মোটরবাইক বেপরোয়া হয়ে ওঠার কারণ কী?

দিন কয়েক আগের ঘটনা, রাজধানীর হাতিরঝিলে সাপের মতো এঁকে বেঁকে তড়িৎ গতিতে ছুটছিল মোটরবাইক। পেছনে বসা বন্ধবীর খোলা চুল টেনে ধরছে পাগলা হাওয়া। তাতেই যেন জাগ্রত তরুণের হিরোইজম- ‘আঠারো বছর বয়স মানে না মানা!’ সামনের পথচারী, সিএনজিচালকদের নাভিশ্বাস; এই বুঝি ধাক্কা মারে মারে! এক সময় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নিজেই উল্টে পড়ে বউবাজারের কাছে। লোকজন ছুটে গিয়ে চোখে-মুখে পানি দিয়ে জ্ঞান ফেরালেন দু’জনকে। প্রাণে রক্ষা পেলেও ভেঙেছে হাত-পা। এ তো গেল দিনের চিত্র।

সন্ধ্যা থেকে রাত- বিপদ বাড়ে আরো বেশি। দল বেঁধে রাস্তায় নামে বখাটেরা। গাড়ি স্টার্ট দিয়েই স্পিড ওঠায় ৪০, ৬০, ৮০, ১০০...। একদল আছে, যারা বাইকের চাকা পেছন দিকে শূন্যে তুলতে ব্যস্ত। দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে হঠাৎ ব্রেক কষে থেমে যাওয়া। সাথে সাথে পেছনের চাকা শূন্যে উঠে ঘুরে বোঁ বোঁ আওয়াজে। এমন নানা কসরত দেখাতে গিয়ে পিচঢালা সড়কে ছিটকে পড়া যেন নিত্যঘটনা। প্রায়ই ঝরছে তাজা প্রাণ। এখন প্রশ্ন উঠছে- কেন এসব মোটরসাইকেল চালককে পাকড়াও করছে না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এমন নয় যে, এই শহরে পুলিশ নেই!

বিশ্লেষকরা বলছেন, এসব বাইকারদের বেশিরভাগই কিশোর। তাদের মধ্যে অধিকাংশেরই নেই লাইসেন্স। সবাই প্রায় মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। মাঝে সাঝে জরিমানা আদায় করেই দায়িত্ব শেষ করছেন পুলিশ। তবে নানা অঘটন ঘটালেও কেন এদের ধরা হয় না? এর জবাবে এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, ‘শহরের কাউকে ধরলেই একগুচ্ছ নেতার ফোন আসবে। অনেক মাদকাসক্ত যুবকও রয়েছে। তাদের ধরে নিয়ে গেলেও বিপত্তি। কে এসব অশান্তি সামলাবে!’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন ‘ধরি মাছ, না ছুই পানি’ অবস্থানের সুযোগেই বাড়ছে দুর্ঘটনা। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সামাজিক ব্যাধি দূর করতে পুলিশকে একটু কঠোরই হতে হবে। নয় তো আগামী দিনে তৈরি হবে ভয়ংকর পরিস্থিতি। 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউট (এআরআই) রাইড শেয়ারিংয়ের ৪৫০টি মোটরসাইকেলের চালক ও আরোহীর ওপর একটি জরিপ করে। তাতে উঠে আসে- ৫০ শতাংশ আরোহী চালকের চালানো নিয়ে অনিরাপত্তায় ভোগেন। আবার চালকের ৩০ শতাংশ অতি নিম্নমানের হেলমেট পরেন। আরোহীদের মাত্র ২ শতাংশ ‘ফুলফেস’ হেলমেট পড়েন। রাইড শেয়ারিং মোটরসাইকেলের চালকদের প্রতিযোগিতাও কম নয়। অধিক ট্রিপ দিতে তারাও বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালান। সারাদেশে সড়কে বিশৃঙ্খলা ও প্রাণহানির বড় কারণ এটি। প্রতিবারের মতো যানজট না থাকায় এবারের ঈদযাত্রা অনেকটাই স্বস্তিকর হলেও সড়কে প্রাণ ঝরার সংখ্যা নেহায়েত কম নয়। ঈদের আগে-পরে নিহতের সংখ্যাটা দুইশ’র ওপর। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যকই ছিল কিশোর মোটরসাইকেল আরোহী। 

রাজধানীর জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠান (নিটোর) বা পঙ্গু হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, অ্যাম্বুলেন্স, মাইক্রোবাস, সিএনজিচালিত অটোরিকশা কিংবা ব্যক্তিগত গাড়িতে করে একটু পরপরই রোগী আসছে হাসপাতালে। কারও হাত, আবার কারও পা দুর্ঘটনায় ক্ষত; কেউ আবার যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। পঙ্গু হাসপাতালের প্রতিটি ওয়ার্ডই ছিল রোগীতে ঠাসা, যাদের বেশির ভাগই ভর্তি হয়েছেন ঈদের ছুটিতে। তাদের সামলাতে এক্স-রে মেশিন নিয়ে ব্যস্ত টেকনোলজিস্টরা যেন হিমশিম খাচ্ছেন। ব্যস্ততার শেষ ছিল না অস্ত্রোপচার কক্ষেও।

হাসপাতালের জরুরি বিভাগের ইনচার্জ ডা. হেলেনা খাতুন জানান, ঈদের আনন্দ করতে গিয়ে ছুটির ছয় দিনে বেপরোয়া বাইক, সিএনজি ও অটোরিকশাসহ অন্যান্য যানবাহনে দেড় হাজারেরও বেশি রোগী ভাঙা কিংবা কাটা হাত-পা নিয়ে ভর্তি হয়েছেন। সড়ক দুর্ঘটনায় পঙ্গু হাসপাতালে ভর্তি রোগীর সংখ্যা কয়েক বছরের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ। সাধারণত দৈনিক ১০০ থেকে সর্বোচ্চ ১৫০ রোগী ভর্তি হন। আহতদের অনেকেরই অবস্থা গুরুতর। হাত-পা পর্যন্ত কেটে ফেলতে হয়েছে। এদের বেশিরভাগই কিশোর-তরুণ, যারা মোটরসাইকেলে চেপে সড়কে বেপরোয়া ঈদ উদযাপন করতে গিয়ে গুরুতর আহত হয়েছে। জরুরি ওয়ার্ডে জায়গা না হওয়ার অনেককে চিকিৎসা দিতে হচ্ছে বারান্দায়।

জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুনর্বাসন প্রতিষ্ঠানের পরিচালক অধ্যাপক ডা. আবদুল গণি মোল্লা বলেন, ‘প্রতি ঈদেই আমাদেরকে একটা ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়। উৎসবের এই সময়ে মানুষ এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যাওয়ায় দুর্ঘটনা বাড়ে। তবে অন্যান্য বারের তুলনায় এবার দুর্ঘটনায় আহত হয়ে আসা রোগীর সংখ্যা বেশি। এর মধ্যে যে পরিমাণ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে, আমার মনে হয় তা গত কয়েক বছরেও হয়নি।’

দেশের সড়ক ব্যবস্থাপনা ও দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থা রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এক প্রতিবেদনে জানায়, গত ২৫ এপ্রিল থেকে ৬ মে পর্যন্ত সারা দেশে ১৭৮টি দুর্ঘটনায় মোট ২৪৯টি তাজা প্রাণ ঝরেছে পিচঢালা সড়কে। নিহতদের মধ্যে ৯৭ জন ছিল মোটরসাইকেল আরোহী। আবার এদের মধ্যে অর্ধেকের বেশি অপ্রাপ্তবয়স্ক, যাদের বয়স ১৫ থেকে ১৮ বছরের মধ্যে। অর্থাৎ গত ১০ দিনের সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোদের মধ্যে অপ্রাপ্তবয়স্ক ও মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে ৫৭ শতাংশ। আর ২০২১ সালে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটে ২ হাজার ৭৮টি। নিহত হয় ২ হাজার ২১৪ ও আহত ১ হাজার ৩০৯ জন। নিহতের মধ্যে ৭৪ দশমিক ৩৯ শতাংশই ১৪ থেকে ৪৫ বছর বয়সী।

এআরআই পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘ঈদের সময় সড়ক ফাঁকা থাকে। ফাঁকা রাস্তায় বেপরোয়া গতিতে যানবাহন চলাচলে দুর্ঘটনা বাড়ে। এবারো তাই হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত মোটরসাইকেল চালক ও আরোহীদের বড় অংশই কিশোর ও তরুণ। অধিকাংশেরই লাইসেন্স ছিল না। সড়কে মোটরসাইকেল চালানোর দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সক্ষমতা নেই। কীভাবে সড়কে বাইক চালাতে হয় এই কিশোরদের অধিকাংশই তা জানে না। এমনকি সড়ক পরিবহন আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে হেলমেটও ব্যবহার করেনি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নাকের ডগা দিয়ে উঠতি বয়সীরা বেপরোয়াভাবে মোটরসাইকেল চালিয়েছে।’ 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ মোটরসাইকেল ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করছে। যেখানে বাংলাদেশ হাঁটছে পুরো বিপরীত পথে। মোটরসাইকেলকে সহজলভ্য করা হয়েছে। ব্যবহারকে উৎসাহ দিয়ে বাড়ানো হচ্ছে এর ইঞ্জিনক্ষমতাও (সিসি)। আর এ দুটিই আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। এতে দুর্ঘটনার শঙ্কা আরও বাড়বে, সড়ককে আরো ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলবে। মোটরসাইকেল এখন ঢাকা মহানগরেও ‘মরণযান’ হিসাবে পরিচিত। অ্যাপভিত্তিক সেবার পাশাপাশি চুক্তিতেও যাত্রী পরিবহন করছে হাজার হাজার মোটরসাইকেল। বড় গাড়ির চেয়ে এর নিবন্ধনও প্রায় ২২ গুণ বেশি। 

বিআরটিএর হিসাব মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত মোটরসাইকেলের ২৫ শতাংশই ঢাকায়। দুই বছর আগে প্রতিদিন গড়ে ৩১৫টি প্রাইভেটকার নিবন্ধিত হতো। এখন সেটা নেমে এসেছে ৫০টিতে। অন্যদিকে মোটরবাইক নিবন্ধিত হচ্ছে প্রতিদিন গড়ে ৫০০টি। আর জেলা শহর ও গ্রামীণ এলাকা দাঁপিয়ে বেড়ায় অনিবন্ধিত অন্তত ১৫ লাখ মোটরসাইকেল।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) তথ্য অনুযায়ী, করোনা মহামারির কারণ চলাচল সীমিত থাকলেও ২০২০ সালে সারা দেশে ৩ লাখ ১১ হাজার ১৬টি মোটরসাইকেল নিবন্ধন নিয়েছেন গ্রাহকরা। ২০২১ সালে নিবন্ধন নিয়েছেন ৩ লাখ ৭৫ হাজার ২৫২টি মোটরসাইকেল। চলতি বছরের এই কয় মাসে তা ধারাবাহিকভাবে বাড়ছে।

বিআরটির তথ্য মতে, সারাদেশে ৩৫ লাখ ৮৫ হাজার ৪৮৮টি মোটরসাইকেল রয়েছে। এর মধ্যে শুধু ঢাকায় আছে ৯ লাখ ১৪ হাজার ৮১৭টি। জানতে চাইলে বিআরটিএর পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মাহবুব-ই-রব্বানী বলেন, সঠিক নিয়ম মেনেই মোটরসাইকেলের লাইসেন্স দেওয়া হয়; কিন্তু লাইসেন্স নেওয়ার পর চালকরা নিয়ম মানেন না। আবার অনেকে লাইসেন্স ছাড়াই চালাচ্ছেন। এমনকি যত্রতত্র মোটরসাইকেল চালানোর কারণেই দুর্ঘটনা বাড়ছে।

রোড সেফটি ফাউন্ডেশন নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘মোটরাইকেলে বাড়ি যাওয়ার সংখ্যা এবার বেড়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ এই যানটিতে করে ১৫-২০ লাখ মানুষ ঈদে বাড়িতে গেছেন। যে যেভাবে পারছে বাইক চালাচ্ছে। আর বেপরোয়াভাবে বাইক চালানোর কারণে বাড়ছে দুর্ঘটনার পরিমাণ।’ 

বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘এবার ঈদে যাত্রাপথে স্বস্তি ছিল; কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটেছে বরাবরের মতোই। গণপরিবহনের সংখ্যা না বাড়ায় মানুষ ব্যক্তিগতভাবে বাইকে করে বাড়ি ফিরেছেন। এ কারণেই দুর্ঘটনার সংখ্যা বেড়েছে। আর এ আশঙ্কায় আমরা আগেই মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ করতে বলেছিলাম।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //