শহর জুড়ে তখন সন্ধ্যার আলো ছড়িয়ে পড়েছে। মানুষের প্রাত্যহিক ব্যস্ততার ভিড় পেরিয়ে যেতে যেতে মিরপুর এক নম্বরে হযরত শাহ আলী মহিলা কলেজের সামনেই চোখে পড়ল ভ্যানের উপরে থরে থরে সাজানো লোভনীয় সব খাবার। অল্পক্ষণের মধ্যেই জড়ো হতে লাগল অনেক মানুষ। বড় বড় পাত্রে সাজানো বিয়েবাড়ির সব খাবার এখানে আনা হয়েছে।
খাবারের পাত্রের কোনোটাতে গরুর মাংস, কোনোটাতে মুরগির রোস্ট, কোনটায় আবার খাসির রেজালা। বড় পাত্র থেকে খাবারগুলো ভাগ করে রাখা হলো ছোট ছোট বাটিতে। বাটি ভরা তেল-মসলা যোগে রান্না করা সুস্বাদু খাবারের ঘ্রাণ যেন ছড়িয়ে পড়েছে এলাকা জুড়ে। তারই গন্ধে আসছে মানুষ। সবাই যে কিনতে এসেছে তা নয়। কেউ কেউ দেখছে, দাম করছে। সময় যত যাচ্ছিল মানুষের ভিড় তত বাড়ছিল।
শাহ আলী মহিলা কলেজের কলেজ গেটের সামনে বিয়েবাড়ির এ খাবার বিক্রি প্রাত্যহিক ঘটনা। বিকেল ৫টা থেকে রাত ১২টা পর্যন্ত চলে খাবার বিকিকিনি। নামি-দামি ক্লাব-কমিউনিটি সেন্টারে যেসব খাবার পরিবেশন করা হয় সেগুলো ফুটপাতে এলো কীভাবে? খাবারের এক ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকার বিভিন্ন ক্লাব ও কমিউনিটি সেন্টারে আয়োজিত বিয়ের অনুষ্ঠানগুলো থেকে বেঁচে যাওয়া খাবার এখানে আসে। ক্লাব-কমিউনিটি সেন্টারগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়ীদের যোগাযোগ আছে। খাবার বেঁচে গেলে তারাই ফোন দিয়ে এসব ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দেয়। কম দামে বিয়েবাড়ির লোভনীয় খাবার কিনতে এখানে আসে নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত ক্রেতারাও। ফুটপাতে এলেই এর দাম কমে যায়। মিরপুরের এই ফুটপাতে এসব খাবার বিক্রি হয় স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক কম দামে। এখানকার দোকানে গরুর মাংসের বাটি ৬০০ টাকা। তবে একই রকমের বাটির খাসির মাংস কিনতে হয় ৮০০ টাকা দরে। বিয়েবাড়ির মুরগির মাংসের বিরিয়ানিও এখানে পাওয়া যায়। পলিথিনে ভাগ ভাগ করে রাখা বিরিয়ানির দাম ১৫০ থেকে ২০০ টাকা। মুরগির রোস্ট বাটির আকার ভেদে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা। প্রায় সমপরিমাণ টাকায় পাওয়া যায় মুরগির ঝাল ফ্রাই। এসব দোকানে কখনো কখনো মাছ পাওয়া যায়। আস্ত খাসি কিংবা খাসির মাথাও মাঝেমধ্যে আসে এখানে। খাসির মাথার দাম শুরু হয় বাটি ৭০০ টাকা থেকে। অন্যদিকে সম্পূর্ণ খাসি বিক্রি হয় দামাদামির ভিত্তিতে। জর্দা কিংবা পোলাওয়ের মতো খাবারও পরিমাণ অনুযায়ী দাম হাঁকা হয়। দুই লিটারের বোতল ভরতি বোরহানির দামও ওঠানামা করে। প্রতিদিন এখানে খাবার যখন আসে, ভালো জিনিস পাওয়া যায়। শুধু সময় করে আসতে হবে-এটাই হলো আসল কথা।
এখানে কথা হলো আ. হাকিম, ফরিদা ইয়াসমিন, মো. শামীমের সঙ্গে। তারা সবাই সপরিবারে এসেছিলেন এখানে। কিনেছেন গরু ও খাসির মাংস। কথা প্রসঙ্গে জানালেন, ফেসবুকে দেখে এখানে মাংস কিনতে এসেছেন। দাম সে অর্থে খুব বেশি নয়। কারণ বাজারে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে হলে ৮০০ টাকা লাগে, সাথে ২০০ টাকার মসলা। আর এখানে এক কেজি রান্না করা গরুর মাংস সর্বোচ্চ ৬০০ টাকায় পাওয়া যায়। মানুষ কিনবে না কেন?
মধ্যবিত্ত ক্রেতাই এখানে বেশি। অনেক গাড়িওয়ালা এসেও খাবার কিনে নিয়ে যায়। এখানে বিক্রি হওয়া খাবার তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয় সকাল থেকেই। সকালের দিকে প্রস্তুতকৃত খাবার সন্ধ্যা গড়িয়ে যখন এই ফুটপাতে আসে, তখন ঠিক কতটা খাওয়ার উপযোগী থাকে-সে নিয়ে প্রশ্ন অনেকেরই। এ ছাড়াও বিয়েবাড়ির অতিরিক্ত তৈলাক্ত খাবার যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায়, সে কথা বাদ দিলেও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সকলেরই আপত্তি। সেটি হলো, ভ্যানের ওপর খাবারগুলো কখনোই ঢেকে রাখা হয় না। কিন্তু দোকানি বা উপস্থিত ক্রেতাদের অভিমত, খাবার অস্বাস্থ্যকর হলে এতদিন এই ব্যবসা টিকতে পারত না। তা ছাড়া খাবার অধিকাংশই আসার পরেই বিক্রি হয়ে যায়। ফলে এগুলো নষ্ট হওয়ার ঝুঁকিতে থাকে-এটা বলা যাবে না। বিভিন্ন যুক্তি-তর্কের মধ্যেও চলছে বিয়েবাড়ির খাবার কম দামে। ওখান থেকে চলে আসার পরও সুগন্ধি খাবারের গন্ধ যেন ভোলা যায় না।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh