বায়ুদূষণে জন্ম নিচ্ছে কম ওজনের শিশু

নানা ধরনের দূষণে বিপর্যস্ত বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য। সবচেয়ে বেশি ভোগাচ্ছে নারী ও শিশুদের। বায়ুদূষণের কারণে ঢাকা শহরে কম ওজনের শিশু জন্মাচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত এক গবেষণা থেকে এ তথ্য পাওয়া গেছে। 

গবেষণা বলছে, সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েরা সবচেয়ে বেশি কম ওজনের শিশু জন্ম দিচ্ছে। কারণ হিসেবে গবেষণায় বলা হয়েছে, বাতাসের মধ্যে ভেসে বেড়ানো অতিসূ² ধাতবকণা সহজেই মায়ের শরীরে প্রবেশ করতে পারে এবং ভ্রুণের যথাযথ বিকাশ বাধাগ্রস্ত করে থাকে। চলতি বছরের মার্চে মহাখালীর আইসিডিডিআরবি এই গবেষণা প্রতিবেদনটি প্রকাশ করে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বের বায়ুমান যাচাই বিষয়ক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান ‘এয়ার ভিজ্যুয়াল’ বায়ুমান সূচক এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স (একিউআই) অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় প্রথম তিনটির মধ্যে একটি। ঢাকার বাতাসে উড়তে থাকা ধূলিকণা, যানবাহন ও কারখানার ধোঁয়া এবং ইটভাটা বায়ুদূষণের মূল কারণ। এ কারণে গর্ভবতী মায়েরা সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার এই ঢাকাতেই হয়ে থাকে। এর পাশাপাশি নানা ধরনের দূষণ গর্ভাবস্থাকে আরও জটিল করে তুলেছে। 

আইসিডিডিআরবির প্রতিবেদন বলছে, বায়ুদূষণ বা বাতাসে থাকা অতিসূক্ষ্ন বস্তুকণার কারণে ভ্রুণের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি দূষণের শিকার মায়েরা কম ওজনের শিশু জন্ম দেন ৩৬ শতাংশ আর সবচেয়ে কম দূষণের শিকার মায়েদের কম ওজনের শিশু জন্মের হার ২০ শতাংশ। বেশি দূষণের শিকার মায়েদের কম ওজনের শিশু ১৬ শতাংশ বেশি জন্মে থাকে। জন্মের সময় আড়াই কেজি (২৫০০ গ্রাম) ওজনের কম শিশুকে কম ওজনের শিশু (লো বার্থ ওয়েট) জন্ম বলা হয়ে থাকে।

অন্যদিকে কম বায়ুদূষণের শিকার মায়েরা ৯ শতাংশ অপরিণত শিশু জন্ম দিয়ে থাকে। বেশি দূষণের শিকার মায়েরা এর চেয়ে আরও ৬ শতাংশ বেশি অর্থাৎ ১৫ শতাংশ অপরিণত শিশু জন্ম দিয়ে থাকে। উল্লেখ্য, মায়ের গর্ভধারণের ২৫৯ দিন অর্থাৎ ৮ মাস ১৯ দিনের আগে জন্ম নিলে তা অপরিণত শিশু হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে।

গবেষণায় ভারী ধাতুর ক্ষুদ্র কণার একটি ধারণা দেওয়া হয়েছে। ভারী ধাতু বা ধুলা-বালির ক্ষুদ্র কণাকে একটি চুলের সঙ্গে তুলনা করলে এসব কণার আকার এতটাই ক্ষুদ্র হবে যে এটি একটি চুলের প্রায় ২০ ভাগের এক ভাগের সমান হবে। বৈজ্ঞানিক ভাষায় এই ক্ষুদ্র কণার আকার পার্টিকল মেটার বা পিএম ২.৫ বা এর চেয়ে ছোট ধরা হয়। এসব ধূলিকণা বা ভারী ধাতুর কণা এত ক্ষুদ্র যে খুব সহজেই নাক-চোখ ও মুখ দিয়ে শরীরের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে এবং ফুসফুস, হার্ট, কিডনি, লিভারের মতো অঙ্গের ক্ষতি করে থাকে এবং কম ওজনের শিশু জন্মে ভূমিকা রাখে।  

ঢাকায় সম্প্রতি ভূমিষ্ঠ ৩ হাজার ২০৬টি নবজাতককে নিয়ে করা ওই গবেষণায় গর্ভাবস্থায় বেশি বায়ুদূষণের শিকার মায়েদের মধ্যে কম ওজনের শিশু জন্ম দেওয়ার হার বেশি পাওয়া গেছে। সেই সঙ্গে গর্ভে পূর্ণ সময় থাকার আগেই অপরিণত অবস্থায় শিশু জন্মদানের ঝুঁকিও তাদের মধ্যে বেশি ছিল বলে গবেষণায় বলা হয়েছে।

আইসিডিডিআরবি ছাড়াও টেক্সাস এঅ্যান্ডএম ইউনিভার্সিটির গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গর্ভাবস্থায় পরিবেশ দূষণের সংস্পর্শে আসার ফলে গর্ভকালীন শিশুর ওপর অনেক বিরূপ প্রভাব পড়ছে। ফলে শিশুর প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত এই প্রভাব স্থায়ী হওয়ার আশঙ্কা থাকে। গর্ভধারণের ক্ষেত্রে সিসা বা লেড, ক্যাডমিয়াম, নিকেল, মার্কারি ইত্যাদির মতো ভারী ধাতু অনেকটা নীরব ঘাতকের মতো ক্ষতি করে যাচ্ছে।

এই ধাতুগুলো আমরা দূষিত পরিবেশ থেকে পেয়ে আসছি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সিসাকে জনস্বাস্থ্যের জন্য অন্যতম ক্ষতিকর রাসায়নিক উপাদান হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গর্ভাবস্থায় কোনো শিশু এ ধরনের ভারী ধাতুর সংস্পর্শে এলে সেই শিশুর স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এবং তার দৃষ্টি, শ্রবণ ও মস্তিষ্কের বিকাশজনিত সমস্যা থেকে শুরু করে আচরণগত সমস্যা তৈরি হতে পারে বলে টেক্সাস ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদন বলছে। 

গবেষণা বলছে, আমাদের দৈনন্দিন নানা কাজে আমরা না চাইলেও সিসাসহ অন্যান্য ভারী ধাতুর সংস্পর্শে আসতে হচ্ছে। আমাদের খাদ্য চক্রে ক্ষতিকর এসব ধাতু ঢুকে পড়েছে। 

বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি রসায়ন বিভাগের স্থানীয় পর্যায়ের এক গবেষণায়, বেগুনের মধ্যে সহনীয় মাত্রার দ্বিগুণের বেশি সিসা পাওয়া গিয়েছে। এছাড়া ১০ শতাংশ বেগুনে ক্যাডমিয়াম সহনীয় মাত্রার চেয়ে চার গুণ বেশি পাওয়া গেছে। ওই বেগুন যেখানে উৎপাদিত হয়েছে সেখানকার মাটিতে সিসা, ক্যাডমিয়াম, তামা ও দস্তার মতো ভারী ধাতু স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি মাত্রায় ছিল বলে গবেষণায় উঠে আসে।

গবেষকরা বলছেন, কীটনাশকে মিশ্রিত সবজি পানিতে অনেকবার ধুয়ে কিংবা উচ্চতাপে রান্না করলেও ভারী ধাতু থেকে যায় এবং খাদ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং গ্রহণকারীর দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। ফলন বাড়াতে মাটিতে রাসায়নিক মিশ্রিত সারের ব্যবহার এবং কীটনাশক প্রয়োগ করা হয় এবং এসব কীটনাশক থেকে ভারী ধাতুর মাত্রা ক্রমেই বাড়ছে বলে পরিবেশবাদীরা অভিযোগ করেছেন।

এসব ধাতুর সংস্পর্শে আসলে গর্ভবতী মা ও শিশুসহ যে কোনো মানুষের হার্ট, কিডনি, লিভার, স্নায়ু, ত্বককে আক্রান্ত করতে পারে। হলুদ গুঁড়াতেও বেশ কয়েকবার সিসা শনাক্ত হয়েছে। হলুদে সিসা মেশালে এর রং উজ্জ্বল এবং দেখতে খুবই ভালো মানের হয়। তাই বেশি মুনাফার লোভে অসৎ ব্যবসায়ীরা হলুদে সিসা মিশ্রিত করে এবং বেশি দামে বিক্রি করে। সিসা দূষিত দেশের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। 

গবেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রায় ৩ কোটি ৬০ লাখ শিশুর (৬০ শতাংশ) রক্তে উচ্চ মাত্রার সিসা পাওয়া গেছে। ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল মার্কিন একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ গবেষণায় বেশ কয়েকবার হলুদ গুঁড়ায় সিসা পেয়েছে। আইসিডিডিআরবির গবেষণাতেও এমন তথ্য উঠে এসেছে। আবার ননস্টিক পাত্রে ব্যবহৃত টেফলন উপাদানও স্বাস্থ্যের জন্য বেশ ঝুঁকিপূর্ণ বলে প্রমাণ হয়েছে।

‘এশিয়ান ওয়াটার ডেভেলপমেন্ট আউটলুক-২০১৬’ প্রতিবেদন অনুসারে, এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের ৪৮টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নদীর পানি সবচেয়ে দূষিত। ওই প্রতিবেদনে জাতীয় পানি নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থানকে বিপজ্জনক হিসেবে উল্লেখ করা হয়। শহর ও শিল্পাঞ্চলগুলোর ৮০ শতাংশ পয়োবর্জ্য কোনো ধরনের পরিশোধন ছাড়াই নদীর পানিতে ফেলা হচ্ছে। আবার এই পানিই শোধন করে খাওয়ার জন্য সরবরাহ করা হচ্ছে।

পানি শোধনের পরও ই-কোলাইসহ আরও নানা দূষিত উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে পানিতে। চিকিৎসকরা বলছেন, দূষিত পানি সব বয়সী মানুষের তো বটেই আবার গর্ভবতী মায়েদের জন্য খুবই ক্ষতির কারণ হয়ে থাকে। পানি দূষিত হলে তা থেকে ডায়রিয়া, টাইফয়েড, হেপাটাইটিস হয়ে থাকে। এসব রোগ একজন গর্ভবতী মায়ের হলে তার জরায়ুর পানি কমে শিশুর প্রাণনাশের হুমকি দেখা দিতে পারে, শিশু বিকলাঙ্গ, এমনকি ওজন কম নিয়ে জন্মাতে পারে। 

মানুষের দৈনন্দিন প্লাস্টিক নির্ভরতা বাড়তে থাকায় এর একটি বিরূপ প্রভাব পড়েছে গর্ভধারণের ওপর। বলা হয়, বিশ্বে ক্যান্সার সৃষ্টিকারী যদি ১০ উপাদানের তালিকা করা হয়, তার মধ্য একটি অবশ্যই প্লাস্টিক হবে। গর্ভের শিশুদের নাড়িতেও প্লাস্টিকের কণার উপস্থিতি খুঁজে পেয়েছে একদল গবেষক। প্রতিদিন গ্রহণ করা খাবার, পানি ও বাতাসের মধ্য দিয়ে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। জার্নাল এনভায়রনমেন্ট ইন্টারন্যাশনালে প্রকাশিত ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, গর্ভফুলে অন্তত কয়েক ডজন প্লাস্টিক কণা খুঁজে পাওয়া যায়। এমন সংবেদনশীল প্রত্যঙ্গে প্লাস্টিকের উপস্থিতি হতে পারে শিশুদের দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতির কারণ। 

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //