রাজধানী ঢাকায় গণপরিবহনে চলাচল করা কিশোরী-তরুণী ও নারীদের ৬৩ শতাংশ নানা ধরনের হয়রানির শিকার হয়। এরমধ্যে প্রায় ৪৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়। যৌন হয়রানির শিকার এই নারীদের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক (৪৫ শতাংশ) পরবর্তী সময়ে মানসিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন।
আজ শুক্রবার (৩ জুন) ভার্চুয়াল মাধ্যমে আঁচল ফাউন্ডেশন আয়োজিত অনুষ্ঠানে এই জরিপ প্রতিবেদনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়। অনুষ্ঠানে আঁচল ফাউন্ডেশন জানায়, জরিপ প্রতিবেদনে রাজধানী ঢাকার বাস, ট্রেন, লেগুনা, রাইড শেয়ারিং বাহনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। গুলশান, আজিমপুর, মিরপুর, বনানী, ধানমন্ডিসহ বিভিন্ন এলাকার স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং কর্মজীবী নারী ও কিছু সংখ্যক গৃহবধূর ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়।
‘ঢাকা শহরে গণপরিবহনে হয়রানি: কিশোরী এবং তরুণীদের মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর প্রভাব’ শিরোনামের এক জরিপ প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। যৌন হয়রানির মধ্যে রয়েছে গণপরিবহনে ওঠা-নামার সময় চালকের সহকারীর অযাচিত স্পর্শ, বাসে জায়গা থাকার পরও যাত্রীদের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো, বাজেভাবে স্পর্শ, বাজে মন্তব্য ও ধাক্কা দেওয়া। জরিপে অংশগ্রহণকারী বেশির ভাগ নারী ঝামেলা এড়াতে এসব ঘটনার প্রতিবাদ করেননি।
যৌন নিপীড়নকারীদের মধ্যে যাত্রীর সংখ্যাই বেশি। গণপরিবহনের চালক ও চালকের সহকারীর হাতেও নিপীড়নের শিকার হয়েছেন অনেকে। নিপীড়নকারীদের মধ্যে ৪০ বছরের বেশি বয়সীদের সংখ্যা বেশি। জরিপে ১৩ থেকে ৩৫ বছর বয়সী ৮০৫ নারী অংশ নেন। এর মধ্যে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৮৬ শতাংশ।
জরিপ শুরুর সময়ের ৬ মাস আগ পর্যন্ত হয়রানির মুখোমুখি হয়েছেন এমন নারীদের তথ্য যুক্ত করা হয়েছে। অফলাইন ও অনলাইনে জরিপ করা হয়। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলা হয়। জরিপটি পরিচালনা করা হয় এ বছরের জানুয়ারি থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যৌন হয়রানির পাশাপাশি ১৫ শতাংশ বুলিং, ১৫ শতাংশ সামাজিক বৈষম্য, ১৫ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য এবং ৮ শতাংশ শারীরিক গঠন নিয়ে হয়রানির শিকার হয়েছেন। কারা যৌন নিপীড়ন করেছে জানতে চাইলে জরিপে অংশ নেওয়া ৭৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, তারা অন্য যাত্রীদের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন। ২০ শতাংশ চালকের সহকারী, ৩ শতাংশ হকার এবং ২ শতাংশ চালকের মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জানিয়েছেন।
প্রায় ৬২ শতাংশ কিশোরী ও তরুণী জানিয়েছেন, ৪০ থেকে ৫৯ বছর বয়সীদের মাধ্যমে যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ৩৬ শতাংশ জানিয়েছেন, কিশোর ও যুবদের মাধ্যমে যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারী যাত্রী ওঠানো-নামানোর সময় চালকের সহকারীদের নেমে দাঁড়ানোর কথা থাকলেও তারা বাসের দরজায় অবস্থান করে অযাচিতভাবে স্পর্শ করে বলে অভিযোগে এসেছে।
প্রায় ৬১ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, ওঠা-নামার সময় সহকারীরা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে স্পর্শ করেছে। প্রায় ২৫ শতাংশ নারী জানিয়েছেন, ছয় মাসে অন্তত তিনবার তাঁদের এ ধরনের স্পর্শের মুখোমুখি হতে হয়েছে।
‘কোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার বেশি হয়েছেন’ জানতে চাইলে জরিপে অংশগ্রহণকারী ৩১ শতাংশ কিশোরী-তরুণী জানিয়েছে, গণপরিবহনে অনেক সময় ফাঁকা জায়গা থাকলেও অন্য যাত্রীরা ইচ্ছাকৃতভাবে গাঘেঁষে দাঁড়ায়। ইচ্ছাকৃতভাবে হালকাভাবে স্পর্শের শিকার হয়েছেন ১৮ শতাংশ। ইচ্ছাকৃতভাবে ধাক্কার শিকার হয়েছেন ১৪ শতাংশ। প্রায় ১৪ শতাংশ কিশোরী-তরুণী জানিয়েছেন তারা বাজে মন্তব্যের শিকার হয়েছেন। হালকা ভিড়ে প্রায় ৩৩ শতাংশ এবং অতিরিক্ত ভিড়ে ২৭ শতাংশ যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ঝামেলা এড়াতে বেশির ভাগ নারীই প্রতিবাদ করেননি।
প্রতিবেদনের তথ্য উপস্থাপন করেন আঁচল ফাউন্ডেশনের নির্বাহী সদস্য ফারজানা আক্তার। অনুষ্ঠানের সভাপতিত্ব করেন আঁচল ফাউন্ডেশন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তানসেন রোজ।
অনুষ্ঠানে অতিথির বক্তব্যে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকর্ম বিভাগের অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান ইসমাইল হোসাইন বলেন, জরিপে যা উঠে এসেছে তা উদ্বেগজনক। সমাজে জেন্ডার ভারসাম্য ও সমতার বিষয়টি যে নেই তা এ তথ্য থেকেই বোঝা যাচ্ছে। এ সমস্যার সমাধানের জন্য আইনি ও সামাজিকভাবে উপায় বের করতে হবে।
অতিথি আইনজীবী শাইখ মাহদি বলেন, গণপরিবহনে নারী হয়রানি ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট কোনো আইনি প্রতিকার নেই। তবে দণ্ডবিধি এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের কিছু ধারায় এ ধরনের কিছু হয়রানির বিরুদ্ধে প্রতিকার পাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। তিনি বলেন, নীরব থাকলে অপরাধীরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠবে।
‘তাই তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ, ৯৯৯ বা ১০৯ এ কল করে সাহায্য চাওয়া এবং আইনি ব্যবস্থা নিতে কিছু প্রমাণ জোগাড় করা যেমন মুঠোফোনে ভিডিও করা বা কথা রেকর্ড করে রাখার মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে পারেন নারীরা।’ যোগ করেন তিনি।
আঁচল ফাউন্ডেশন হয়রানি প্রতিরোধে ১০ দফা প্রস্তাব করেছে। এর মধ্যে রয়েছে, গণপরিবহনে আসনের বেশি যাত্রী না তোলা, গণপরিবহনের ভেতর ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা স্থাপন, গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো, নারীদের জন্য আলাদা পরিবহনের ব্যবস্থা, বাসের চালক, তত্ত্বাবধায়ক ও সহকারীর পরিচয় উল্লেখ করে নেমপ্লেট বাধ্যতামূলক করা।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
বিষয় : গণপরিবহন যৌন হয়রানি আঁচল ফাউন্ডেশন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh