আর্মেনিয়ান চার্চ, ঢাকার আর্মেনীয় স্মৃতিচিহ্ন

একবার গল্পে গল্পে একজন বলেছিলেন, ‘এককালে ঢাকা ছিল বুড়িগঙ্গার তীরে, কিন্তু এখন ঢাকার তীরে বুড়িগঙ্গা!’ বক্তা নেহাতই রসবোধ থেকেই যে উক্তিটি করেছেন, তাতে একেবারেই সন্দেহ নেই। তবে বুড়িগঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালে উক্তির সত্যতাও মেলে। এ কালের দূষণ আর দখলের ইতিহাস ছাড়িয়ে কয়েকশ বছর পেছনে ফিরলে দেখা যায় বুড়িগঙ্গার জৌলুসময় দিন। বড় বড় জাহাজে সদাই চাপিয়ে আরব, ইংরেজ, আর্মেনীয় বণিকেরা এসে ভিড়ছেন তার তীরে গড়ে ওঠা ছোট্ট কিন্তু বাণিজ্যে প্রসিদ্ধ শহর ঢাকায়। বাণিজ্য শেষে কেউ ফিরে গেছেন, কেউবা ফেরেননি; খুঁটি গেড়েছেন ঢাকায়। যারা থেকে গেছেন তাদের মাঝে আর্মেনীয় জাতিসত্তার মানুষ বেশ উল্লেখযোগ্য। আর্মেনীয়রা মূলত লবণের ব্যবসায়ী হিসেবে আগমন করে, তবে পরে তারা পাট, বস্ত্র ও পানের ব্যবসায় হাত পাকিয়েছিল। সে সময় বুড়িগঙ্গা নদী বেষ্টিত ঢাকা থেকে সারা বঙ্গে নদীপথে পণ্য পরিবহন সুবিধাজনক হওয়ায় আর্মেনীয়রা বুড়িগঙ্গার তীরে বসতি স্থাপন করে।

যে স্থানে আর্মেনীয়রা বসতি গড়েছিল, পূর্বে সে জায়গার নাম ছিল ‘আলে আবু সাইদ’। আর্মেনীয় বসতি গড়ে ওঠার পর তা আরমানিটোলা নামেই পরিচিতি পায়। ঢাকায় বসবাসরত তুখোড় ব্যবসায়ী এই আর্মেনীয়রা বেশ ধর্মপ্রাণ ছিল বলেও ইতিহাস পাঠে জানা যায়। ঢাকা কিংবা কলকাতা যেখানেই তারা ছিলেন ধর্মীয় আচার পালনে চার্চ তৈরি করেছেন। পুরান ঢাকার ‘আর্মেনিয়ান চার্চ’ এখনো সে সাক্ষ্য বহন করে। চার্চের সুরম্য অবকাঠামো এবং আঙিনা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা কবরে মার্বেল পাথরের এপিটাফ আর্মেনীয়দের অর্থনৈতিক সচ্ছলতার দিকটিও উঠে আসে।

আগা মিনাস ক্যাটচিক নামের এক আর্মেনীয়র দান করা জমিতে ১৭৮১ সালে চার্চটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ইউরোপীয় স্থাপত্যরীতিতে তৈরি এ চার্চের মূল দরজা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করলে দেখা যায় হাতের বাঁদিকে একটি কাঠের পেঁচানো সিঁড়ি উঠে গেছে চার্চের ছাদে। একটি স্বতন্ত্র হাঁটাপথ চার্চের মেঝেকে দুই ভাগে বিভক্ত করেছে। ডান-পাশে নারী ও শিশুদের এবং বাঁ-পাশে পুরুষদের বসার স্থান রেখে স্বতন্ত্র পথটি সোজা গিয়ে চার্চের মূল বেদিতে শেষ হয়েছে। সেখানে উঁচু বেদিতে যিশুখ্রিষ্টের কয়েকটি চিত্রকর্ম ও ক্রুশ চিহ্ন আঁকা। চার্চের আঙিনা জুড়ে রয়েছে প্রায় তিনশ কবর। কবরগুলো বেশ বৈচিত্র্যময়। দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া প্রতিটি কবরেই শোভা পাচ্ছে মার্বেল পাথর। তাতে মৃতের স্বজনদের আবেগময় নানা উক্তি লেখা। কোনো কোনো কবরে মায়ের প্রতি সন্তানের ভালোবাসার প্রকাশ ঘটেছে, কোথাও মৃত সন্তানের প্রতি পিতামাতার। আবার কোথাও স্বামী-স্ত্রীর প্রেমময় উক্তি শত বছরের বিরহের জানান দিচ্ছে। চার্চের সমাধি ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে, ১৮৭৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হওয়া ক্যাটচিক এভিটিক থমাসের সমাধি। কারণ এর পাশেই শ্বেতপাথরের একটি নারীমূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। এটি থমাসের স্ত্রী কলকাতা থেকে এনে এখানে স্থাপন করেছিলেন তার মৃত স্বামীকে উৎসর্গ করে। আশপাশে খুঁজেও থমাসের স্ত্রীর নাম কিংবা সমাধি কিছুই পাওয়া গেল না। আর্মেনিয়ান চার্চে শেষ যাকে সমাধিস্থ করা হয় তার নাম ‘ভেরোনিকা মার্টিন’। ২০০৫ সালের ৭ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ভেরোনিকার স্বামী মাইকেল জোসেফ মার্টিন ১৯৮৬ থেকে ২০১৪ পর্যন্ত এ চার্চের দেখভাল করেছেন। ২০১৪ সালে তিনি যখন ঢাকা ছাড়েন তখন তিনি ঢাকার একমাত্র আর্মেনিয়ান বংশোদ্ভূত মানুষ। ২০২০ সালের ১০ এপ্রিল তিনি কানাডায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

আর্মেনিয়ান চার্চে অনেক দর্শনার্থীর দেখা মেলে। বিদেশি পর্যটকও আসেন। এখানেই দেখা হলো সাউথ কোরিয়ান পর্যটক স্যাংয়ের সঙ্গে। ভাষাগত জটিলতায় তার সঙ্গে বিশদ কথা বলা গেল না। সঙ্গে থাকা ট্যুরগাইড সুলেমান বললেন, ‘স্যাং ঢাকার ঐতিহাসিক স্থানগুলোর ছবি তুলতে এসেছে, তারই অংশ হিসেবে আর্মেনিয়ান চার্চে আসা।’

সাভার থেকে এসেছেন রাগীব রিয়াসাদ খৈয়াম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগে পড়ছেন তিনি। জানালেন, ‘চার্চের ভেতরটা খুব সুন্দর। ইউরোপের চার্চে যা দেখেছি সেটার সঙ্গে একটা মিল পাচ্ছি। আর্মেনীয়রা আমাদের দেশে এসেছিলেন এতটুকু জানি, কিন্তু তাদের ইতিহাস বিশদ জানি না।’

সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

Epaper

সাপ্তাহিক সাম্প্রতিক দেশকাল ই-পেপার পড়তে ক্লিক করুন

Logo

ঠিকানা: ১০/২২ ইকবাল রোড, ব্লক এ, মোহাম্মদপুর, ঢাকা-১২০৭

© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh

// //