শীর্ষ ধীরগতির শহর ঢাকা

ঢাকার যানজট নিরসনে বিনিয়োগ হয়েছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ফুটওভারব্রিজ, ওভারপাস, আন্ডারপাস, ফুটপাতসহ বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়নে। প্রায় সাড়ে ৩৩ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে তৈরি হচ্ছে ঢাকার প্রথম মেট্রোরেল। চলছে আরও দুটি মেট্রোরেলের কাজ, খরচ হবে ৯৪ হাজার কোটি টাকার মতো। ঢাকার প্রথম এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। চার হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হচ্ছে বিআরটি গড়ার কাজে। এর আগে কয়েক হাজার কোটি টাকা খরচ করে নির্মাণ করা হয়েছে আটটি ফ্লাইওভার ও ওভারপাস। সিগন্যাল বাতির পেছনে খরচ হয়েছে প্রায় ২০০ কোটি টাকা। 

বিপুল এ বিনিয়োগের পরও ঢাকা এখন বিশ্বের শীর্ষ ধীরগতির শহর। ১৫২টি দেশের ১ হাজার ২০০-এরও বেশি শহরের মোটরযানের গড় গতি নিয়ে করা এক গবেষণায় এ তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটসের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (এনবিইআর)। ধীরগতির শহরের তালিকায় শীর্ষ ২০-এ ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রামও রয়েছে। 

ঢাকার যানজট পরিস্থিতি নিয়ে ২০১৭ সালে বিশ্বব্যাংকের বিশ্লেষণে বলা হয়েছিল, ঢাকায় যানবাহনের গতিবেগ ঘণ্টায় সাত কিলোমিটারে নেমে এসেছে। কয়েক বছরের মধ্যে তা মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও নিচে নেমে আসবে। পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি বর্তমানে মানুষের হাঁটার গতির চেয়েও কমে এসেছে। ঢাকার মূল সড়ক ছাপিয়ে যানজট শাখা সড়কগুলোয়ও ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. হাদিউজ্জামান বলেন, ‘রাজধানীর পরিবহন অবকাঠামো উন্নয়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে জরুরি ছিল পরিকল্পিত বিনিয়োগ। সড়কগুলোর সক্ষমতা কতটুকু এবং এসব সড়কে কী পরিমাণ যানবাহন চলাচল করে, তা নিরূপণের জন্য একটি বৈজ্ঞানিক গবেষণার পর সে অনুযায়ী সমন্বিতভাবে বিনিয়োগ পরিকল্পনা গ্রহণ উচিত ছিল। কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টো। কোনো ধরনের বৈজ্ঞানিক গবেষণা না করেই নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে বিভিন্ন সংস্থা, যাদের মধ্যে আবার সমন্বয় নেই। ফলে এগুলো অনেকটা তলাবিহীন ঝুড়ির মতো। সব বিনিয়োগ তলা দিয়ে বের হয়ে গেছে।’

এনবিইআরের গবেষণা বলছে, ধীরগতির শীর্ষ ২০ শহরের তিনটিই বাংলাদেশের। আর সবচেয়ে দ্রুত গতির ২০ শহরের মধ্যে ১৯টি যুক্তরাষ্ট্রের, একটি কানাডার। ওই গবেষণার বরাত দিয়ে মার্কিন সাময়িকী টাইম জানিয়েছে, ১৫২ দেশের ১ হাজার ২০০-এরও বেশি শহরে মোটরযানের গড় গতির ওপর এ গবেষণা চালানো হয়েছে। চীনের বাইরে বিশ্বের মোট শহুরে জনসংখ্যার ৯৬ শতাংশের বসবাস এসব শহরে। এতে দেখা গেছে, দরিদ্র দেশগুলোর তুলনায় ধনী দেশের শহরগুলোয় মোটরযানের গড় গতি অন্তত ৫০ শতাংশ বেশি। 

ম্যাসাচুসেটসের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের সূচকে মাইনাস শূন্য দশমিক ৬০ পয়েন্ট নিয়ে ধীরগতির শহরের তালিকায় প্রথম স্থানে রয়েছে ঢাকা। দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে নাইজেরিয়ার দুই শহর লাগোস ও ইকোরদু। চতুর্থ ও পঞ্চম স্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফিলিপাইনের রাজধানী ম্যানিলা এবং ভারতের মহারাষ্ট্রের বিওয়ান্দি শহর। ৬ নম্বরে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী কলকাতা। ধীরগতির শীর্ষ ১০ শহরের মধ্যে ময়মনসিংহের অবস্থান ৯ ও ১২ নম্বরে রয়েছে বন্দরনগরী চট্টগ্রাম। 

ধীরগতির শীর্ষ ২০ শহরের আটটি ভারতের। বিওয়ান্দি ও কলকাতা ছাড়া বাকি শহরগুলো হচ্ছে বিহারের আররাহ ও বিহার শরিফ, মহারাষ্ট্রের মুম্বাই, মিজোরামের আইজল, দক্ষিণ কর্ণাটকের বেঙ্গালুরু ও মেঘালয়ের শিলং। এর বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে দ্রুতগতির শহরের তালিকায় শীর্ষে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ফ্লিন্ট শহর। 

বিশ্লেষকরা বলছেন, ম্যাসাচুসেটসের ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চের গবেষণাটি হয়েছে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে। একটি শহরের সব সড়কের চিত্র বিশ্লেষণ হয়েছে। বলা হয়, ঢাকায় প্রায় ২০০ কিলোমিটার প্রাইমারি সড়ক রয়েছে। কিন্তু প্রাইমারি সড়কের যেসব বৈশিষ্ট্য তার বেশিরভাগই এসব সড়কে অনুপস্থিত। অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতার কারণে সড়কগুলো ভীষণ রকমের বিশৃঙ্খল। যানবাহন চলছে সক্ষমতার চেয়ে বেশি। ফলে যানজট মূল সড়ক ছাড়িয়ে শাখা সড়কগুলোয়ও চলে যাচ্ছে। এ প্রবণতা ঢাকার জন্য বেশ আশঙ্কার।

যানজট যখন থাকে না, তখনো ঢাকায় যানবাহনের গড় গতি বিশ্বের অন্য শহরগুলোর চেয়ে কম। অপরিকল্পিতভাবে গড়ে ওঠা এ শহরের সড়কগুলোর সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগও কমে এসেছে। তবে যান চলাচলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটানো সম্ভব বলে মনে করেন অধ্যাপক হাদিউজ্জামান। তিনি বলেন, ‘ঢাকার সড়কগুলোর যে সক্ষমতা তা বিবেচনায় নিয়ে চলাচলের জন্য যানবাহনের সংখ্যা সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া জরুরি। ব্যক্তিগত গাড়ি কমিয়ে আধুনিক গণপরিবহন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে কিছুটা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’ 

গবেষণা বলছে, একটি শহরে গাড়ির গতি কেমন হবে সেটি শতভাগ যানবাহনের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে না। এখানে সড়কের বিন্যাস এবং গুণমানের মতো বিষয়গুলোও রয়েছে। এ গবেষণার মূল ব্যক্তি ছিলেন ফিনল্যান্ডের আল্টো ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ প্রত্যয় আকবর, যিনি বড় হয়েছেন ঢাকায়। তার মতে, ‘সবচেয়ে ধীরগতির শহরগুলোয় যে সবচেয়ে বেশি যানজট, এমন নয়। আবার সবচেয়ে বেশি যানজটের সড়কও সবচেয়ে ধীরগতির নয়।’ 

প্রত্যয় আকবর ও তার সহযোগী গবেষকরা তিন লাখের বেশি জনসংখ্যা রয়েছে, এমন সহস্রাধিক শহরের ট্রাফিক বিশ্লেষণে গুগল ম্যাপসের ডাটা ব্যবহার করেছেন। গবেষণায় শহরের কেন্দ্রস্থল থেকে আবাসিক এলাকায় যাতায়াত কিংবা বাসা থেকে রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত ট্রিপের দিকে নজর রাখা হয়েছে। এসব ডাটা পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, কোনো একটি শহরে ভ্রমণ করতে কত সময় লাগবে সে ব্যাপারে ভবিষ্যদ্বাণীর জন্য শহরটির আকার বা কত পুরনো সেটি বিবেচ্য নয়, বরং বড় বিষয় হলো এটি যে দেশে অবস্থিত তার অর্থনৈতিক অবস্থা। 

ঢাকার যানবাহনের গতি নিয়ে এনবিইআরের প্রতিবেদনের সঙ্গে অবশ্য একমত নন বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব এবিএম আমিন উল্লাহ নুরী। তিনি বলেন, ‘এটা অনেক আগের স্টাডি। নিশ্চয়ই আপডেটেড না। বর্তমানে পরিস্থিতির অনেক উন্নতি হয়েছে। আর পৃথিবীর সব শহরে পিক আওয়ারে, অফিস-আদালত কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান শুরু ও ছুটির সময় যানজট হয়। একটা শহরও পাওয়া যাবে না, যেখানে পিক আওয়ারে ট্রাফিক জ্যাম হয় না।’

ঢাকায় বলতে গেলে এখন আর তেমন যানজট হয় না মন্তব্য করে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের সচিব বলেন, ‘এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে চালু হওয়ার পর ১০ মিনিটে ফার্মগেট থেকে বিমানবন্দর পর্যন্ত চলে যাওয়া যাচ্ছে। বিমানবন্দরে নেমেই উত্তরা ফ্লাইওভার। এরপর টঙ্গী ফ্লাইওভার। ২০ মিনিটের মধ্যে ফার্মগেট থেকে টঙ্গী যেতে পারছে মানুষ, যা আগে কল্পনাই করা যেত না। আগামী কাল-পরশুর মধ্যে টঙ্গীতে আরেকটি ফ্লাইওভার চালু হবে। মেট্রোরেল চালু হওয়ার পর উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত কোনো জ্যাম নেই। ২০ অক্টোবরের পর মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল চালু হলে যানজট পরিস্থিতিই বদলে যাবে। ঢাকার পূর্ব দিকে ইস্টার্ন বাইপাস হচ্ছে, মোহাম্মদপুর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত। এর কাজ শেষ হবে আগামী বছর। শিগগির এর সুফল পাওয়া যাবে। চলমান অন্য প্রকল্পগুলোর কাজ সম্পন্ন হওয়ার পর পরিস্থিতির আরও উন্নতি হবে।’ 

ঢাকা দিন দিন স্থবির হয়ে যাচ্ছে, সেটা জানার পরও শহরটির গতি বাড়াতে কার্যকর উদ্যোগ নেওয়া হয়নি বলে অভিযোগ করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. সামছুল হক। তিনি বলেন, ‘ঢাকার গতি বাড়াতে সবচেয়ে কার্যকর উদ্যোগ হতে পারত যানবাহন, বিশেষ করে ছোট ছোট ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ন্ত্রণ। কিন্তু বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত থেকেছে। উল্টো পাঁচ বছরে আট লাখ মোটরসাইকেল নামিয়ে দেওয়া হয়েছে। যারাই ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে নিবন্ধনের জন্য আসছে, ঢালাওভাবে তা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন প্রকল্পের জন্য ইচ্ছেমতো গাড়ি কেনার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। ব্যক্তিগত গাড়ি কেনার জন্য নমনীয় ঋণসহ দেওয়া হচ্ছে নানান সুযোগ-সুবিধা। আমরা একদিকে ফ্লাইওভার, এক্সপ্রেসওয়ের মতো অবকাঠামো বানিয়ে সড়কের সক্ষমতা বাড়াচ্ছি, আবার একই সঙ্গে ইচ্ছেমতো যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে দিচ্ছি।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘ঢাকার পরিবহন ব্যবস্থায় টেকসই উন্নয়ন করতে হলে ছোট গাড়িকে নিরুৎসাহিত করতে হবে। বড় গাড়ি দিয়ে ছোট গাড়িকে প্রতিস্থাপন করতে হবে। এগুলো না করে যত উন্নয়নই হোক না কেন, তা টেকসই হবে না। স্বল্প মেয়াদে হয়তো কিছু সুফল পাওয়া যাবে, কিন্তু তা কখনো স্থায়ী সমাধান হবে না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //