কংক্রিটই কি তাপ বাড়াচ্ছে ঢাকার

৫৮ বছরের মধ্যে গতকাল রবিবার (১৬ এ্রপ্রিল) রাজধানী ঢাকার তাপমাত্রা বেড়ে সর্বোচ্চ ৪০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ওঠে। এর আগের দিন গত শনিবার (১৫ এপ্রিল) ঢাকার তাপমাত্রা ৪০.৪ সেলসিয়াসে উঠেছিল। যা ছিল সর্বোচ্চ। জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক কারণ ছাড়াও পরিবেশগত স্থানীয় কিছু অব্যবস্থাপনাকেও অব্যাহত এই তাপপ্রবাহের জন্য দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, ঢাকা নিজেই একটি উষ্ণকুণ্ড। নগরের বিভিন্ন অবকাঠামো ও ভবন নির্মাণে ব্যবহৃত কংক্রিট তাপমাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলছে। কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিলে ঢাকার তাপমাত্রা দুই ডিগ্রির মতো কমানো যেত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়া বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক তৌহিদা রশিদ বলেন, বছরের এই সময়ে অর্থাৎ এপ্রিল-মে মাসে তাপমাত্রা বেশিই থাকে। কিন্তু এবারের ভিন্নতা হচ্ছে টানা ১৫-২০ দিন ধরে এই তীব্র তাপদাহ। অতি তীব্র তাপদাহও হয়েছে।

ঢাকায় এত বেশি তাপদাহ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, তাপমাত্রা বাড়ার বৈশ্বিক কারণ তো রয়েছেই। কিন্তু আমাদের স্থানীয় কিছু অব্যবস্থাপনা এড়াতে পারলে তাপদাহ ১ থেকে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস কমানো যেত। এর মধ্যে রয়েছে জলাশয়গুলো রক্ষা না করা, নগরে গাছপালা কমে যাওয়া। শহরে জনসংখ্যা অনেক বেশি, যার কারণে যানবাহন বেশি, কলকারখানা বেশি।

তবে আশার কথা শুনিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কিছু অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, যার ফলে একটা ইতিবাচক পরিবর্তন আসবে। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন মেট্রোরেল পুরোপুরি চালু হলে অনেকেই আছেন গাজীপুর থেকে ঢাকায় অফিস করে আবার গাজীপুরে ফিরে যাবেন। ফলে তার পরিবারও হয়তো সেখানে থাকবে। এতে করে শহরের জনসংখ্যা কমবে। এর ফলে বাড়তি জনসংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত যানবাহনও কমবে।

পরামর্শ দিয়ে এই অধ্যাপক বলেন, গাজীপুর এবং নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন শহরেও জনসংখ্যা বাড়ছে। সেখানে ঢাকার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে যদি এখনই সতর্ক হওয়া যায়, অর্থাৎ ওই নগরগুলো যেন ঢাকার মতো অপরিকল্পিত না হয়, সেখানকার জলাশয় ও সবুজায়ন রক্ষায় এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।

উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, যেমন বঙ্গবাজারের জায়গাটি এখন খালি হয়েছে, এই জায়গাটি খালিই রাখা বা সেখানে সবুজায়ন করা এবং এমন খালি জায়গা আরও খুঁজে বের করে ঢাকা শহরে যতটা সম্ভব সবুজায়ন বা জলাশয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। তা ছাড়া ঢাকা শহর থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেওয়ার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, আবাসিক এলাকা থেকে সব ব্যবসাকেন্দ্রই সরিয়ে নেওয়া উচিত। তাতেও আবাসিক এলাকায় তাপদাহ কমে আসবে।

জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ঢাকা তো গ্লোবাল বাস্তবতার বাইরে নয়। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, আশপাশের গ্রামীণ এলাকার তুলনায় রাজধানীর তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি বেশি থাকে। নগরায়ণ হলে অবকাঠামোগত উন্নয়ন হবেই, কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি ব্যালেন্স করে করা হয়, জলাশয় ও সবুজায়ন ঠিক রেখে করা হয়, তা হলেই এই যে ঢাকা নিজেই একটি উষ্ণকুণ্ড হয়ে আছে, তা থেকে রক্ষা করা যেত।

ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ২০১৯ সালেও ঢাকা শহরে ৮২ শতাংশ কংক্রিট বা অবকাঠামো ছিল। বাকিটা ছিল খোলা। এখন তা কমে মাত্র ৫ শতাংশেরও নিচে খোলা জায়গা।

তিনি বলেন, ঢাকাকে এমন উষ্ণকুণ্ড থেকে রক্ষা করতে হলে ঢাকার চারিপাশে বিস্তৃর্ণ এলাকাজুড়ে সবুজ বনায়ন করতে হবে, ঢাকার আশপাশের জলাশয়গুলোকে রক্ষা করতে হবে। একই সঙ্গে ঢাকার যেটুকু জলাশয়, গাছগাছালি, খালি জায়গা ও মাঠ আছে সেগুলোকে অক্ষত রাখতে হবে।

আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাজধানী ঢাকার সঙ্গে গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ শহর মিলে বিরাট অঞ্চলজুড়ে শহর হয়ে যাচ্ছে। এটিও একটি আশঙ্কার বিষয়। তবুও নতুন নগরায়ণের স্থানগুলোতে যেন ঢাকার মতো ভুল না হয়, জলাশয়, গাছপালা ও খালি জায়গা ধ্বংস না হয় সেদিকে সজাগ থাকতে হবে।

এদিকে গতকাল রবিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টার জন্য দেওয়া আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রবিবার দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা উঠেছে যশোর ও চুয়াডাঙ্গায় ৪১.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা ‘অতি তীব্র’ তাপদাহ ছুঁইছুঁই। আবহাওয়া অধিদফতরের হিসাব মতে, তাপদাহ ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁলেই তাকে অতি তীব্র তাপদাহ বলা হয়। গত ২৪ ঘণ্টায় দেশের কোথাও বৃষ্টি হয়নি।

আবহাওয়াবিদ মুহাম্মদ আবুল কালাম মল্লিক স্বাক্ষরিত এই পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, রবিবার দেশে সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ছিল সৈয়দপুরে ১৯.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আজ সোমবার সন্ধ্যা ৬টার পরবর্তী ৪৮ ঘণ্টার (২ দিন) আবহাওয়ার পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ‘তাপমাত্রার সামান্য পরিবর্তন হতে পারে।’ আর বর্ধিত ৫ দিনের আবহাওয়ার অবস্থা সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এ সময়ের শেষের দিকে বৃষ্টি বা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে। 

এদিকে গত ১৫ দিন ধরে দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হচ্ছে চুয়াডাঙ্গায়। সময়ের আলোর চুয়াডাঙ্গা প্রতিনিধি জানিয়েছেন, তীব্র তাপদাহের কারণে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে বেশি বিপাকে রয়েছে খেটে খাওয়া মানুষ। হাসপাতালেও গরমজনিত রোগীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালে ডায়রিয়া ওয়ার্ডে শিশুসহ ৬৬ জন রোগী ভর্তি রয়েছে। গরমে শিশুরা বেশিরভাগ ডায়রিয়া ও জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে।

চুয়াডাঙ্গা সদর হাসপাতালের শিশু কনসালটেন্ট ডা. মাহবুবুর রহমান মিলন বলেন, গরমে শিশুদের ডায়রিয়া, টাইফয়েড, শরীরে ঘাম বসে নিউমোনিয়া, ঠান্ডা, সর্দি-কাশি, জ্বর ও প্রস্রাবে সংক্রমণ দেখা দিচ্ছে। এসব রোগ নিয়েই হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসছে তারা। আমরা শিশুকে ঘরের বাইরে বের হতে না দেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছি অভিভাবকদের। সেই সঙ্গে বিশুদ্ধ পানি ও টাটকা খাবার খাওয়াতে এবং ফ্যানের নিচে রাখতে বলছি।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //