মশা নিয়ন্ত্রণে গাছ ও মাছ

দেশে আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়ে। আর এসব রোগ ছড়াতে মশার বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। গ্রীষ্ম হোক বা বর্ষা, মশার আতঙ্ক থাকে চরমে; আবার হালকা ঠান্ডায় সন্ধ্যা নামলেই ঘরবাড়িতে শুরু হয় ঘোরাফেরা। সুযোগ বুঝে হুল ফুটিয়ে শুষে নেয় রক্ত, ছড়িয়ে যায় রোগের জীবাণু।

ফলে এক বছর চিকুনগুনিয়া তো আরেক বছর ডেঙ্গু- কোনো না কোনোভাবে মশাবাহিত রোগ ভোগায় নগরবাসীকে। চিরুনি অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা বা জেল-জরিমানা করেও মশা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন।

নগরবাসীর অভিযোগ, ঢাকা উত্তর (ডিএনসিসি) ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) অদক্ষতার কারণেই নগরে মশার প্রকোপ। কামান দাগার মতো বিভিন্ন কর্মসূচি নিলেও বাস্তবে এর ফল শূন্য। মূলত মশা নিয়ে সংস্থা দুটির কার্যকর কোনো কর্মপরিকল্পনাই নেই। 

এদিকে মশার কারণে বিদেশি যাত্রী ও পাইলটদের কাছে বেশ বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষকে। সারা বছর যেমন-তেমন, নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত ঝাঁকে ঝাঁকে মশার উৎপাতে স্বাভাবিকভাবে দাঁড়ানোই কঠিন হয়ে পড়ে দেশের প্রধান এ বিমানবন্দরে।

উড়োজাহাজে মশা ঢুকে পড়ায় ফ্লাইট দেরি হওয়ার মতো ঘটনার নজিরও আছে। ক্ষুদ্র এ পতঙ্গের প্রকোপ থেকে রক্ষায় গত এক দশকে প্রথাগত নানা উপায়ে চেষ্টা করেও খুব বেশি সুবিধা মেলেনি। তাই এবার প্রাকৃতিক পদ্ধতি অনুসরণ করেছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ। প্রথাগত পদ্ধতির পাশাপাশি তারা গাপ্পি মাছ, গাঁদা ও তুলসী গাছ দিয়ে মশা তাড়ানোর প্রাকৃতিক ব্যবস্থা নিয়েছে। পাশাপাশি চলছে জোর পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম।

এ বিষয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক গ্রুপ ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ কামরুল ইসলাম জানান, ডেঙ্গু মশা নিধন এবং সামনের শীত মৌসুমে কিউলেক্স মশার সমস্যা নিরসনে ডিএনসিসি ও সরকারের কমিউনিক্যাবল ডিজিজ কন্ট্রোল (সিডিসি) দপ্তরের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

কয়েক মাস আগে বিমানবন্দরের এয়ার ও ল্যান্ড সাইডের বিভিন্ন খাল ও পুকুরে ছাড়া হয়েছে গাপ্পি মাছ। একই সঙ্গে মশা নিরোধক গাছ যেমন- গাঁদা, লেমন গ্রাস ও তুলসী রোপণ করা হয়েছে। এরই মধ্যে গত জুলাই ও সেপ্টেম্বরে সিডিসির দুটি জরিপে দেখা গেছে, বিমানবন্দরের পরিচ্ছন্নতা ও লার্ভার নিয়ন্ত্রণ আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে সন্তোষজনক।

এখন প্রশ্ন উঠছে- বিমানবন্দরে প্রাকৃতিক উপায়ে মশা নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে পুরো ঢাকায় এ পদক্ষেপ নিতে সমস্যা কোথায়? মূলত নগরীর জলাশয় ও লেক ঘিরেই বেশি উৎপাত। গুলশান-বনানী লেক ও হাতিরঝিল যেন এখন মশার খনিতে পরিণত। কারণ লেক-খালগুলোয় বাসাবাড়ির মালিকরা সুয়ারেজ লাইন দিয়ে রেখেছেন।

অথচ এসব জলাশয়ে গাপ্পি মাছ চাষ ও পাড়গুলোতে গাঁদা, নিম ও তুলসী গাছ লাগালে মশা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেত। নগর পরিকল্পনাবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, মশার বংশবিস্তারের ঊর্বর ক্ষেত্র রাজধানীর বদ্ধ জলাশয়, বিশেষ করে খাল, বক্স কালভার্ট ও ড্রেন। এগুলো কোনো সময় পরিষ্কার থাকে না। 

কীটতত্ত্ববিদরা বলছেন, মশা পানিতে প্রজনন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে। পতঙ্গটির জীবনচক্র চারটি পর্যায়ে মধ্যে তিন ধাপই কাটে জলাশয় কিংবা এর কাছাকাছি। ডিম, শূক, মুককীট সময় পার করে পূর্ণাঙ্গ মশা হয়ে উঠেই চারদিকে শুরু করে উৎপাত।

ফলে জলাশয়ে মশার প্রজনন প্রক্রিয়া বন্ধ করা গেলে উৎপাত নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। গাপ্পি মাছ আকারে ছোট, দাম কম। এটি মশা, ডিম, শূক, মুককীট খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে। ফলে মশার প্রজনন হয় এমন জলাশয়ে গাপ্পি মাছ চাষ করলে দ্রুত সুফল মিলবে। অন্যদিকে কিছু গাছ আছে সেসব গাছের ঘ্রাণে মশা থাকে না। গাঁদা ফুল, তুলসী, পুঁদিনা, ল্যাভেন্ডার জাতীয় গাছ মশা প্রতিরোধে সহায়তা করে।

রাসায়নিক ব্যবহার করলে মশা মারার পাশাপাশি মানুষের স্বাস্থ্যের অবনতি ঘটতে পারে। তাই মশা তাড়ানোর সহজ উপায় বাড়িতে মশা নিরোধক গাছ লাগানো। যে গাঁদা ফুল বাড়ি ও বাগানে সৌন্দর্য এনে দেয়, তা মশা তাড়াতেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আসলে গাঁদা গাছ ও ফুলের সুগন্ধ খুব শক্তিশালী, যা আমাদের কাছে মিষ্টি মনে হলেও মশা ও পোকামাকড়ের কাছে মারাত্মক। গাঁদার একটি ছোট গাছও একটি পরিবারকে প্রাকৃতিকভাবে মশার কবল থেকে রক্ষা করতে পারে।

একইভাবে ঘরের সৌন্দর্য বাড়ানো ল্যাভেন্ডার ফুলের সুবাসও মশা তাড়াতে সহায়তা করে। প্রাকৃতিক ল্যাভেন্ডার তেলের গন্ধ খুব শক্তিশালী এবং কার্যকর, যা বাড়ির পরিবেশকে সুগন্ধযুক্ত করে তোলে। সেই সঙ্গে এ ঘ্রাণ মশা ও পোকামাকড়ের জন্য ক্ষতিকর। বাজারে এমন অনেক মশা তাড়ানোর ল্যাভেন্ডার তেল বিক্রি হয়।

আজকাল সবাই কিচেন গার্ডেনিং করতে পছন্দ করে, যাতে ছোট ছোট সবজিগাছ পাত্রে লাগানো হয়। যদি একটি পাত্রে রসুনের চারা রোপণ করা হয়, তখন এর গন্ধে মশা আর বাড়ির চারপাশে ঘোরাফেরা করবে না। এ ছাড়া নিয়মিত রসুন খেলে এর উপাদান রক্তে মিশে যায়, মশা তখন সেই রক্ত আর পান করে না।

তুলসী গাছে প্রচুর ঔষধি গুণ রয়েছে, এটি সেবনে ঠাণ্ডা, সর্দি, জ্বর ও ভাইরাসজনিত সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এটি মশা তাড়াতেও সহায়ক। তুলসী গাছ এবং এর পাতার একটি খুব শক্তিশালী সুগন্ধ রয়েছে, যা আশপাশের পরিবেশকে বিশুদ্ধ করতে কাজ করে। মশার আবার এ সুগন্ধি বেশ অপছন্দের। নিমপাতা সিদ্ধ করে বা পিষে স্প্রে করলে ঘরের ভেতরে থাকা মশা মারা যায়। বাড়ির আশপাশে এবং ছাদ কিংবা বারান্দা-বাগানে এসব গাছ লাগাতে পারেন যে কেউ।

শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাখাওয়াৎ হোসেন অবশ্য বলেন, সন্ধ্যায় উড়ে আসা মশা মারার চেয়ে এর বংশবিস্তার রোধ জরুরি। তবেই উপদ্রব কমবে। কোনো এলাকায় যদি মশার উৎপাত বেশি হয়, তা হলে বুঝতে হবে ২০০-৩০০ মিটারের মধ্যেই এদের বসবাসের জায়গা। তখন সেটিকে ধ্বংস করতে হবে। সেই সঙ্গে বাড়ির আশপাশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখলে মশার উপদ্রব নিয়ন্ত্রণ সহজ।

কীটতত্ত্ববিদ ড. জিএম সাইফুর রহমান বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে মূল সমস্যা হলো তৃপ্তিতে ভোগা। নিজেরাই নিজেদের ব্যবস্থাপনাকে রোল মডেল বলা। আবার কিছু না করেই বেশি বেশি প্রচার চালানো। অথচ মশা নিয়ন্ত্রণে যেসব পদ্ধতি অবলম্বন করতে হয় সেগুলো করা হয় না। মশা নিয়ন্ত্রণে কীটনাশক ও প্রকৃত জ্ঞানেরও ঘাটতি রয়েছে দায়িত্বশীলদের। ফলে মশা বাড়ছে।

মশা নিয়ন্ত্রণে তদারকি কমিটির কার্যক্রম বাড়ানোর পাশাপাশি বিশেষজ্ঞদের নিয়ে একটি মূল্যায়ন কমিটি করার পরামর্শ দিয়েছেন কীটতত্ত্ববিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কবিরুল বাশার। তিনি বলেন, আমাদের দেশে এখনো মশাবাহিত রোগীর সংখ্যা বেশি। তবে দুঃখজনক হলো- দেশে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে কোনো মূল্যায়ন কমিটি নেই। এ কারণে আমরা মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণে পিছিয়ে আছি বলেও জানান তিনি।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, মশা নিয়ন্ত্রণে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন কার্যকর উদ্যোগ নিতে ব্যর্থ। তাই নভেম্বরে শীতের মৌসুমেও ব্যাপকভাবে ডেঙ্গুতে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন। বিগত বছরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মৌসুমে এডিসের ব্যাপক প্রভাব দেখা যেত, এবার শীতেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে এলো না। এখন মনে হচ্ছে- সারা বছরই কিছু না কিছু ডেঙ্গু রোগী থাকবে।

তাই মশা নির্মূলে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীসহ দেশের সাধারণ মানুষকে সঙ্গে নিয়ে প্রোগ্রাম চালাতে হবে। সেই সঙ্গে প্রাকৃতিক উপায়ে মশা তাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। কেননা মশা মারতে গিয়ে ব্যবহৃত রাসায়নিক বা কীটনাশক মানুষেরই বেশি ক্ষতি করছে।

ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তারা অবশ্য বলছেন, নিয়ম মেনেই চলছে মশা নিয়ন্ত্রণকাজ। সাধারণত এডিস মশা বাসাবাড়িতে অব্যবহৃত পাত্র বা জমে থাকা পানিতে জন্মায়। সেখানে সিটি করপোরেশনের ওষুধ ছিটানোর সুযোগ থাকে না। নিজ উদ্যোগেই সবাইকে বাড়ির চারপাশ পরিষ্কার রাখতে হবে, সচেতন হতে হবে নিজেদের।

এর বাইরে ড্রেন, নালা বা অন্য কোনো স্থাপনায় মশা জন্মালে তার দায় সিটি করপোরেশনের। সে অনুযায়ী তারা কাজ করছে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা বলেন, মশা নিধনে সচেতনতার পাশাপাশি নিয়মিতই অভিযান চালাচ্ছে সিটি করপোরেশন। তবে এক্ষেত্রে নগরবাসীকেও দায়িত্ব নিতে হবে। সবার সহযোগিতা পেলে মশা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। 

ডিএসসিসি প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. ফজলে শামসুল কবির বলেন, মশা নিধনে সিটি করপোরেশন নিয়মিত ক্র্যাশ প্রোগ্রাম করছে। এ ছাড়াও যেসব এলাকায় ডেঙ্গু রোগীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে, সেসব এলাকায় সঙ্গে সঙ্গেই মশার ওষুধ ছিঁটানো হচ্ছে। ফলে দেশে প্রতিদিন যে হারে ডেঙ্গু রোগী মিলছে, এর ১০ ভাগেরও কম ডিএসসিসিতে।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //