জুনে শেষ হবে ওসমানী উদ্যানের বর্তমান কার্যক্রম

রাজধানীর ওসমানী উদ্যান হবে ‘গোসসা নিবারণী পার্ক’। যেখানে গেলে মানুষের রাগ কমবে, খিটখিটে মেজাজ ঠাণ্ডা হবে। এই ঘোষণা দিয়ে উদ্যানের উন্নয়ন কাজ শুরু করা হয়েছিলো ২০১৭ সালে। কিন্তু সাড়ে পাঁচ বছরেরও বেশি সময়ে কাজ শেষ হয়নি। এখন সেখানে গিয়ে উদ্যানের পরিবেশ দেখলে যে কোনো মানুষের গোসসা আরও বেড়ে যাবে।

সম্প্রতি সরেজমিনে সেখানে গিয়ে দেখা যায়, উদ্যানটি উন্নয়ন কাজের কংক্রিটের অসমাপ্ত অবকাঠামোর ভিড়ে মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। ভেতরটা জঙ্গলে রূপ নিয়েছে। কোথাও কোথাও গাছ উপরে পড়ে আছে। মানুষ সেখানে ঢুকতেই পারছে না। পার্কে হাঁটার জন্য প্রবীণেরা যান না, খেলার জন্য শিশুরা ঢোকে না।

সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকার পর ওসামানী উদ্যানের অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ আবার শুরু করা হয়েছে। এই কাজ আবার কতদিনে শেষ হবে, সে ব্যাপারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা আবু নাছের সাম্প্রতিক দেশকালকে জানান, এটি শেষ হবে আগামী বছর জুনে।

আবু নাছের জানিয়েছেন, ওসমানী উদ্যানের কাজ ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের আওতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে। উদ্যানে মোট ৫টি প্যাকেজের আওতায় কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে তিনটি প্যাকেজের কাজ দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে কার্যাদেশ প্রদান করা হয়েছে। বাকি দুইটি প্যাকেজের দরপত্র প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান পিএফসি এণ্ড এসআই (সেভি) এবং  ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এনডিএফ-এসবিএন (জেভি) তিনটি প্যাকেজের কাজ বাস্তবায়ন করছে।

উদ্যানে আসলে কি করা হচ্ছে

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মুখপাত্র আবু নাছের জানান, প্রকল্পের আওতায় ওসমানী উদ্যানে হাঁটাপথ, নর্দমা, ল্যাণ্ডস্ক্যাপিং, নগর জাদুঘর, লাইব্রেরি, ফুডকোর্ট (খাবারের দোকান), সীমানা প্রাচীর, স্প্রিংলার, গভীর নলকূপ ও আগত দর্শনার্থীদের গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এছাড়া  দুইটি লেক সংস্কার করা হচ্ছে। 

এই প্রকল্পের পাঁচটি প্যাকেজের জন্য মোট বরাদ্দ ১শ ১৬ কোটি টাকা। সরকার ৯৫ শতাংশ এবং দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় বহন করছে।

আবু নাছের উল্লেখ করেন, ওসমানী উদ্যানের বর্তমান কার্যক্রম ১৯ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হলেও ২৫ জুন ২০২৪ এ শেষ হবে। নতুনভাবে শুরু হলেও পুরানো পরিকল্পনা অনুযায়ীই এই কাজ বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

সিটি কর্পোরেশনের বিভিন্ন সূত্রের বরাতে জানা যায়, ২০১৭ সালে ওসমানী উদ্যানে উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়, তার ঠিকাদারি কাজ দেওয়া হয় তিনটি ভাগে। প্রথম ভাগে ছিলো একটি পাঠাগার, দুইটি খাবার চত্বর, গাড়ি রাখার স্থান, ব্যায়ামাগার, টেবিল টেনিস ও বিলিয়ার্ড খেলার ব্যবস্থা, এটিএম বুথ, ওষুধের দোকান, বিনোদন কেন্দ্র এবং নগর জাদুঘর নির্মাণ। দ্বিতীয় ভাগে ছিলো শিশুদের খেলার জায়গা, ভলিবল, ক্রিকেট ও ব্যাডমিন্টন খেলার জায়গা, লেকের পাড় উন্নয়ন, ঘাট তৈরি, মাঠ উন্নয়ন ও বিদ্যুতের উপকেন্দ্র স্থাপন। তৃতীয় ভাগে ছিলো পানি পরিশোধন ব্যবস্থা স্থাপন, স্বাধীনতাচত্বর ও কফি শপ, পানি সংরক্ষণাগার প্রতিষ্ঠা, নৌকা রাখা, ভাস্কর্য বসানো, পুরান ঢাকার থ্রিডি স্থাপত্য নকশার মডেলস্থাপন ইত্যাদি। 

কিন্তু একটি উন্মুক্ত উদ্যান বা পার্কে কেন কংক্রিটের এত অবকাঠামো প্রয়োজন এই প্রশ্নে আগেই অনেক সমালোচনা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ আমলে নেয়নি।

২০১৭ সালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের তৎকালীন মেয়র সাঈদ খোকনের সময় তিনটি ভাগে একই ঠিকাদারকে প্রায় ৯০ কোটি টাকার কার্যাদেশ দেওয়া হয়। একটি ভাগের কাজও গত সাড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময়ে শতভাগ শেষ হয়নি। দক্ষিণ সিটি সূত্র বলছে, ওই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় ৫৪ কোটি টাকার কাজ করেছে। এর মধ্যে বিল দেওয়া হয়েছে ৪৯ কোটি টাকা।

দক্ষিণ সিটিতে মেয়র পদে ২০২০ সালে দায়িত্ব নেন শেখ ফজলে নূর তাপস। দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সূত্রগুলো বলছে, তিনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই উদ্যানটির অবস্থা দেখতে যান। এরপর তিনি দ্রুত কাজ শেষ করতে বলেন। তবে ঠিকাদার সময়মতো কাজ করেননি। বছর দেড়েক আগে পুরোনো ঠিকাদারের কার্যাদেশ বাতিল করা হয়।

আগের ঠিকাদারকে বাদ দিয়ে নতুন যে ঠিকাদারকে কাজ দেওয়া হয়েছে, তারাও কাজ পাওয়ার লম্বা সময় পর গত মাসে অসমাপ্ত উন্নয়ন কাজ আবার শুরু করেছে। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, এখন আগামী বছরের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার চেষ্টা তাদের রয়েছে।

তবে উদ্যানের ভেতরে বিভিন্ন স্থাপনা তৈরির বিরোধিতা করছে পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনকারী বিভিন্ন সংগঠন। বাংলাদেশ পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আলমগীর হোসেন বলেন, উদ্যানের মধ্যে খাবারের দোকান লাগবে কেন? আমরা ওসমানী উদ্যানের ভিতরে গাছ কেটে গাড়ি পার্কিং এলাকা তৈরি, খাবারের দোকান তৈরিসহ কংক্রিটের স্থাপনা তৈরির বিরোধিতা করছি। 

সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা দাবি করছেন, উদ্যানটিতে আধুনিক সুযোগ–সুবিধার ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

পুরোনো উদ্যানের একটি ওসমানী উদ্যান

রাজধানীর গুলিস্তানে দক্ষিণ সিটির প্রধান কার্যালয় নগর ভবনের উল্টো দিকে ওসমানী উদ্যান। এর এক পাশে সচিবালয়। ঢাকার পুরোনো উদ্যানগুলোর মধ্য অন্যতম এই উদ্যানটির আয়তন প্রায় ২৪ একর। এতে অসংখ্য গাছ ও দুইটি জলাশয় রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল মুহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানীর নামে এই উদ্যানের নামকরণ করা হয়েছে। সম্রাট আওরঙ্গজেবের প্রধান সেনাপতি মীর জুমলা আসাম যুদ্ধে ব্যবহার করেছিলেন এমন একটি ঐতিহাসিক কামান এই উদ্যানে রাখা আছে। কামানটি আগে ছিলো ঢাকার বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে। সেখানে আনা হয়েছিলো সোয়ারীঘাট থেকে।

কবে উন্মুক্ত হবে এই উদ্যান

উন্নয়নকাজ শুরুর আগে ওসমানী উদ্যানে বিকেলে হাঁটতে যেতেন ঢাকার অনেক মানুষ। তবে এখন এটি জনসাধারণের জন্য পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। তবে সিটি কর্পোরেশনের তথ্য কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, প্রকল্পের কাজ শেষ হলেই উদ্যানটি সর্ব সাধারণের জন্যই উন্মুক্ত করা হবে। 

ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরিদউদ্দিন আহম্মদ রতন সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, জন সাধারণের জন্য উদ্যানটি উন্মুক্ত করার কাজ চলছে। কোভিডের কারণে ঠিকাদারের কাজ শেষ করতে দেরি হয়েছে। তাই এই কাজ এগিয়ে নিতে দেরি হলো। আমরা কোভিডের পর রমনা পার্ক উন্মুক্ত করে দিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এর উদ্বোধন করেছেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের হাঁটার পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছি। বর্তমান মেয়রের অগ্রাধিকারে রয়েছে ওসমানী উদ্যান। তিনি এটা খুব শিগগিরই অন্তত হাঁটার জন্য উন্মুক্ত করে দেবার কথা ভাবছেন।

প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী খায়রুল বাকের সাম্প্রতিক দেশকালকে বলেন, পুরনো চুক্তি অনুযায়ী কাজ শুরু করার পর অগ্রগতি না হলে চুক্তিতে তা বাতিল করার সুযোগ ছিলো। আমরা সেই অনুযায়ী আগের চুক্তি বাতিল করে দিয়েছি। নতুন করে চুক্তি করে আমরা আবার কাজ শুরু করেছি। এটি এখন চলমান আছে। আগামী বছরের জুন মাসে কাজ শেষ হবে।

তিনি বলেন, আগে অনেক জঙ্গল ছিলো। সেখানে প্রচুর ছিন্নমূল মানুষ ছিলো। এখন জঙ্গল পরিষ্কার করার কারণে ছিন্নমূল মানুষ বেশি আসতে পারে না। আগের চেয়ে অনেক আগাছা আমরা পরিষ্কার করে ফেলেছি।

প্রকল্প এলাকায় যেখানে সেখানে পড়ে থাকা কাটা গাছের গুঁড়ি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এলাকায় কোনো গাছ কাটা হয়নি। শুকনো গাছ কিছু কেটে ফেলা হয়েছে। আগাছা পরিষ্কার করা হয়েছে। কাজ শুরুর সময় মরা গাছের গুঁড়ি আমরা কেটে রেখেছি। সেগুলোই আপনাদের চোখে পড়েছে।

উদ্যানে দুইটি লেকের মধ্যে একটিতে সামান্য পানি আছে। অন্যটিতে পানি আছে কিন্তু কচুরিপানার জন্য চোখে পড়েনি বলে উল্লেখ করেন প্রকৌশলী খায়রুল বাকের।  তিনি বলেন, দুইটি লেকেই পর্যাপ্ত পানি থাকবে। আমরা পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখেই প্রকল্পের কাজ করছি।

তবে খায়রুল বাকের বলেন, কাজ শেষ না হলে হাঁটার পথ দেয়া যাবেনা। কারণ ভারি মেশিন থাকবে। কাজ চলবে। জিনিসপত্রচুরির ব্যাপার আছে। নিরাপত্তার ঝুঁকি আছে। যারা চলাচল করবে তাদের নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে। উদ্যানের কাজ শেষ করার পরই এটি চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া যাবে। এর আগে নয়।

যদিও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন দাবি করছে, আগামী বছরের জুনে ওসমানী উদ্যানের উন্নয়ন কাজ শেষ হবে। কিন্তু তাতে সন্দেহ রয়েছে পরিবেশ নিয়ে আন্দোলনকারীদের।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //