-‘এখানে আবার এসছেন কেন?’
-‘বাহ্ রে! আপনার দেওয়া শাড়িটা পরলাম, একটু কৃতজ্ঞতা জানাব না?’
-‘নিন, পান খান...’
-‘ওসব কৃতজ্ঞতায় আমার পেট ভরবে না মেমসাহেব, এর জন্য আমাকে অনেকগুলো টাকা খরচ করতে হয়েছে।’
-‘সময় এলে, সুদে-আসলে শোধ করে দেব।’
-‘সে সময় কি আর আসবে কোনো দিন?’
-‘আসতেও পারে, মানুষের সব দিন সমান যায় না...’
হলের সাদা-কালো পর্দার এই দৃশ্যে গত শতকের আশির দশকের জনপ্রিয় ঢাকাই সিনেমার নায়িকা শাবানা আর ড্যাসিং নায়ক উজ্জ্বলের কথোপকথন, তার পর অভূতপূর্ব লাজুক নয়নে তাকিয়ে, মিষ্টি হেসে- শাবানা লিপসিং করেন, কোকিলসুরের শিল্পী সাবিনা ইয়াসমীন গেয়ে ওঠেন, সে লিপসিংয়ে ‘যদি সুন্দর একটা মুখ পাইতাম/যদি সুন্দর একটা মন পাইতাম/সদর ঘাটের পানের খিলি তারে/বানাই খাওয়াইতাম...’ হুড়মুড়িয়ে গানটি শুনতে থাকি আমরা। তখনকার দিনে গানটি এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে যে, সদরঘাটও তার বিপুল সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয়। খেয়াঘাট, চায়ের দোকান, হাট-বাজার কোথায় বাজেনি এই গান? এমনকি একটা সময় শুনেছি ঈষৎ বদলে ওয়াজমাহফিলেও গেয়েছেন কোনো কোনো বক্তা। বিপুল জনপ্রিয়তার জন্য এমএন আখতারের লেখা গানটির নানান রূপ তৈরি হয়ে যায় নিমেষেই। তখনকার দিনে নয় কেবল; অন্য সময়েও যখন যে অঞ্চলের লোক এই গানটি গাইতেন, তখন সেখানে নিজের অঞ্চলের নাম বসিয়ে নিতেন। এখন বিষয় হলো- গানটির কথামতো সত্যিই কি সদরঘাটের পানের খিলি এতটাই পাগল করা?
হতে পারে এমন সম্ভাবনাও ঠিক। সেজন্য সদরঘাট ঘুরে আসতে দোষ কোথায় আমাদের।
মানব শরীরে অসংখ্য শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে থাকা হাজারো নদ-নদী, খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়ের দেশ কবি জীবনানন্দ দাশের রূপসী বাংলা। ভারতীয় উপমহাদেশের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে কয়টি শহর রয়েছে এর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। এ শহর গড়ে উঠেছে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে। আদি ঢাকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নদীবন্দরটির নাম ‘সদরঘাট’। এ ঘাট কবে সৃষ্টি হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে এ ঘাট ঘিরে রয়েছে নানা ঘটনাপ্রবাহ। ঊনিশ শতকে সদরঘাটের গুরুত্ব বেড়েছে, বিশেষ করে প্রধান ব্যবসায়িক জনপদরূপে। এটি পুরান ঢাকা অঞ্চলে হওয়ায় আরও প্রসিদ্ধ হয়ে উঠেছে একালে এসেও। ঘাটটির কাছে রয়েছে বাংলাদেশের পুস্তক প্রকাশনার ঘাঁটি বাংলাবাজার, পাশে রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিং, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, বলধা গার্ডেন, আহসান মঞ্জিল। এসবের বাইরে রয়েছে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নদীপথে আসা পণ্য, বিশেষ করে মাছ ও ফলের সুবিশাল সব আড়ত। দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে ঢাকা শহরের নদীকেন্দ্রিক যোগাযোগব্যবস্থার পরিকেন্দ্র এই সদরঘাট। একটা সময় ছিল অসংখ্য লঞ্চ আর স্টিমারে পূর্ণ এ ঘাট। কোনো অঞ্চল থেকে যাত্রীবোঝাই নতুন লঞ্চ ঘাটে এসে যখন ভেড়ে, তখন কুলিদের দৌড়া-দৌড়ি আর হুড়োহুড়িতে টেকা বড় দায় হয়ে যায়। মানুষের চলার জন্য তিল ধারণের ঠাঁই যেন থাকে না তখন।
ঐতিহ্যবাহী এই সদরঘাটকে ঘিরে গড়ে উঠেছে নিম্নবিত্ত-খেটেখাওয়া মানুষের আয়ের নানাবিধ উপায়। কোন পেশার মানুষ এখানে পাওয়া যায় না- এটা সত্যি অজানা আমাদের। কারণ এই ঘাট চব্বিশ ঘণ্টা চলমান। রাত নেই, দিন নেই মানুষ ছুটছে; কারও গন্তব্য ঘর, কারও গন্তব্য কাজের ঠিকানা, কারও গন্তব্য দূরের দেশ, কারও গন্তব্য অজানায়- এ যেন ছুটে আসা মানবঝড়। নদীর মধ্যে এই ঘাটটির অধিকাংশ পন্টুনের অবস্থান হলেও এখানে ডিঙির ভিড়ও লেগে থাকে। এখানে চারপাশে শব্দের দূষণ যেন একটি ভিন্নসুর তৈরি করছে। লঞ্চঘাটের ডিঙিগুলো যাত্রী নিয়ে এপার-ওপার করছে, কুলিদের শোরগোল- সব কিছু মিলে সদরঘাট এমন একটি জায়গা, যা কখনো নীরব থাকে না। এই ঘাটকে সিনেমার পর্দায় প্রায়ই দেখা যেত আগেকার দিনে। এই ঘাটের এতটা সুনাম আর খ্যাতি যে, এই ঘাটকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অসংখ্য গল্প; যা অধিকাংশই লোকমুখে শোনা যায়, হয়তো এ গল্পগুলোর বাস্তব ভিত্তি রয়েছে, তবে বাস্তবতার সঙ্গে এ গল্পের মিল খুব কমই বলা চলে।
পানের যে কথা শুনেছি গানে, সত্যিই সেই পানের দেখা পেয়ে যাই আমরা সদরঘাটের সবখানে। আসলে এখানে মিষ্টিপান থেকে শুরু করে হরেক স্বাদের পান পাওয়া যায়- আগুনপান, ঝালপান, ম্যাজিকপান। আর ঐতিহ্যবাহী বিউটি বোর্ডিংয়ে পদ্মার সরষে ইলিশ খাওয়ার পর নিশ্চয়ই একটা পান না খেলে কেমন পানসে পানসে লাগে দুপুরটা, তাই পান খেয়ে সদর ঘাটের পানের এবং সিনেমার গানের সৌন্দর্য উপভোগ করি এবং সে স্মৃতি ভোলার নয়।
সাম্প্রতিক দেশকাল ইউটিউব চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করুন
© 2024 Shampratik Deshkal All Rights Reserved. Design & Developed By Root Soft Bangladesh