সুপেয় পানির সংকটে রাজধানীবাসী

ঢাকা ওয়াসার সরবরাহকৃত পানির মান নিয়ে বরাবরই প্রশ্ন রয়েছে। সাম্প্রতিককালে এই প্রশ্ন আরো গুরুতর আকারে দেখা দিয়েছে। রাজধানীবাসীর পানি সরবরাহের একমাত্র প্রতিষ্ঠান ঢাকা ওয়াসার পানির ওপর ন্যূনতম ভরসা করার কোনো উপায় নেই। দুর্গন্ধযুক্ত পানিতে ময়লা-আবর্জনা-কেঁচো ইত্যাদি পাওয়া যাচ্ছে।

নতুন উপসর্গ হিসেবে এমন কিছুর মিশ্রণও লক্ষ্য করা যাচ্ছে, যাতে পানি পান তো দূরের কথা, অজু-গোসলেও তা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পানি ব্যবহারের ফলে হাত-মুখ-গায়ে জ্বালা পোড়া এমনকি চর্মরোগও হচ্ছে। মানুষকে পানি ফুটিয়ে পান করতে হচ্ছে। এতে গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। অনেকে দোকান ও ওয়াসার এটিএম বুথ থেকেও পানি কিনে খাচ্ছেন। এতে তাদের পানি বাবদ দ্বিগুণ অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানে ওয়াসার পক্ষ থেকে উল্লেখযোগ্য কোনো ভূমিকা দেখা যাচ্ছে না। ওয়াসা কর্তৃপক্ষ বলছে, শীতলক্ষ্যার দূষিত পানি ও পাইপে লিকেজ এ দুটি কারণে পানিতে দুর্গন্ধ থেকে যাচ্ছে। 

এর মধ্যে বিপাকে পড়েছেন রাজধানীর ফার্মগেটের তেজতুরি পাড়ার ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দারা। সুপেয় পানির জন্য দীর্ঘ দিনের আক্ষেপ তাদের। ঘনবসতিপূর্ণ এই এলাকার বাসিন্দারা প্রায় কয়েক বছর ধরে জনপ্রতিনিধিদের কাছে ধরনা দিয়েও সুফল পাচ্ছেন না। অতিরিক্ত ময়লা পানির জন্য অসুস্থ হয়ে পড়ায় মসজিদ থেকে একবেলা পানি নিয়ে পান করছেন এলাকাবাসী। 

সরেজমিনে কথা হয় বৃদ্ধ হাসান মিয়ার সাথে। তিনি এসেছিলেন পানি বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য। 

এ বয়সেও কেন এত পরিমাণে পানি টানতে হয়, জানতে চাইলে হাসান মিয়া বলেন, ‘পানিতে সব সময় দুর্গন্ধ থাকে। নতুন লাইন লাগানোর পর তা আর খাওয়ার উপযোগী নেই। এখন এখান থেকে দুই দিন পর পর পানি বয়ে নিয়ে যাচ্ছি। পানি না নিলে রান্না-বান্না সব বন্ধ হয়ে যাবে। প্রতিদিন আসা তো সম্ভব নয়, তাই দুই দিন পর পর এসে বেশি করে পানি নিয়ে যাই।’

এলাকাবাসী জানান, তাদের কলোনির পানিতে আয়রণ বেশি থাকে। বার বার ফুটানোর পরও গন্ধ দূর করা যায় না। ফলে পানি খাওয়া অসম্ভব হয়ে পরে। তাই এলাকার মসজিদের কল থেকে তাদের পানি নিয়ে আসতে হয়। ওয়াসার কোনো কার্যকলাপ এখানে তারা কোনো দিন দেখেনি।

ওই এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে বসবাস করেন মো. আজাদ হোসেন। তিনি বলেন, মে-তে পানি অনেকটা পরিষ্কার পাওয়া গেছে। তবে পানি পান করার মতো এখনো উপযোগী নয়। লালচে রঙ এখনো আছে। এটা সবাই জানে; কিন্তু সমাধানের কোনো ধরনের উদ্যোগ আজ পর্যন্ত কেউ নেয়নি।’

এলাকাবাসী জানান, কিছু দিন আগেও তারা মসজিদ থেকে বিশুদ্ধ পানি সংগ্রহ করত। তবে এখন তাও সম্ভব হচ্ছে না। কারণ ওয়াসা থেকে বিল অতিরিক্ত আসার কারণে মসজিদ কমিটি পানি দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে। 

ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ২৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর শামীম হাসান এ বিষয়ে সাম্প্রতিক দেশকালকে জানান, এলাকার অনেক জায়গায় পানিতে গন্ধ আছে। আমরা ওয়াসাকে এ বিষয়ে অবগতও করেছি। ওয়াসার লোকজনও একবার দেখে গেছে। তারা বলছেন, এমনটা হওয়ার কথা নয়। আবারো এ বিষয়ের ওপর খতিয়ে দেখবেন তারা, কেন এবং কোথায় সমস্যা হচ্ছে। তখন আমরা পুরো বিষয়টা তদারকি করে পানির লাইনগুলো ঠিক করে দেব।

এ বিষয়ে ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খানের সাথে কয়েকবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও, তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

রাজধানী ফার্মগেটের এই চিত্র মিরপুর, কামরাঙীরচর, পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বেশিরভাগ জায়গায়। সুপেয় পানির কারণে বিক্ষোভও হতে দেখা গেছে অনেক জায়গায়। তারপরও ওয়াসার কোনো ভ্রুক্ষেপ দেখা যায় না। 

ঢাকা ওয়াসা রাজধানীতে দুটি ক্ষেত্র থেকে মানুষকে বাড়ি বাড়ি পানি সরবরাহ করে থাকে। একটি হলো ভূগর্ভস্থ পানি, যা গভীর নলকূপের মাধ্যমে উত্তোলন করা হয়। ওয়াসা বর্তমানে মোট সরবরাহ করা পানির ৬৭ ভাগই এ খাত থেকে দিয়ে থাকে। পানি সংগ্রহের আরেকটি খাত হলো ভূ-উপরিস্থ খাত। অর্থাৎ বিভিন্ন নদীর পানি পরিশোধন করে তা সরবরাহ করা হয়। ওয়াসা বর্তমানে ৩৩ ভাগ পানি এ খাত থেকে সরবরাহ করে থাকে। ভূগর্ভস্থ পানির জন্য ওয়াসার বর্তমানে ৯০৬টি পাম্প রয়েছে। আর ভূ-উপরিস্থ খাত থেকে পানি সরবরাহের জন্য ওয়াসার রয়েছে পাঁচটি পানি শোধনাগার। এর মধ্যে অন্যতম সায়েদাবাদের পানি শোধনাগার। এখানে দুটি প্ল্যান্ট রয়েছে। আরো একটি প্ল্যান্ট তৈরির কাজ চলছে। সায়েদাবাদের এ শোধনাগার থেকে ওয়াসার ১, ৬, ৭ ও ৮ নম্বর জোনে পানি সরবরাহ করা হয়। এসব জোনের বাসিন্দা দীর্ঘ দিন ধরেই দুর্গন্ধযুক্ত পানি নিয়ে সমস্যায় রয়েছেন।

মুগদা, বাসাবো, শাজাহনপুর, যাত্রাবাড়ীসহ আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, তাদের বছরের পর বছর পানি নিয়ে ভূগতে হচ্ছে। বিশেষ করে গরমের সময় এলেই পানিতে দুর্গন্ধ বেড়ে যায়।

মুগদা ব্যাংক কলোনির বাসিন্দা মোস্তফা কামাল বলেন, গত কয়েক মাস ধরেই আমাদের এলাকায় পানিতে দুর্গন্ধ। পানি ফুটালে ফেনা তৈরি হয়। এ পানি খাওয়া যায় না। গোসল করলেও চুল আঠার মতো হয়ে যায়। নিয়মিত শ্যাম্পু করা লাগে। আর খাওয়ার জন্য পানি বাইরে থেকে কিনে আনতে হয়। ওয়াসার এটিএম বুথ থেকে কার্ড করা হয়েছে। সেখান থেকে নিয়মিত পানি আনতে হয়। তিনি এ এলাকায় সায়েদাবাদের পানির পরিবর্তে পাম্পের পানি সরবরাহ করার দাবি জানান।

পশ্চিম শেওড়াপাড়ার চন্দ্রিমা সড়কের বাসিন্দা আমিনুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ দিন ধরেই এ এলাকায় পানিতে প্রচণ্ড দুর্গন্ধ। পাইপ দিয়ে ময়লা বের হয়। এমনকি মাঝে মধ্যে পানিতে লাল পোকাও পাওয়া যায়। এ পানি দিয়ে খাওয়া তো দূরের কথা গোসলও করা যায় না।

ঢাকা ওয়াসার পরিচালক (কারিগরি) এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, আমরা রাজধানীর চারটি জোনে শীতলক্ষ্যার পানি সরবরাহ করে থাকি। গরমকালে শীতলক্ষ্যার পানিতে অ্যামোনিয়া বেড়ে যায়। আমরা বারবার ক্লোরিন দিয়ে এ পানি শোধন করে তারপর গ্রাহকদের কাছে পৌঁছাই। পানিতে ক্লোরিনের কিছু গন্ধ থেকে যায়। এছাড়া চোরাই লাইনের কারণে কিছু জায়গায় লিকেজ হলে, সেখানকার পানিতে বাইরের ময়লা প্রবেশ করলে তখন গন্ধ হয়। তিনি বলেন, আমরা ল্যাবে ১০টি এলাকার পানি নিয়ে পরীক্ষা করে দেখেছি, তাতে অন্য কোনো রোগের জীবাণু পাওয়া যায়নি। পানির দুর্গন্ধ দূর করতে বৃষ্টির জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই বলেও তিনি জানান।

এ মুহূর্তে পানির গন্ধ দূর করা একটি চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে এ কে এম সহিদ উদ্দিন বলেন, শীতলক্ষ্যার পানি শোধনের পরও অ্যামোনিয়ার গন্ধ থেকে যায়। এখানে প্রি-ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট আছে। তবুও পানিতে গন্ধ থাকে। এ সরবরাহের পানি ভূগর্ভস্থ পানির সাথে মিশিয়ে সরবরাহ করা হয়, যাতে গন্ধ কম লাগে। তবু প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে যেসব এলাকায় ডায়রিয়ার প্রকোপ বেশি, সেসব এলাকার পানিতে ক্লোরিনের পরিমাণ বাড়িয়ে দিতে বলা হয়েছে, যাতে কোনো জীবাণু থাকলেও তা ধ্বংস হয়ে যায়।

সূত্র জানিয়েছে, ঢাকা ওয়াসার রাজস্ব জোন-৪-এর রাজস্ব কর্মকর্তা মো. সামছুল ইসলাম খান পানির সংকট রয়েছে, এমন এলাকার একটি তালিকা করে চিঠি দিয়েছেন নির্বাহী প্রকৌশলীকে। ১১ এপ্রিল দেওয়া চিঠির কপি অফিসে গ্রহণ করেছে ১৩ এপ্রিল। চিঠির অনুলিপি দেওয়া হয়েছে ওয়াসার বাণিজ্যিক ব্যবস্থাপক, প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা ও তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলীকে।

চিঠিতে বলা হয়, রাজস্ব জোন-৪-এর আওতাধীন বিভিন্ন এলাকায় গ্রাহকরা তীব্র পানির সংকটে ভুগছেন। দৈনন্দিন কাজকর্ম সারতে তাদের বেশ দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। গ্রাহকরা রাজস্ব পরিদর্শক বা বিলিং সহকারীদের কাছে প্রতিনিয়ত পানি সংকটের অভিযোগ করছেন। চিঠিতে রাজস্ব আদায়ের কাজ গতিশীল রাখার স্বার্থে এলাকাগুলোর পানি সংকট সমাধানে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও পরিচালক (রোগনিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, দুর্গন্ধযুক্ত পানির কারণে ডায়রিয়াসহ নানা ধরনের রোগে আক্রান্ত হচ্ছে গ্রাহকরা। জনগণের প্রতি সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন। জনসচেতনতা বাড়ানোর বিষয়ে কারও দ্বিমত থাকার কথা নয়; কিন্তু ঢাকাবাসীকে পানি সরবরাহকারী ঢাকা ওয়াসাকে সচেতন করবে কে? তারা দফায় দফায় পানির দাম বাড়িয়ে চলেছে; কিন্তু বিশুদ্ধ খাবার পানি সরবরাহ করতে পারছে না। জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে পড়েছে। এর দায় ঢাকা ওয়াসাও এড়াতে পারে না।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //