ওয়াসার পানির মূল্য বৃদ্ধি

বাড়তি টাকা গুনতে হবে গ্রাহকদের

ওয়াসার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী চলতি মাসের প্রথম দিন থেকেই পানির দাম আরও এক দফা বেড়েছে। নতুন দর অনুযায়ী আবাসিক গ্রাহকদের প্রতি ১ হাজার লিটার পানির দাম দাঁড়াল ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। যা আগে ছিল ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা। নতুন দাম কার্যকর হওয়ায় বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে প্রতি এক হাজার লিটার পানির দাম দিতে হবে ৪২ টাকা, যা আগে ছিল ৪০ টাকা। করোনা মহামারির শুরুর দিকে গত বছরের এপ্রিলেও পানির দাম বাড়িয়েছিল ঢাকা ওয়াসা। তখন আবাসিকে প্রতি ইউনিটের দাম বেড়েছিল ২ টাকা ৯০ পয়সা। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৩ বছরে ১৪ বার পানির দাম বাড়ানো হলো। যদিও ঢাকা ওয়াসার পানির মান নিয়ে গ্রাহকদের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। করোনার এই দুঃসময়ে সেবার মান না বাড়িয়ে, পানির দাম বৃদ্ধি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন নগরবাসী।

অবশ্য ঢাকা ওয়াসা বলছে, এখানে অসচ্ছতা বা নিয়ম লঙ্ঘনের কিছুনেই। কারণ মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে সমন্বয় করতে প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে পানির দাম বাড়ানোর ম্যান্ডেট রয়েছে সংস্থাটির। পানি উৎপাদন ব্যয় ও বিক্রয়মূল্যের মধ্যে অনেক ব্যবধান। তাই পানির দাম বাড়ানো হয়েছে; কিন্তু বিশেষজ্ঞরা ওয়াসার এই বক্তব্যের সঙ্গে একমত নন। তারা বলছেন, সেবার মান নিশ্চিত হলে এই ব্যবধান কমে যেত। এই ব্যবধানের একটি বড় ফারাক হচ্ছে দুর্নীতি। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ঢাকা ওয়াসার পানির সংযোগ রয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার ৬৫১টি। এই সংযোগ থেকে এক কোটির বেশি মানুষ পানি ব্যবহার করে বলে ওয়াসার দাবি; কিন্তু গত বছর ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, রাজধানীর প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ ওয়াসা থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানি পান না। 

রাজধানী বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বলেন, প্রায় আড়াই মাস ধরে আমাদের এলাকায় ঠিকমতো ওয়াসার পানি সরবরাহ ঠিক নেই। বেশিরভাগ সময়ই পানি পাওয়া যায় না। রোজার মাসেও আমরা পানি পাইনি। এ অবস্থার মধ্যেও ওয়াসার পানির দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তে আমরা হতাশ। প্রতি মাসে পানির বিল ঠিকই দেই, তারপরেও পানি পাই না। করোনাকালে মানুষ অসহায় অবস্থায় আছে; কিন্তু এসব কিছু বিবেচনা না করে ওয়াসা তাদের পানির দাম বাড়িয়ে দিল। 

২০১৯ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রতিবেদনে ওয়াসার ১১ খাতে দুর্নীতি চিহ্নিত হয়। ওইপ্রতিবেদনে বলা হয়, অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ, প্রকল্প পরিচালক, সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী ও ঠিকাদারসহ একটি সিন্ডিকেট জড়িত। এসব দুর্নীতির লাগাম টেনে ধরতে ১২ দফা সুপারিশও করা হয়েছিল; কিন্তু সে সুপারিশগুলো আজ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। দুর্নীতি প্রতিরোধেকোনোব্যবস্থাইনেওয়া হয়নি। 

দুর্নীতির অভিযোগ ছাপিয়ে ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগটি হলো ওয়াসার পানি পানযোগ্য বা বিশুদ্ধ নয়। অবশ্য ওয়াসা বরাবরই বলে আসছে যে, পানি বিশুদ্ধ হলেও সরবরাহ পাইপ লাইনে ত্রুটির কারণে সমস্যা হতে পারে; কিন্তু সরবরাহ লাইন ঠিকঠাক রাখাও যে ওয়াসারই দায়িত্ব তা তারা আমলে নেন না। পানি সরবরাহের লাইনে যে স্যুয়ারেজের ময়লা-আবর্জনা ঢুকে পড়ার কথা বলা হয়ে থাকে, সেই পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা ওয়াসারই নির্মিত এবং তা দেখভালের দায়িত্বও সংস্থাটির। কাগজে-কলমে রাজধানী ঢাকায় ওয়াসার ৮৮২ কিলোমিটার পয়ঃনিষ্কাশন লাইন রয়েছে এবং এর সঙ্গে সংযোগ রয়েছে ৬১ হাজার ৩৪৯ জন গ্রাহকের; কিন্তু বাস্তবে অধিকাংশ এলাকায় ওয়াসার পয়ঃসংযোগ লাইন দীর্ঘদিন সংস্কারহীন থাকায় প্রায় অকেজো হয়ে গেছে। 

করোনাকালে পানির দাম বাড়ানোর বিষয়ে সাধারণ নাগরিক পরিষদের আহ্বায়ক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, অনেক এলাকাতে মানুষ ওয়াসার পানি ঠিক মতো পায় না। নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহের দিকে ওয়াসার কোনো নজর নেই। আবার অনেক এলাকাতে ওয়াসার পানিতে দুর্গন্ধের অভিযোগ রয়েছে। চলছে করোনাকাল, এতে অসহায় অবস্থার মধ্যে রয়েছে মানুষ। এ সময় সাধারণ মানুষের কথা না ভেবে ঢাকা ওয়াসা তাদের পানির দাম বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত কীভাবে নিতে পারল? 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ওয়াসার বোর্ডের এক সদস্য বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে অনেক মানুষ অর্থনৈতিকভাবে সংকটে পড়েছেন। অনেকে কাজ হারিয়েছেন। নগরে দরিদ্রতা বেড়েছে। সার্বিক বিবেচনায় এখনই দাম বাড়ানো ঠিক হবে না বলে তিন-চার জন সদস্য সভায় মত দিয়েছিলেন; কিন্তু আইন অনুযায়ী প্রতি বছর পানির দাম বাড়ানো যায় এবং দাম না বাড়ালে ভর্তুকি বাড়াতে হবে এসব যুক্তিতে মূল্যবৃদ্ধির সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়। 

সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান গত এপ্রিল থেকে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। পানির দাম বাড়াতে শুরু থেকেই তাকসিম সবচেয়ে তৎপর ছিলেন। ওয়াসায় যে কোনো সিদ্ধান্তে তার অবস্থানই প্রাধান্য পায়। বোর্ড সভায় যুক্তরাষ্ট্র থেকে অনলাইনে অংশ নেন তাকসিম এ খান। সেখানে থেকে তিনি ওয়াসার নীতি নির্ধারণী বিভিন্ন বিষয়ে ফোন ও অনলাইনে তদারকি করছেন। 

কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, ওয়াসার সামগ্রিকসেবার মান ভালো না। কিছু জায়গায় তাদের সেবা ভালো হলেও, বেশিরভাগ জায়গাতে, বিশেষত ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় তাদের সেবার মান খুব খারাপ। এই পরিস্থিতিতে প্রতি বছর পানির দাম বাড়ানো অযৌক্তিক। তিনি আরও বলেন, ওয়াসার সিস্টেম লসের বিষয়ে অনেক কিছু শোনা যায়। এগুলো কমানো গেলে পানির দাম বাড়াতে হয় না। পানির দাম বাড়ানোর জন্য ভোক্তাদের মতামতের মূল্য দেওয়া উচিত। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এর উদাহরণ আছে। বিদ্যুৎ ও গ্যাসের দাম বাড়ানোর আগে যেমন শুনানির ব্যবস্থা থাকে, পানির ক্ষেত্রেও তা করা জরুরি। 

পানি বিশেষজ্ঞ ম. ইনামুল হক বলেন, ঢাকা ওয়াসা স্বেচ্ছাচারী প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। নোংরা ও দূষিত পানি সরবরাহ করছে এবং জোরপূর্বক পানির দাম বৃদ্ধি করছে। অন্যদিকে শহরের পয়ঃনিষ্কাশন সিস্টেম অকেজো হয়ে পড়লেও পানির সমান দাম আদায় করছে ঢাকা ওয়াসা। এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।

এ প্রসঙ্গে ওয়াসার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী গোলাম মোস্তফা বলেন, দাম বাড়ানো নয়, আমরা একে দাম সমন্বয় বলি। প্রতি বছর পানি উৎপাদন করতে গিয়ে আমাদের খরচ বেড়ে যায়। আইন অনুযায়ী সেই খরচ সমন্বয়ের সুযোগ রয়েছে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //