বেপরোয়া অজ্ঞান পার্টি

সর্বস্ব হারাচ্ছেন সাধারণ মানুষ

রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় গেল জানুয়ারিতে অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছেন শতাধিক ব্যক্তি। এদের অনেককে নিজের প্রাণটাও হারাতে হয়েছে শেষ পর্যন্ত। আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নের (এপিবিএন) সহকারী উপপরিদর্শক (এএসআই) মীর আবদুল হান্নান কর্মরত ছিলেন হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। কর্মস্থল থেকে ছুটি নিয়ে ১৬ জানুয়ারি গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরায় যাওয়ার পথে কেরানীগঞ্জে অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়েন। অচেতন অবস্থায় তাকে উদ্ধার করে পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালে নেওয়া হলে, সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। 

বগুড়ার শেরপুরের জাহিদুল ইসলাম নামের এক সৌদি প্রবাসী গত ১৩ জানুয়ারি দেশে ফিরেই সর্বস্ব হারান। ঢাকার উত্তরা থেকে শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের একটি বাসে বাড়ি যাওয়ার পথেই অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েন। অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে তাকে শেরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়। ব্যবসার কাজে গত ৪ জানুয়ারি ভিক্টর পরিবহনের একটি বাসে করে নদ্দা থেকে গুলিস্তান যাওয়ার পথে এমনই এক অজ্ঞান পার্টির খপ্পরে পড়েছিলেন ব্যবসায়ী বিপুল ঘোষ। তার ধারণা, পাশের সিটে বসা ব্যক্তি নাকের কাছে কিছু ছিটিয়ে অজ্ঞান করে দেয় এবং সঙ্গে থাকা ৫০ হাজার টাকা, মোবাইল, ব্যাগ সবকিছু নিয়ে পালিয়ে যায়। সেই অজ্ঞান পার্টির দেওয়া চেতনানাশক এতটাই ভয়াবহ ছিল যে, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় বিপুলের জ্ঞান ফিরতে তিন দিন পেরিয়ে যায়। 

রাজধানীর নতুনবাজার মসজিদ রোডে পরিবার নিয়ে থাকা এই ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্প্রতি কথা হলে বলেন, ‘সে এক ভয়াবহ অভিজ্ঞতা। আমি মারাও যেতে পারতাম। এখন আমি বাসে উঠলে ঘুমানোর কথা ভাবতেই পারি না।’ 

শপিংমল, ফুটপাতে কেনাকাটার ধুম পড়তেই ক্রেতাদের চোখে চোখে রাখে সদস্যরা। সাধারণ মানুষকে খপ্পরে ফেলতে কখনো আবার তারা ফল বিক্রেতা, শরবত বিক্রেতা, সিএনজিচালক, কখনো বা সাজে ফেরিওয়ালা। নেশাজাতীয় উপদান মেশানো হালুয়া, ট্যাবলেট, পানসহ বিভিন্ন খাবার খাইয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে সর্বস্ব। ইদানীং আতরের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়েও কম দামে বিক্রির নামে মাঠে কাজ করছে চক্রটি। প্রায় প্রতিদিনই বিভিন্ন পেশাজীবীর কেউ না কেউ তাদের খপ্পরে পড়ে খোয়াচ্ছেন টাকা-পয়সা ও জিনিসপত্র। এমনকি মৃত্যুর মতো ঘটনাও ঘটছে। 

আনন্দে নামে বিষাদ : কর্মব্যস্ততার একটি মাস শেষে আসে নতুন মাস। বেতন পাওয়ার এই সময়টা চাকরিজীবীদের কাছে অনেকটা উৎসবের মতো আনন্দের; কিন্তু অজ্ঞান পার্টি, মলম পার্টি কিংবা ছিনতাইকারীদের খপ্পরে পড়ে অনেকের সেই আনন্দ পরিণত হচ্ছে বিষাদে। বেতন নিয়ে বাসায় পৌঁছার পরিবর্তে সর্বস্ব হারিয়ে গন্তব্য হয় হাসপাতাল। আবার কারও ব্যবসার টাকা, কারও জমি বিক্রির টাকা, কেউ বিদেশ থেকে স্বজনের পাঠানো টাকা তুলে ফেরার পথেই খোয়াচ্ছেন। 

কৌশল পাল্টায় সময়ে সময়ে : বাস, ট্রেন ও লঞ্চে যাত্রীবেশে ‘অপারেশন’-এ নামে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। যিনি টার্গেট ঠিক করেন তাকে বলা হয় ‘মাস্টার’। এরপর টিমের সবাই গাড়িতে উঠে নির্দিষ্ট ব্যক্তির পাশে, পেছনে ও কাছের সিটে বসে। শেষের দিকে গাড়িতে ওঠে এক ছদ্মবেশী হকার, তাদের ভাষায় যিনি ‘ডাক্তার’। আচার, চকলেট, মলম, গাছ-গাছড়া বা কবিরাজি পণ্যের গুণাগুণ প্রচার করে বিক্রি শুরু করেন তিনি। প্রচারের জন্য প্রথমে ফ্রি খাওয়ানো বা চেকে দেখতে বলা হয়। সেখানে অন্য যাত্রীদের স্বাভাবিক পণ্য দিলেও টার্গেট ব্যক্তিকে দেওয়া হয় চেতনানাশক মেশানো খাবার। পাশে বসা অজ্ঞান পার্টির সদস্য নিজে খেয়ে ওই যাত্রীর মনে বিশ্বাস জমিয়ে খেতে উৎসাহিত করেন, যাকে বলা হয় ‘বয়ান বাজ’। অজ্ঞান হওয়ার পর পাশের সিটে বসা চক্রের অন্য সদস্য বা ‘ক্যালরিম্যান’ তখন সব হাতিয়ে সুযোগ বুঝে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে। তারপর একে একে সরে পড়ে বাকিরাও। আর তাদের দলে থাকা নারী সদস্যরাও হিজাব বা বোরকা পরে মাঠে থাকে। নারীযাত্রী বা পথচারি হিসেবে নানাভাবে সহানুভূতি আদায় করে শিকারকে ফাঁদে ফেলে তারা। বাস ও ট্রেনে চেতনানাশক গন্ধ শুকানো ও চোখে-মুখে মলম লাগানোর কৌশলও প্রায়ই দেখা যায়।

আবার কোমলপানীয় কিংবা বোতলজাত খাবার পানির সঙ্গে ডায়াবেটিসের চিকিৎসায় ব্যবহৃত ইনসুলিন মিশিয়ে তৈরি করা হয় অজ্ঞান করার রেসিপি। গণপরিবহনে সিটের কাছে ক্লোরোফর্ম জাতীয় রাসায়নিক পদার্থ লাগিয়েও অজ্ঞান করা হয়। লঞ্চের ছদ্মবেশটাও প্রায় অভিন্ন। শুধু তাই নয়, ভিকটিমের মোবাইল দিয়ে পরিবারের সদস্যদের কাছে ফোন করে বলা হয়- আপনার স্বজন এখানে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। এখনই টাকা পাঠানো না হলে তাকে বাঁচানো সম্ভব হবে না। পরিবারের সদস্যরা উদ্বিগ্ন হয়ে টাকা পাঠানোর পর তারা মোবাইল বন্ধ করে দেয়।

ভাগ পায় বাস-কন্ডাক্টরও : বাসের যাত্রীদের লক্ষ্য করে তৎপরতা চালানো মলম পার্টির সাত সদস্যকে কিছু দিন আগে গ্রেফতার করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয় প্লাস্টিকের ছোট কৌটাভর্তি মলম, স্টিলের ছোট কাঁচি ও ঘুমের বড়ি। চক্রের মূল হোতা স্বপন পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, কম পরিশ্রমে বেশি টাকা আয় করার লোভে তার কাছে ভিড়ে অনেকেই। কেউ ১৪ বছর, কেউ এক-দুই মাস ধরে এ কাজ করছেন। দলের সবাই এক হয়ে কৌশলে বাসের সরল যাত্রীদের টার্গেট করে টাকাসহ মূল্যবান মালামাল নিয়ে নেয়। অনেক বাস কন্ডাক্টরও তাদের হয়ে কাজ করে। যাত্রীদের কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া টাকার ভাগ সেই কন্ডাক্টরকে দেওয়া হয়।

নারী সদস্যদের একটি গ্রুপ আবার গৃহকর্মী বা ভাড়াটিয়া সেজে কোনো বাড়িতে গিয়ে উঠে। এক সময় চা, শরবত ইত্যাদির সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে বাড়িওয়ালাদের খাওয়ানো হয়। অজ্ঞান হয়ে গেলে স্বর্ণালঙ্কার, টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয় তারা। এদের একটি চক্র ২০১৮ সালের ২৬ আগস্ট ঢাকার ডেমরায় ভাড়াটে সেজে একইভাবে বাড়ির মালিক আব্দুস সাত্তার ও তার স্ত্রী সাহেরা বেগমকে হত্যা করেছিল। 

ঘাঁটি আছে যেখানে : অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা এলাকা ভাগ করে অপারেশন পরিচালনা করে। টার্গেট ব্যক্তি এলাকার বাইরে চলে গেলে দায়িত্ব হস্তান্তর করা হয় অন্য টিমের কাছে। রাজধানীর গুলিস্তান, সদরঘাট, যাত্রাবাড়ী, টিকাটুলী, সায়েদাবাদ, জুরাইন, পোস্তাগোলা, মুগদা, গাবতলী, কল্যাণপুর, শ্যামলী, আসাদগেট, ফার্মগেট, কারওয়ানবাজার, বাংলামোটর, শাহবাগ, প্রেস ক্লাব, পল্টন মোড়, দৈনিক বাংলা মোড়, বিমানবন্দর রেল স্টেশন, মতিঝিল, কাকরাইল, ফকিরাপুল, কমলাপুর, মালিবাগ, শান্তিনগর, মৌচাক, মগবাজার, রাজারবাগ পুলিশ লাইন মোড়, নিউমার্কেট, পলাশী, লালবাগ, সাতরাস্তা মোড়, মহাখালী, চেয়ারম্যান বাড়ি, বিজয় সরণি, গুলশান মোড়, বাড্ডা, বনশ্রীসহ বিভিন্ন পয়েন্টে এরা বেশি সক্রিয়। এফডিসি গেট, সার্ক ফোয়ারা, বাংলামোটর ও ফার্মগেট এলাকায় এ কাজের সঙ্গে অবশ্য জড়িত রেললাইন বস্তি, রেলস্টেশন বস্তি ও নাখালপাড়া বস্তির উঠতি অনেক যুবক।

অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা ঘাঁটি গেড়েছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও (ঢামেক)। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল থেকে চিকিৎসা নিতে এসে তাদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছেন রোগী ও তাদের স্বজনেরা। প্রতারকরা সাধারণত রোগীর স্বজন পরিচয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের শনাক্ত করা কঠিন। মানুষের সরলতার সুযোগ নিয়ে এরা জুস, কেক বা অন্য কিছু খাইয়ে জিনিসপত্র নিয়ে যায়।

অভিযান চালিয়ে গত কয়েক দিনে বিভিন্ন এলাকা থেকে চক্রের কয়েকজন সদস্যকে আটক করেছে গোয়েন্দা পুলিশ। তাদের কাছ থেকে জব্দ করা হয়েছে বেশ কিছু চেতনানাশক ওষুধ। তবে পুলিশের দাবি, ভুক্তভোগীদের অনেকেই থানায় অভিযোগ করেন না। অভিযোগ না করায় এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়ারও সুযোগ থাকে না তেমন। আক্রান্তদের পরিসংখ্যানও উঠে আসে না। 

পুলিশের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, অজ্ঞান পার্টির কবলে পড়া ব্যক্তিরা হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে যান। এসব ঘটনায় মামলা না করায় আসামিদের ধরলেও গ্রেফতার দেখানো মুশকিল হয়ে পড়ে। আর যেসব ক্ষেত্রে একান্তই মামলা করতে হয়, তখন পুলিশকেই বাদী হতে হয়। পরবর্তীতে তাদের বিরুদ্ধে সাক্ষী পাওয়া যায় না। তাই আদালতে গিয়ে খুব সহজেই জামিনে বেরিয়ে একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা।

প্রাণক্ষয় যে কারণে : ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. মাহবুব হাসান বাপ্পী জানান, অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা মূলত রোরাজিপাম গ্রুপের ‘এপিট্রা’ নামে এক ধরনের তরল ওষুধ এবং নক্টিন ট্যাবলেট ব্যবহার করে। ওষুধ দুটি মূলত দুশ্চিন্তা বা প্যানিক অ্যাটাকের বিপরীতে কাজ করে। তবে এগুলো চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া বিক্রি নিষিদ্ধ। হার্টের সমস্যা, উচ্চমাত্রার ডায়াবেটিস, রক্তচাপ ও লিভারের রোগ থাকে তাহলে মৃত্যুর ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। এছাড়া আক্রান্ত ব্যক্তিকে হাসপাতালে আনতে দেরি হলেও মৃত্যুর ঝুঁকি বেড়ে যায়।

জানতে চাইলে ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ও গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) প্রধান এ কে এম হাফিজ আক্তার জানান, অজ্ঞান পার্টির বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রয়েছে। তবে বেশিরভাগই গণপরিবহন ও ভাসমান অবস্থায় অপরাধ করে। তাই এসব চক্র থেকে রক্ষায় জনসাধারণকেই বেশি সতর্ক হতে হবে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //