকারীদের সরিয়ে দিয়ে ৯১১টি দোকান ভেঙ্গে দেয় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। এ সময় কান্নায় ভেঙে পড়েন ব্যবসারীরা।

সরেজমিনে দেখা গেছে, ডিএসসিসির প্রধান কার্যালয় বা নগর ভবনের ঠিক উল্টোপাশে এই বিপণিবিতানটির অবস্থান। এতে তিনটি ভবন রয়েছে। এগুলো এ, বি ও সি ব্লকে ভাগ করা হয়েছে। তবে দোকানিরা এ ব্লকের নাম দিয়েছেন সিটি প্লাজা, বি ব্লকের নগর প্লাজা এবং সি ব্লকের নাম দিয়েছে জাকের সুপার মার্কেট। অভিযান ঠেকাতে বিপণিবিতানের সামনে রাস্তায় অবস্থান নেন এক হাজারের বেশি দোকানি ও কর্মচারী। তারা সম্মিলিতভাবে বিক্ষোভ শুরু করেন। জীবন দেবেন, কিন্তু রাস্তা ছাড়বেন না বলে স্লোগান দেন।

ব্যবসায়ীদের দাবি, সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনের সময় নকশাবহির্ভূত এসব দোকান বৈধ করতে তারা লাখ লাখ টাকা দিয়েছেন। দোকানগুলো থেকে ডিএসসিসি এত দিন ভাড়াও নিয়েছে। এখন কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই দোকান উচ্ছেদ করার জন্য এসেছেন সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা।

ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের লাখ লাখ টাকা দিয়ে দোকানের মালিকা নিয়েছেন তারা। তারপরও তাদের দোকান উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়া এতদিন প্রতিটি দোকান থেকে নির্দিষ্ট পরিমাণ ভাড়াও আদায় করে আসছিলো সিটি করপোরেশন। ইতিমধ্যে বিষয়টি নোটিশ এবং মাইকিং করে ব্যবসায়ীদের জানানো হয়।

ব্যবসায়ীরা জানান, যারা এই ৯১১টি দোকান নির্মাণ করেছেন, তারা এখানে ব্যবসা করেন না। তারা অধিকাংশ দোকান কম দামে বিভিন্ন জনের কাছে বিক্রি করে দিয়েছেন। কেউ দোকান ভাড়ায় চালাচ্ছেন। এখন সিটি করপোরেশন দোকানগুলো গুঁড়িয়ে দেওয়ায় সাধারণ ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

নগর প্লাজা দোকান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ আহমেদ বলেন, ১৯৯৬ সালে প্রয়াত মেয়র মোহাম্মদ হানিফের সময় পার্কিংয়ের জায়গায় দোকান তৈরি করে তা অস্থায়ী বরাদ্দ দেয়া হয়। এরপর ২০১২ সালে প্রশাসকের আমলে লিফটের জায়গায়, মানুষের হাঁটার জায়গায়, সিঁড়িতে এবং বিপণিবিতানের সামনের ফুটপাতের দোকান অস্থায়ী বরাদ্দ দেয়া হয়। পার্কিংয়ের জায়গায় যারা দোকান পেয়েছেন, তাদের করপোরেশন থেকে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়। কিন্তু ফুটপাতসহ অন্য জায়গায় নকশাবহির্ভূত দোকানগুলোকে ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়নি। তবে এসব দোকান থেকে ভাড়া নেয়া হয়েছে।

এই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, উচ্ছেদ না করে আপাতত তাদের এক মাস সময় দেওয়ার জন্য তারা মেয়রের সঙ্গে দেখা করে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু মেয়র তাদের অনুরোধ রাখেননি। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ দোকানিদের মার্কেটের ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম তলায় (এই তিনতলায় সংস্কারকাজ চলমান) দোকান বরাদ্দের অনুরোধ করেছেন। এ বিষয়ে মেয়র তাৎক্ষণিক কোনো সিদ্ধান্ত জানাননি।

সিটি প্লাজার একজন দোকানি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আট বছর আগে তিনি ফুটপাতের একটি দোকান ৬০ লাখ টাকায় কিনেছেন। গত মেয়রের শেষ সময়ে ফুটপাতের ওই দোকানের সামনের এক হাত জায়গা বাড়ানোর কারণে তার কাছ থেকে মার্কেট কমিটি আরও ২০ লাখ টাকা নিয়েছেন। যারা ফুটপাতে ব্যবসা করছেন তাদের কমবেশি সবাইকেই দোকানের জায়গা বাড়াতে গিয়ে লাখ লাখ টাকা বিনিয়োগ করতে হয়েছে। এখন এসব উচ্ছেদ করা হয়েছে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের তথ্য অনুযায়ী ফুলবাড়িয়া সুপার মার্কেট-২ এ নকশা বহির্ভূতভাবে ৯১১টি দোকান গড়ে তোলা হয়েছে। মার্কেটটিতে ‘এ’ ব্লকে ১৭৬টি দোকান, ‘বি’ ব্লকে ১৭৬টি এবং ‘সি’ ব্লকে ১৭৯টিসহ মোট ৫৩১টি দোকান থাকার কথা। কিন্তু, নকশাবহির্ভূতভাবে ‘এ’ ব্লকে ৩০৮টি, ‘বি’ ব্লকে ২৯২টি এবং ‘সি’ ব্লকে ৩১১টি দোকান নির্মাণ করা হয়েছে।

ডিএসসিসি সূত্রে জানা গেছে, ডিএসসিসির মেয়র হিসেবে ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস দায়িত্ব নেয়ার পর এই বিপণিবিতানের নকশাবহির্ভূত দোকান এবং এর সার্বিক পরিস্থিতি জানতে একটি কমিটি গঠন করে দেন। সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলীকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের এই কমিটি বিপণিবিতানে নকশাবহির্ভূত ৯১১টি দোকান চিহ্নিত করে এবং সেগুলো উচ্ছেদের সুপারিশ করে। ডিএসসিসির জনসংযোগ কর্মকর্তা আবু নাছের জানান, অভিযানের বিষয়টি আগেই ব্যবসায়ীদের জানানো হয়েছিল। তারপরও তারা বাধা দিয়েছে।


সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

বিষয় : ফুলবাড়িয়া

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //