মৃত্যুপুরী পুরান ঢাকা : কবে টনক নড়বে কর্তৃপক্ষের?

গলির ভিতর হাজার গলি। তার মধ্যেই ঘিঞ্জি বসতি। ঘরে ঘরে ঠাসা রাসায়নিকের ড্রাম। ইঞ্চিটুকুও না ছেড়ে বসেছে দোকান আর রাজ্যের মোকাম। গায়ে গায়ে লাগোয়া মানুষ, গলিরপথে রিকশা ঘোরাই যেন দায়। মাথার ওপরে মাকড়সার জালের মতো ঝুলছে বিপজ্জনক বিদ্যুতের তার। অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রের বালাই নেই। পানির জোগানও নেই বললেই চলে। কোনো কারণে আগুন লাগলে নিজের জীবনটা নিয়ে পালানো ছাড়া কিছুই করার নেই কারও। আর তা মেনে নিয়েই লাখ লাখ মানুষের বাস রাজধানীর পুরান ঢাকায়। একমাত্র নিয়তিই যেন তাদের ভরসা!

গত ২৩ এপ্রিল ভোররাতে আরমানীটোলার হাজী মুসা ম্যানসনে আগুনে পুড়ে প্রাণ হারিয়েছেন সদ্য বিয়ে করা যুবক, কলেজছাত্রীসহ মোট ছয়জন আর আহত হয়েছেন অর্ধশত জন। 

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) এক গবেষণায় দেখা গেছে, প্রায় ২৫ হাজার রাসায়নিক দাহ্য পদার্থের গোডাউনের ওপরেই বসবাস করছে পুরান ঢাকার বিশাল জনগোষ্ঠী। এসবের মধ্যে ১৫ হাজার আছে খোদ বাসা-বাড়িতেই। মাত্র আড়াই হাজার গুদামকে ট্রেড লাইসেন্স দিয়েছে ডিএসসিসি। বাকি ২২ হাজারের বেশি গুদামই অবৈধ। ক্ষতিকর ও ঝুঁকিপূর্ণ ২০০ ধরনের রাসায়নিকের ব্যবসা চলে এসব গুদামে। মূলত রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বহাল তবিয়তে প্রাণঘাতী এ ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন প্রভাবশালীরা। 

তবে ব্যবসায়ীদের দাবি, কেমিক্যালের জন্য আলাদা জোন করে দেওয়ার কথা থাকলেও, তা না দেওয়ায় বাধ্য হয়েই তারা এখানে ব্যবসা করছেন। ২০১০ সালে অবশ্য ওই এলাকাকে পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। তখন রাজউক, সিটি করপোরেশন ও গণপূর্ত অধিদফতর- এ সংস্থাগুলোর প্রধান প্রকৌশলীদের সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করা হয়। ঘিঞ্জি ওই পুরান ঢাকাকে একটি পরিকল্পিত নগরী হিসেবে গড়ে তোলার বিষয়ে একটি প্রতিবেদন দাখিল করে সেই কমিটি; কিন্তু পুরান ঢাকাবাসী রাজি না হওয়ায় তা বাস্তবায়ন করা যায়নি। 

এর আগে আরমানিটোলার হাজী ম্যানশন, চুড়িহাট্টার হাজী ওয়াহেদ ম্যানশন, তার আগে নিমতলী ট্র্যাজেডি- কতশত প্রাণের বিনিময়েও টনক নড়েনি কর্তৃপক্ষ কিংবা বাড়ির মালিকদের। বেশি লাভের আশায় বেশিরভাগ বাসা-বাড়িতে এখনো দাহ্য রাসায়নিকে ঠাসা। অবশ্য বিভিন্ন সময়ে অগ্নিকাণ্ডের পর কেমিক্যাল, প্লাস্টিক কারখানা সরিয়ে নিতে জোর দাবি ওঠে। সরকারের উচ্চমহল থেকেও দেওয়া হয় একগাদা নির্দেশনা। কিছুটা সরব হয় দায়িত্বশীলরা। সময়ের আবর্তে সবই আবার হারিয়ে যায়। পরিস্থিতি মেনে নিয়ে ‘তাজা বোমা’র সঙ্গেই বাস করতে হয় সেখানকার অধিবাসীদের। 

প্রাণের পর প্রাণ ঝরে; কিন্তু সরে না পুরান ঢাকা থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কেমিক্যাল। ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীতে অগ্নিকাণ্ডে ১২৪ জনের মর্মান্তিক মৃত্যুর পরও দেখা যায় সংশ্লিষ্টদের ব্যাপক তৎপরতা। আশ্বাসের পর আশ্বাস, উদ্যোগ, মিটিং, অভিযান- সবই চলছে। তবে দিন যত গেছে সেই তৎপরতা ততই কমেছে, কমতে কমতে এক সময় থমকে গেছে। পুরান ঢাকা যেমন ছিল, তেমনই আছে কেমিক্যাল ব্যবসা। কিছুই সরেনি, কিছুই নড়েনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘বারবারই পুরান ঢাকায় রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে; কিন্তু এর কোনো সুরাহা হচ্ছে না। তাই এটা নিয়ে আমরা ছয়টি সুপারিশ পেশ করেছি। পাশাপাশি আমাদের দেশের জন্য সাবওয়ে নির্মাণ কতটা যৌক্তিক এবং এটার প্রয়োজনীয়তা নিয়েও আমাদের মনে প্রশ্ন রয়েছে।’ 

এই নগর পরিকল্পনাবিদ আরও জানান, বিআইপির সুপারিশগুলোর মধ্যে আবাসিক ভবনে কোনোভাবেই রাসায়নিক গুদাম বা কারখানার অনুমোদন না দেওয়া; রাসায়নিক উপাদান উৎপাদন, বিপণন, বিক্রি ও গুদামজাতের বিষয়ে একটি সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন উল্লেখযোগ্য।

যা আবাসিক, তাই বাণিজ্যিক  

গোলাম মোস্তফা লেনের ৭/১১ নম্বর তিনতলা আবাসিক ভবনের নিচতলার একপাশে বিশাল গুদাম এবং আরেকপাশে দুটি দোকান। গুদামের ভেতর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত মেশিনও চলে। স্থানীয়রা অবশ্য এটিকে প্লাস্টিক দানা ভাঙানোর মিল বলেই চেনেন। আবাসিক এলাকার মধ্যে হলেও ভবনটিতে বাণিজ্যিক, রাসায়নিক গুদামজাত ও কারখানা- সবই চলে। ওপরের দুই তলায় ফ্যামিলি বাসা। ফলে ভবনটিতে যে রাসায়নিক গুদাম ও কারাখানা আছে, তা বোঝার উপায় নেই। সরেজমিনে ঘুরে এমনটাই দেখা গেছে। 

তবে শুধু এ বাড়িটিই নয়, পুরান ঢাকার ৮০ শতাংশের বেশি ভবনে একসঙ্গে চলে আবাসিক-বাণিজ্যিক কার্যক্রম। আরমানিটোলা, বংশাল, মাহুতটুলী, নাজিমউদ্দিন রোড, মিটফোর্ড, কেএম আজম লেন, আগা সাদেক রোড, মাজেদ সরদার রোড ও চাঁনখারপুলের প্রায় সব বাসাতেই একই চিত্র। আবাসিক অনেক বাড়িতে গুদাম থাকলেও বাইরে থেকে দেখে বোঝার উপায় নেই। শুধু পণ্য ঢুকানো ও বের করার সময়ই স্থানীয়রা দেখতে পান। আবার যাদের বাড়িতে গুদাম বা কারখানা রয়েছে তারা প্রভাবশালী। তাদের বিরুদ্ধে কেউ প্রতিবাদ করার সাহসও দেখান না। 

পরিবেশ সংরক্ষণ আইন-১৯৯৫ অনুযায়ী, আবাসিক এলাকায় রাসায়নিক গুদাম ও কারখানা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। আর রাসায়নিক কারখানা, গুদাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, জেলা প্রশাসন, বিস্ফোরক অধিদফতর, শ্রম অধিদফতর, ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশনের ছাড়পত্র বা লাইসেন্স গ্রহণের বিধান রয়েছে। সেইসঙ্গে আলাদাভাবে বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংযোগের প্রয়োজন; কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা করছে না কেউই। বেশিরভাগই পরিচালিত হচ্ছে অবৈধভাবে। 

আবাসিক ভবনে থাকা গোডাউনেই মজুদ হয় প্লাস্টিকের ড্রাম আর দাহ্য রাসায়নিক পদার্থে ভর্তি বস্তা। রয়েছে গ্লিসারিন, সোডিয়াম অ্যানহাইড্রোস, সোডিয়াম থায়োসালফেট, হাইড্রোজেন পার অক্সাইড, মিথাইল ইথাইল কাইটন, থিনার, আইসোপ্রোইল ইত্যাদি। আগুনের সংস্পর্শে এলে ভয়ংকর হয়ে ওঠে এসব রাসায়নিক পদার্থ।

উদ্যোগ হোঁচট খায় সময়ে  

চকবাজার এলাকার বাসিন্দা রবিউল ইসলাম বলেন, ‘ঘনবসতিপূর্ণ পুরান ঢাকার অনেক ভবনেই একসঙ্গে শিল্পকারখানা, রাসায়নিক দাহ্য পদার্থসহ বিভিন্ন মালামালের গুদাম, দোকান ও আবাসিক ফ্ল্যাট রয়েছে। অলিগলিতে গড়ে ওঠছে রাসায়নিকের গুদাম, কারখানা, প্লাস্টিক-পলিথিন কারখানা ও দোকান। এসব প্রতিষ্ঠানে অগ্নিনির্বাপণের নিজস্ব কোনো ব্যবস্থাও নেই। সরু রাস্তা হওয়ায় অগ্নিকাণ্ডের পর ফায়ার সার্ভিসের গাড়িগুলোও দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারে না। আবার অনেক সময় জলাধার না থাকায় পানির অভাবে ফায়ার সার্ভিসকে বেশ বেগ পেতে হয়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘চুড়িহাট্টার ঘটনার পর সিটি করপোরেশন ঢাকঢোল পিটিয়ে অভিযান পরিচালনা দেখে আমরা আশাবাদি হয়েছিলাম; কিন্তু সেই অভিযান বন্ধ হওয়ার পর কেমিক্যাল গোডাউন সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগও যেন থেমে গেছে। নতুন করে আর অভিযানও নেই। ফলে ব্যবসায়ীরা দ্বিগুণ উৎসাহে বাসা-বাড়িতে দোকান-গোডাউন বানাচ্ছেন। সবসময় ভয়ের মধ্যে থাকি। মনে হয় যে কোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে।’

দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, ‘পুরান ঢাকা থেকে কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের স্থানান্তরের বিষয়ে ইতিমধ্যে শিল্প মন্ত্রণালয় একটি উদ্যোগ নিয়েছে। সেটি নিয়ে দক্ষিণ সিটির মেয়রের সঙ্গে শিল্প মন্ত্রণালয়ের বৈঠকও হয়েছে। যেহেতু বিষয়টি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। জমি অধিগ্রহণ, ভবন নির্মাণ, ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরিসহ নানা কাজ- তবুও আশা করছি, ২০২২ সালের মধ্যে স্থানান্তর প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে।’ 

এদিকে ২০১৯ সালে ১ হাজার ৬৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে মুন্সীগঞ্জের সিরাজদীখানে বিসিকের কেমিক্যাল পল্লী স্থাপনের প্রক্রিয়া চলে। প্রকল্পের মেয়াদ ধরা হয় ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত; কিন্তু করোনা পরিস্থিতির কারণে জমি অধিগ্রহণই হয়নি পুরোপুরি। এর মধ্যে আর্থিক জোগান না থাকায় গত বছরের নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে অতিরিক্ত ৮০০ কোটি টাকা চেয়েছিল বিসিক, তা মিলেনি আজও। আবার শ্যামপুরে ৫৪টি কেমিক্যাল গোডাউন করার জন্য ৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্প নেওয়া হয়। চলতি বছরে চালু হওয়ার কথা থাকলেও কোনো অগ্রগতি হয়নি করোনার দোহাই দিয়ে।

ফাইলবন্দি সুপারিশে ধুলোর স্তর  

২০১০ সালে পুরান ঢাকার নিমতলীতে ভয়াবহ অগ্নিকা-ের পর নড়েচড়ে বসে সরকার। দুর্ঘটনা রোধে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের গঠিত কমিটি কেমিক্যাল গোডাউন অপসারণসহ ১৭ দফা নির্দেশনা দেয়। কমিটির দেওয়া সুপারিশমালা বাস্তবায়ন না করায় অসন্তোষ প্রকাশ করে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। 

সর্বোচ্চ আদালত বলেন- ‘দেশের উন্নয়নে প্রধানমন্ত্রী পরিশ্রম করলেও আমলারা একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। অথচ ওই সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে ৮০ শতাংশ দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’ এরপরও অজ্ঞাত শক্তির কারণে ওই সুপারিশমালা দীর্ঘ ১১ বছর ধরে ফাইলবন্দি। 

এর মধ্যেই ২০১৯ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে নিমতলীর ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে চকবাজারের চুড়িহাট্টায়। ওই এলাকার ওয়াহেদ ম্যানশনে গড়ে তোলা কেমিক্যালের গোডাউন থেকে সৃষ্ট ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে মৃত্যু হয় ৭২ জনের। আহত ও দগ্ধের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। ওই ঘটনার তদন্তে নেমেও এক গাদা সুপারিশ দেয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ফায়ার সার্ভিসের কমিটি; কিন্তু সেগুলো অদৃশ্য কারণে ফাইলবন্দি। তাই আবারও ঘটলো আরমানিটোলায় রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা। 

পবার চেয়ারম্যান আবু নাসের খান বলেন, ‘পুরান ঢাকার বাড়ির মালিকরা বেশি টাকা পাওয়ার আশায় আবাসিক ভবনগুলোকে গুদামঘর বা কারাখানার জন্য ভাড়া দিচ্ছেন। আর নিজেরা গিয়ে উঠছেন ধানমণ্ডি, গুলশান ও বনানীতে। যারা এ কাজ করছেন তারা অর্থনৈতিকভাবে খুবই শক্তিশালী, সেইসঙ্গে রাজনৈতিকভাবেও। ফলে আবাসিক এলাকা থেকে কারখানা, রাসায়নিক, গুদামঘর সরিয়ে নেওয়ার কোনো আইন করার চেষ্টা হলেই বাধা দেওয়া হয়। এ কারণে তাদের সরানো যাচ্ছে না। তবে আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিক গুদাম, দোকান ও কারখানা সরাতে সরকারকেই কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। আর যদি তা না হয়, তাহলে নিমতলী, চকবাজারের মতো মানবসৃষ্ট ঘটনা বাড়তেই থাকবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //