একের পর এক উড়োজাহাজে ধাক্কার ‘নেপথ্যে’

ঢাকার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের হ্যাঙ্গারে গত কয়েকমাসে একাধিকবার দুই বিমানের মধ্যে ধাক্কার ঘটনা ঘটেছে। এসবে কয়েকটি বিমান ক্ষতিগ্রস্তও হয়েছে।

সাধারণত মূল্যবান এই বাহনের রক্ষণাবেক্ষণ অতি সাবধানতার সাথেই করা হয়। ফলে এমন দুর্ঘটনা বিশ্বে খুবই বিরল। তবে বাংলাদেশে যেন চিত্রটি একাবারেই ভিন্ন।

গত তিন মাসে দুইবার হ্যাঙ্গারে একটি বিমানের সাথে অন্যটির ধাক্কা লাগার ঘটনা ঘটলো।

গত রবিবারে সর্বশেষ ঘটনাটি ঘটে। সিঙ্গাপুর থেকে বিমানের ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটি ওইদিন রাতে ঢাকায় আসে।

যাত্রী নামিয়ে রাত ৯টার দিকে এটিকে যখন হ্যাঙ্গারে নেওয়া হচ্ছিল, তখন হ্যাঙ্গারে থাকা বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজের ডানায় ধাক্কা লাগে। ফলে দুটি উড়োজাহাজই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

৭৮৭ উড়োজাহাজের ডান পাশের ডানা এবং ৭৩৭ উড়োজাহাজের বাঁ পাশের ডানা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রায় একই ধরনের ঘটনা ঘটেছিল গত ১০ এপ্রিল। সেদিনের দুর্ঘটনায়ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল একটি বোয়িং ৭৩৭। সেবারও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বোয়িং ৭৩৭ হ্যাঙ্গারে নেওয়ার সময় ঘটনাস্থলে আগে থেকে থাকা বোয়িং ৭৭৭-এর সঙ্গে ধাক্কা লাগে।

এ ঘটনায় বোয়িং ৭৩৭ এর সামনের অংশ আর বোয়িং ৭৭৭ পেছনের অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ৭৩৭ উড়োজাহাজের সামনে ওয়েদার রাডার আর ৭৭৭ উড়োজাহাজের ভার্টিক্যাল স্ট্যাবিলাইজার ভেঙ্গে যায়।

এর আগে ১ ফেব্রুয়ারি বিমান বাংলাদেশের ড্যাশ-৮ কিউ ৪০০ উড়োজাহাজ আকাশতরীর ফ্লাইটে ওভার পাওয়ার ব্যবহার করেন পাইলট।

ফলে আকাশতরীর দুটি ইঞ্জিন ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া গত ৪ জুন দাঁড়িয়ে থাকা একটি বোয়িং বিমানে ধাক্কা দেয় ইউএস বাংলার এয়ারলাইন্সের একটি গ্রাউন্ড সার্পোট ইকুইপমেন্ট (জিএসই)। এই উড়োজাহাজটিকে পরবর্তীতে মেরামত করতে হয়।

১৬ জুন ৭৮৭ ড্রিমলাইনার যাত্রী নামানোর পর সেটি থেকে বোর্ডিং ব্রিজ না খুলেই পার্কিংয়ের নেওয়ার জন্য ধাক্কা দিতে শুরু করেন রক্ষণাবেক্ষণ কর্মীরা।

ফেব্রুয়ারিতে মালয়েশিয়া থেকে বাংলাদেশে ফেরার সময় বোয়িং ৭৩৭এর উইন্ডশিল্ডে ফাটল বা ক্র্যাক দেখতে পান পাইলট।

তিন মাসের মধ্যে দুই বার হ্যাঙ্গারে বিমানের ধাক্কা লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার পেছনে বিমান কর্মীদের গাফিলতি এবং অবহেলা মূল কারণ বলে উঠে এসেছে।

বিমান বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক যাহিদ হোসেন বলেন, আমরা একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলাম, তাদের রিপোর্ট আমরা পেয়েছি যে, এতে দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের গাফিলতি ছিল।

তিনি জানান, প্রথম ঘটনাতেও তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর চারজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়, যাদের মধ্যে মুখ্য প্রকৌশলীও রয়েছেন। রবিবারের ঘটনাতেও তিনজনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।

যখন কোনো উড়োজাহাজ রানওয়ে থেকে রক্ষণাবেক্ষণের জন্য হ্যাঙ্গারে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন সেটি ঠিকভাবে নেয়ার জন্য চারজন কর্মী কাজ করেন। একজন ককপিটে থাকেন, দুজন দুইদিকে আর একজন বাইরে থাকেন।

এই ঘটনায় তদন্তকারীরা দেখতে পেয়েছে, যার দায়িত্ব ছিল, তিনি নিজে সেটা না করে অন্য আরেকজনকে করতে বলেছেন। বিমান হ্যাঙ্গারে নেয়ার সময় যেসব নিয়ম অনুসরণ করতে হয়, দুটি ঘটনাতেই প্রকৌশলী ও কর্মীরা তা ঠিকভাবে অনুসরণ করেননি।

এই ঘটনার পেছনে অন্তর্কোন্দল ছিল কি-না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেটা গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলতে পারবে। তবে আমরা এটা বলতে পারি, এ ঘটনায় তাদের মারাত্মক নেগলিজেন্সি আছে।

এই ঘটনা নিয়ে এর মধ্যেই একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা তদন্ত করতে শুরু করেছে। তবে এখনো তাদের চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়া যায়নি।

যাহিদ হোসেন বলছেন, বিমান কিন্তু অপারেশনের দিক থেকে ভালো করছিলাম। কিন্তু দুঃখজনক হলো, এসব ঘটনা আমাদের ইমেজকে ম্লান করে দিচ্ছে।

৭৮৭ উড়োজাহাজের ক্ষতি বেশি হয়নি জানিয়ে তিনি বলছেন, সেটা এর মধ্যেই আবার যাত্রী পরিবহন শুরু করেছে। তবে ৭৩৭ উড়োজাহাজের মেরামত চলছে।

তবে বিমানের একজন কর্মকর্তা বিবিসিকে জানান, বিমানের এমনিতেই জনবল সংকট ও কর্মীদের প্রশিক্ষণের অভাব রয়েছে। বিশেষ করে যারা রক্ষণাবেক্ষণ বা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং সার্ভিসে কাজ করেন, তারা অনেকেই প্রশিক্ষিত নন, কাজের সময় তদারকির অভাব রয়েছে।

ফলে উড়োজাহাজ রক্ষণাবেক্ষণ বা গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিং করার সময় যেসব নিয়ম বা প্রটোকল মানতে হয়, সেগুলো তারা ঠিক মতো মানেন না। এসব ব্যাপারে তাদের ওপরে তদারকিও করা হয় না। কারও কারণে উড়োজাহাজের ক্ষতি হলে বড় ধরনের শাস্তি দেয়ার নজিরও তৈরি হয়নি।

এসব কারণে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটতে দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ বিমানে বর্তমানে ২১টি উড়োজাহাজ রয়েছে। তার মধ্যে ১৮টি নিজস্ব ও তিনটি লিজ নেওয়া।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //