দখল-দূষণে কমছে বুড়িগঙ্গার প্রাণপ্রবাহ

ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা, একসময় বলা হতো ‘ঢাকার খোলা জানালা’। নদীর ওপর দিয়ে প্রবাহিত বিশুদ্ধ বায়ু রাজধানীকে সজীব-সতেজ রাখত। আর এখন এ নদীর জায়গায় প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গড়ে উঠছে স্থাপনা। নদীর পানিতে ফেলা হচ্ছে ভয়ংকর সব বর্জ্য। দখল আর দূষণে কমছে বুড়িগঙ্গার প্রশস্ততা, কমছে প্রাণপ্রবাহ। এমন বাস্তবতায় ঢাকার প্রাণকে রক্ষায় নেওয়া হয় নানা পদক্ষেপ। আদি বুড়িগঙ্গা দখলমুক্ত করে খননের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডব্লিউটিএ)। আদি মুখ থেকে কামরাঙ্গীরচরের লোহার সেতু পর্যন্ত সরকারি সংস্থাটি সীমানা পিলার বসায়। টানা উচ্ছেদ অভিযানও চালায়। এরপর বসানো হয় পাকাপোক্ত সীমানা পিলার। কিন্তু এরই মধ্যে সেই সীমানা পিলারগুলোই বেদখল হতে শুরু করেছে। সরেজমিন এসব দেখা গেছে দোকানপাট এমনকি বাসাবাড়ির ভেতরেও। কেউ আবার রঙ করে মুছে দিয়েছেন পিলারের গায়ে লেখা সরকারি নম্বর।

কামরাঙ্গীরচরের কয়লারঘাট মসজিদের দেয়াল ঘেঁষেই বিআইডব্লিউটিএর ১৭ নম্বর পিলার। ওই এলাকার অনেক পিলারের আবার ঠাঁই হয়েছে বিভিন্ন দোকান ও খাবার হোটেলের ভেতর। কোনো কোনো পিলার পাওয়া গেছে ভবনের ভেতর কিংবা আড়ালে। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, আশপাশের স্থাপনাগুলো একসময় বাঁশ ও কাঠের ওপর নির্মাণ করা হয়েছিল। পরে পাকা ভবন নির্মাণ করা হয় নদীর জায়গায়।  

আদি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর নির্মিত লোহার সেতু লাগোয়া মুসলিমবাগের স্থানীয় বাসিন্দা আহমেদ সুমন বলেন, ‘বিভিন্ন সময়ে অভিযান চালিয়ে দখল করা জমি থেকে কিছু স্থাপনা অপসারণ করেছে বিআইডব্লিউটিএ। দখলদারদের উচ্ছেদ না করেই সেখানে সীমানা পিলার স্থাপন করেছে সংস্থাটি। এক থেকে দেড় বছর আগে পিলারগুলো বসানো হয়েছে। তবে এখনো অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়নি। দখলদারদের বেশিরভাগই প্রভাবশালী। অনেক বাড়ির মালিক এখানে থাকেন না। তারা মূলত বাড়িগুলো ভাড়া দিয়ে রাজধানীর অন্য কোথাও থাকেন।’

নদী রক্ষাকর্মীরা বলছেন, ২০০৯ সালে হাইকোর্ট বুড়িগঙ্গা, তুরাগ, বালু ও শীতলক্ষ্যা নদীকে আগের অবস্থায় ফেরাতে এবং দূষণ ও দখল থেকে রক্ষা করতে সরকারকে নির্দেশ দেন। পাশাপাশি ভরাট করা মাটি অপসারণের জন্য দখলদারদের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় খরচ আদায়ের আদেশ দেন উচ্চ আদালত। কিন্তু বিআইডব্লিউটিএ এখনো সেটি করতে পারেনি। 

এদিকে নদীর জায়গা দখল করে পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট এলাকায় গড়ে উঠছে নানা স্থাপনা। উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী ২০১০ সালে ওই এলাকায় প্রথম অবৈধ দখল উচ্ছেদ অভিযান চালায় বিআইডব্লিউটিএ। কয়েক দিন পর আবার বেদখল হয়ে যায় ঘাটটি। দীর্ঘ নয় বছর পর ২০১৯ সালে সরকারের সংস্থাটি নতুন করে উচ্ছেদ অভিযান চালায়। দখলমুক্ত করা হয় নদীর সাত বিঘা জমি। এবারও কয়েক দিনের মাথায় তা আবার বেদখল হয়ে পড়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, নদীরক্ষার দায়িত্বে যারা রয়েছেন তাদেরকে ম্যানেজ করেই বহাল তবিয়তে দখলদাররা।   

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটটি ইবরাহিম আহাম্মেদ রিপন নামে স্থানীয় এক প্রভাবশালীর দখলে। কখনো ভাইয়ের নামে কখনো স্টাফের নামে ঘাট ইজারা নেন তিনি। ইজারার শর্ত ভেঙে ব্যবহার করেন অন্য কাজে। কাগজে কলমে ঘাটটির বর্তমান ইজারাদার মো. রেজাউল ইসলাম, যিনি রিপনেরই অফিসের স্টাফ। 

বিআইডব্লিউটিএর নথিপত্র ঘেঁটে দেখা যায়, ঘাটটির পয়েন্ট হিসেবে লেখা আছে, মিলব্যারাক থেকে শ্মশানঘাট পর্যন্ত শুল্ক আদায় ও লেবার হ্যান্ডেলিং পয়েন্ট। আরসিন গেট থেকে মিরেরবাগ ও মিলব্যারাক থেকে চরমিরেরবাগ পয়েন্ট ফেরিঘাট। এর মধ্যে মিলব্যারাকের পশ্চিম সীমানা অর্থাৎ গেন্ডারিয়া খালের পূর্ব দিক শ্মশানঘাট পর্যন্ত এলাকায় সব ধরনের নৌযানের বার্দিং চার্জসহ মালামাল পরিবহনের শুল্ক ও লেবার হ্যান্ডেলিং চার্জ এবং ফেরিঘাটে খেয়া নৌকায় যাত্রী ও মালামাল পরিবহনের শুল্ক আদায় করার দায়িত্ব ইজারাদারের।

সম্প্রতি সরেজমিন দেখা যায়, পোস্তগোলা শ্মশান ঘাটসহ বুড়িগঙ্গার ফোরশোর এলাকায় জাহাজের যন্ত্রাংশ ফেলে রাখা হয়েছে। এসব ঘিরেই শ্রমিকদের ব্যস্ততা। নদীর ফোরশোরের মধ্যেই নির্মাণ করা হয়েছে ইজারাদারের অফিস। বিভিন্ন জায়গা থেকে জাহাজের যন্ত্রাংশ নিয়ে আসছে ট্রলার। 

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দীর্ঘ এক যুগেরও বেশি সময় ধরে ঘাটটি ইজারার শর্তভঙ্গ করে প্রভাবশালী ইব্রাহিম আহাম্মেদ রিপন ব্যবহার করছেন। রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি ঘাটটিতে একসময় অবৈধ বালুর ব্যবসা করতেন। বর্তমানে চলছে জাহাজের যন্ত্রাংশ ভাঙার কাজ।  

ইজারার শর্তভঙ্গের বিষয়ে জানতে চাইলে ইব্রাহিম আহাম্মেদ রিপন বলেন, ‘এক সময় এখানে বালুর ব্যবসা ছিল। এখন লোহার ব্যবসা করছি। পাশেই লোহার মার্কেট। হিসাব নিকাশ ও অন্যান্য কাজের জন্য একটি অফিস করেছি।’ 

নদীর ফোরশোরে স্থাপনা নির্মাণের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অফিস যদি না থাকে তাহলে কীভাবে আমরা কাজ করব। রাস্তায় দাঁড়িয়ে তো আর কাজ করা সম্ভব নয়। বিআইডব্লিউটিএর স্থাপনাও নদীর ফোরশোরে রয়েছে।’ 

বুড়িগঙ্গার তীর দখল করে অবৈধ বালি ব্যবসা বন্ধ করতে ২০১৯ সালে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করেছিল বিআইডব্লিউটিএ। ওই সময় ইব্রাহিম রিপন তার দল নিয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তাদের ওপর হামলা চালান। তখন শ্যামপুর থানার পুলিশ বাদী হয়ে রিপন ও তার ভাইসহ অনেকের বিরুদ্ধে একটি মামলা করে। ওই মামলায় রিপনকে আসামি করে চার্জশিটও দিয়েছিল পুলিশ।

ঢাকা নদী বন্দরের সাবেক এক কর্মকর্তা নাম অপ্রকাশিত রাখার শর্তে বলেন, ‘বিআইডব্লিউটিএর প্রধান কার্যালয়ের কর্মকর্তাদের যোগসাজশে বছরের পর বছর পোস্তগোলা শ্মশান ঘাট ও বুড়িগঙ্গা নদীর তীর দখল করে বেআইনি ব্যবসা করে আসছে একটি চক্র। এ চক্রের নেতৃত্বে রয়েছে ইব্রাহিম আহাম্মেদ রিপন। তবে স্থানীয় প্রভাবশালীরাও এখানে জড়িত। তাই অভিযান চালিয়েও বুড়িগঙ্গার তীর দখলমুক্ত করা সম্ভব হয়নি। আবার ঢাকা নদী বন্দর থেকে উচ্ছেদের কথা বলা হলেও প্রধান কার্যালয় থেকে কোনো জোরালো সাড়া পাওয়া যায় না।’

বিআইডব্লিউটিএর বন্দর ও পরিবহন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক একেএম আরিফ উদ্দিন যদিও বলেন, ‘পোস্তগোলা ‌শ্মশান ঘাটে এখন আর কোনো অবৈধ স্থাপনা নেই। জাহাজ ভাঙার যন্ত্রাংশও নেই। আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালানোর পর সেখানে আর কোনো স্থাপনা নেই।’

পরিবেশবাদীরা বলছেন, বুড়িগঙ্গার একাধিক স্থানে এখন বালুমহাল। নদীর তীরে বালুমহাল হওয়ায় বাল্কহেড (বালুবাহী জাহাজ) থেকে বালু খালাস করার সময় নদী ভরাট হচ্ছে। সব মিলিয়ে যেভাবে বুড়িগঙ্গার শাখা-প্রশাখা দখল করা হচ্ছে, তাতে একসময় রাজধানীর নিম্নাঞ্চলে সৃষ্টি হবে দীর্ঘস্থায়ী জলাবদ্ধতা।

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //